ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

১২শ’ শিল্পকারখানা অচল দৈনিক ক্ষতি শত শত কোটি টাকা

তিতাসের উদাসীনতায় গাজীপুরে ভয়াবহ গ্যাস সঙ্কট

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১৭ অক্টোবর ২০১৬

তিতাসের উদাসীনতায় গাজীপুরে ভয়াবহ গ্যাস সঙ্কট

রশিদ মামুন/মোস্তাফিজুর রহমান টিটু ॥ তিতাসের উদাসীনতায় ভয়াবহ গ্যাস সঙ্কটে গাজীপুরের শিল্পে উৎপাদনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। গ্যাসের অভাবে এক হাজার ২০০ শিল্প-কারখানার চাকা ঘুরছে না দিনের বেলায়। শুধু তৈরি পোশাক শিল্পেই দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ ২০০ কোটি টাকার বেশি। রাত ১২টা থেকে ৬টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ কিছুটা থাকলেও বাকি ১৮ ঘণ্টাই শিল্প উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা সরাসরি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করছে। তাঁরা সারকারখানা বন্ধ করে গ্যাস সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন। সঙ্কট থেকে কবে মুক্তি মিলবে সে বিষয়ে তিতাসের কর্মকর্তারা এক একজন এক এক রকম সময় সময়সীমার কথা জানান। তিতাসের গাজীপুর এবং চন্দ্রা জোনের ব্যবস্থাপকরা বলছেন স্বাভাবিক সরবরাহ পেতে আরও দেড় মাস অপেক্ষা করতে হবে। আর তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলছেন মুক্তি মিলতে কমপক্ষে আরও ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে গাজীপুরের শিল্পে কয়েকটি সরবরাহ লাইন দিয়ে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এক্ষেত্রে বিকল্প লাইনে সরবরাহ বৃদ্ধি করলে সঙ্কট সামাল দেয়া সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে। গাজীপুরের তিতাসের ব্যবস্থাপক সাব্বের আহমেদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে জানান, টাঙ্গাইলের দুর্ঘটনার পর সরবরাহ বন্ধ ছিল। গত দুই দিন যাবত আবার আংশিক চালু হয়েছে। তিনি জানান, ফেটে যাওয়া সরবরাহ লাইনটি দিয়ে দৈনিক দেড় মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হতো, গত দুই দিন ধরে আবার আধা মিলিয়ন ঘনফুট বিকল্প উপায়ে সরবরাহ হচ্ছে। তিনি জানান, ঠিকাদার নিয়োগের পরেও আরও দেড় মাস সময় লাগবে সরবরাহ লাইনটি স্বাভাবিক হতে। একই কথা বলছেন গাজীপুরের চন্দ্রা জোনের তিতাসের ব্যবস্থাপক সুরুজ আহমেদ। তিনি বলেন, সরবরাহ লাইনটি সারিয়ে তুলতে বেশ সময়ের প্রয়োজন হবে। তিনি বলেন, সম্প্রতি ঘোড়াশালে ৪৫০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুত কেন্দ্র চালু হয়েছে। অন্যদিকে চালু রয়েছে শাহজালাল সার কারখানা। অতিরিক্ত পরিমাণের গ্যাস প্রয়োজন হওয়ায় গাজীপুরের সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। টাঙ্গাইলের পুলিং নদীতে গত ৫ অক্টোবর সকালে ২০ ইঞ্চি ব্যাসের একটি গ্যাস লাইন ফেটে গেলে সঙ্কট শুরু হয়। বিকল্প উপায়ে ১২ ইঞ্চি ব্যাসের একটি পাইপ লাইন দিয়ে সরবরাহ শুরু করলেও গ্রাহক অর্ধেক গ্যাসও পাচ্ছেন না। রবিবার ঠিকাদার বিকল্প আরেকটি লাইন নির্মাণ করতে জিনিসপত্র নিয়ে টাঙ্গাইলে গিয়েছেন। ভয়াবহ এই সঙ্কট হবে জেনেও ১১ দিন কাজ শুরু করতে লেগে যাওয়াকে তিতাসের উদাসীনতা হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা। ভয়ঙ্কর গ্যাস সঙ্কটের কথা নানাভাবে জ্বালানি বিভাগের কানে তুলেও কোন সুফল পাননি উদ্যোক্তারা। তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মীর মসিউর রহমান এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, আজ রবিবার ঠিকাদার আরেকটি ১২ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ লাইন নির্মাণ করতে ঘটনাস্থলে গেছেন। ঘটনার ১১ দিন পর এই কার্যক্রম কালক্ষেপণ কি না জানতে চাইলে বলেন, গ্যাসের লাইনটি চালু করাই একটি চ্যালেঞ্জ ছিল, আমরা চালু করে দিয়েছি। এছাড়া এখন তিতাস চাহিদার তুলনায় দৈনিক ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কম পাচ্ছে। এর একটি প্রভাব গাজীপুরের উপরও পড়ছে বলে জানান তিনি। কবে নাগাদ এই সঙ্কট দূর হবে জানতে চাইলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, কমপক্ষে আরও দুই সপ্তাহ সময় প্রয়োজন হবে। গাজীপুরের গ্যাস সঙ্কটের চিত্র সরেজমিনে রবিবার ঘুরে দেখা গেছে, গাজীপুরের কোন শিল্প কারখানাই দিনের বেলা উৎপাদন করতে পারছে না। ৬ দানা হাজির পুকুরের একটি কারখানায় রবিবার ভোর ৬টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ ছিল ১০ পিএসআই। সকাল ৭টায় তা কমতে শুরু করে। সাতটায় এসে গ্যাসের চাপ কমে ৮ পিএসআইতে দাঁড়ায়। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত চাপ ছিল তিন পিএসআই। বিকেল ৪টায় আবার দেড় পিএসআই বেড়ে সাড়ে চার পিএসআইতে দাঁড়ায়। ওই কারখানার কর্মকর্তা আতিয়ার রহমান জানান, সাতটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত তার কারখানার কর্মীরা অলস সময় কাটিয়েছেন। এই সময় তাদের উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়েছে। এই চিত্র নিত্যদিনের উল্লেখ করে তিনি জানান, আমরা স্থানীয়ভাবে তিতাসের অফিসে যোগাযোগ করলে জানানো হয়েছে তবে এই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে তারা বলতে পারেন না। তিনি জানান, মাঝে মাঝে গ্যাসের চাপ আড়াই পিএসআইতেও নেমে আসে। শীতেও ভয়ঙ্কর এই গ্যাসের সঙ্কট তৈরি হয় না। এখন যা হয়েছে। গাজীপুরের এই চিত্র সবখানের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে কোনাবাড়ী, সফিপুর, চন্দ্রা, কালিয়াকৈর, কাপাসিয়া, টঙ্গীসহ সব এলাকার শিল্প কারখানায় গ্যাসের সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এখানে বেশিরভাগ তৈরি পোশাক কারখানায় তীব্র গ্যাস সঙ্কটের মুখে উৎপাদন বিঘিœত হচ্ছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে ভয়ঙ্কর সঙ্কটে পড়তে হবে। তৈরি পোশাক মালিকরা বলছেন এভাবে চলতে থাকলে তাদের কার্যাদেশই বাতিল করতে হবে। শ্রমিকদের বেতন-ভাতাও ঠিকমতো দিতে পারবেন না। এতে শ্রম অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। তারা বলছেন, পুলিং নদীতে গত ৫ অক্টোবর পাইপলাইন বিস্ফোরণ ঘটলেও গত দুই-তিন মাস ধরেই গ্যাসের চাপ কম। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে তিতাসের কাছে সমাধান প্রত্যাশা করলেও তারা কিছু করেনি। তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজেএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছিলাম এই সঙ্কট সামাল দিতে সারকারখানা বন্ধ করে শিল্পে গ্যাস সরবরাহের। তিনি রাজিও হয়েছিলেন। একটি সারকারখানা বন্ধ হয়েছে। তবে আরও সারকারখানা বন্ধ না করলে এই সঙ্কট দূর হবে না। তিনি বলেন, আমাদের মনে হচ্ছে তিতাস এক মাসের আগে গ্যাসের লাইন ঠিক করতে পারবে না। পোশাক রফতানিকারক শিল্প মালিকরা বলছেন বছরে ২৮ বিলিয়ন ডলারে তৈরি পোশাক বিদেশের বাজারে বিক্রি করে বাংলাদেশ। এই ২৮ বিলিয়ন ডলারকে ৩৬৫ দিয়ে সরল হিসাবে করলে দৈনিকের রফতানির একটি চিত্র পাওয়া যায়। এর এক তৃতাংশ ক্ষতির আশঙ্কা করছেন তারা। হিসাব অনুযায়ী যা দৈনিক ২০৪ কোটি টাকা। মোটামুটি ৪০ দিন এই সঙ্কট বজায় থাকলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আট হাজার কোটিতে ঠেকবে। শ্রমঘন গাজীপুরে প্রায় এক হাজার ২০০ শিল্প কারখানা রয়েছে। তৈরি পোশাক ছাড়াও টেক্সটাইলসহ নানান ধরনের কারখানা রয়েছে। যার সবগুলোই জ্বালানি হিসেবে গ্যাসই ব্যবহার করে। শুধু গাজীপুর নয় গাজীপুর থেকে ঢাকা টাঙ্গাইল রোডের দুই পাশেই হাজার হাজার শিল্প কলকারখানা রয়েছে যার সবগুলোই গ্যাসের এই তীব্র সঙ্কটে ভুগছে। টেক্সটাইল মিল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ ভয়াবহ সঙ্কটময় পরিস্থিতি থেকে দ্রুত পরিত্রাণ পেতে গত বৃহস্পতিবার জরুরী বৈঠক করে। ওই বৈঠক শেষে তারা প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদকে গাজীপুরের গ্যাস পরিস্থিতি তুলে ধরে জরুরী চিঠি দেন। চিঠিতে তার সঙ্গে আলোচনা করার জন্য সময়ও চাওয়া হয়েছে। মুখ্য সচিবকে দেয়া ওই চিঠিতে বিটিএমএ পুংলি নদীর ফেটে যাওয়া গ্যাস পাইপলাইনটি মেরামত করার সব খরচ বহন করার প্রস্তাব দিয়েছে। ভয়াবহ সঙ্কটের পাশাপাশি গ্যাসের পরিবর্তে বাতাস দিয়ে শিল্প মালিকদের কাছ থেকে অর্থ হাাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির। তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি দাম বৃদ্ধির সময় তাদের যে প্রস্তাব বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে জমা দেয় তাতে দেখা যায় অন্তত ২০ ভাগ সিস্টেম গেইন হয়। অর্থাৎ পেট্রোবাংলার কাছ থেকে তিতাস যে পরিমাণ গ্যাস কেনে তার চেয়ে ২০ ভাগের বেশি বিল গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করে। সিস্টেম লসের পরিবর্তে সিস্টম গেইন হওয়ার বিষয়টিতে ব্যবসায়ীরা বারবার আপত্তি জানিয়ে আসছে। মূলত বাতাস বিক্রি করেই বছরে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয় তিতাস। শিল্প মালিকরা বলছেন যে পরিমাণ চাপ দেখানো হয় ওই পরিমাণ গ্যাস পান না তারা। চাপ বাড়াতে দেয়া বাতাসের দামও পরিশোধ করতে হয় তাদের। অবশ্য এই সঙ্কট দূর করতে বিদ্যমান মিটারের (ভলিউম্যাট্রিক) পরিবর্তে ইলেকট্রনিক ভলিউম কারেক্টটর (ইভিসি) মিটার প্রতিস্থাপন করছে তিতাস। তবে সংস্থার ছয় হাজার ৪০৪ শিল্প গ্রাহকের মধ্যে এক হাজার ২০১ জনের ইভিসি মিটার রয়েছে। বাকি সকলেই তিতাসের বায়ু বাণিজ্যের স্বীকার হচ্ছে। তিতাস বিতরণ কোম্পানির একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারের গেজেট অনুযায়ী ইভিসি মিটার সংযোজনের জন্য কারখানার একটি মানদ- নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। কারখানাগুলোতে এই মানদ- বজায় না থাকায় তারা ইভিসি সংযোজন করতে পারছেন না। কালিয়াকৈরের চন্দ্রা এলাকার দেওয়ান সিএনজি স্টেশনের স্বত্বাধিকারী দেওয়ান মোঃ রকিব উদ্দিন, একই এলাকার সীমান্ত ফলিং স্টেশনের মালিক শিকদার জহিরুল ইসলাম জয়, খাড়া জোড়া এলাকার তুরাগ ফিলিং স্টেশনের ও হিজলতলী এলাকার শিলা বৃষ্টি ফিলিং স্টেশনের স্বত্বাধিকারী বজলুর রহমান এবং গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নাওজোর এলাকার রিয়াজ ফিলিং স্টেশনের স্বত্বাধিকারী রিয়াজ আহমেদ জানান, সিএনজি স্টেশনগুলোতেও গ্যাসের চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সিএনজিচালিত যানবাহন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে চালক-যাত্রীরা চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। কখন গ্যাস থাকবে, কখন থাকবে না, তা নিয়ে ফিলিং স্টেশনের মালিকরাও চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকছেন।
×