ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিস্ফোরণের রহস্য কী?

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১৭ অক্টোবর ২০১৬

বিস্ফোরণের রহস্য কী?

আরাফাত মুন্না/মোস্তাফিজুর রহমান/নুরুল ইসলাম ॥ দুর্ঘটনার এক মাস পরও উদ্ঘাটন হয়নি গাজীপুরের টঙ্গীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় বিস্ফোরণের রহস্য। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩৯ জনের লাশ ও কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও নিখোঁজ রয়েছে একজন। গত ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরীর ওই কারখানাটিতে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে এবং ভবনটির অধিকাংশ ধসে পড়ে। বিস্ফোরণে সৃষ্ট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতেও সময় লাগে এক সপ্তাহের বেশি। প্রথমে বয়লার বিস্ফোরণ ভাবা হলেও পরে দেখা যায় ওই কারখানার দুটি বয়লারই অক্ষত। পরে গ্যাস লিকেজের ফলে বিস্ফোরণ দাবি করা হলেও গ্যাস কতৃপক্ষ বলছে, বিস্ফোরণের পরই গ্যাসলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, গ্যাসলাইনের সমস্যার কারণে বিস্ফোরণ হয়নি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ওই ভয়াবহ বিস্ফোরণ তাহলে ঘটল কিসে? এ দুর্ঘটনার তদন্তে সাতটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সবকটি রিপোর্ট এখনও জমা পড়েনি। এসব রিপোর্ট আসার পরই মূল কারণ জানা যাবে বলে বলছেন সংশ্লিষ্টরা। অগ্নিকা-ের কারণই এখন মূল রহস্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অগ্নিকা- নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। অনেকে বলছেন, কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার কারণেই এ বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকা- ঘটতে পারে। আবার ইন্স্যুরেন্সের টাকা পেতে এ দুর্ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলেও অনেকে মনে করছেন। জানা গেছে, টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরীতে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মকবুল হোসেনের মালিকানাধীন ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড কারখানায় অরক্ষিত অবস্থায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা ছিল কেমিক্যালের অন্তত ৮০টি ড্রাম। ঘটনার সময় কয়েকটি বিস্ফোরিতও হয়েছে। এ ঘটনায় নিহত ৩৯ জনের মধ্যে ৩১ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। বাকিদের পরিচয় নিশ্চিত হতে স্বজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। একজন এখনও নিখোঁজ। ঘটনার একদিন পর থেকে নিখোঁজদের সন্ধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের নেতৃত্বে ‘ফায়ার ফাইটিং এ্যা- রেস্কিউ অপারেশন’-এর মাধ্যমে ২৮ দিনব্যাপী উদ্ধারকাজ চালানো হয়। গত সোমবার উদ্ধারকাজ সমাপ্ত ঘোষণা করে সেনাবাহিনী। উদ্ধারকাজে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও পুলিশ সদস্যরা। বয়লার অক্ষত ॥ অগ্নিকা-ের শুরুতে ধারণা করা হয় বয়লার বিস্ফোরণের ফলেই অগ্নিকা-। তবে ঘটনার পরপরই বয়লার পরিদর্শক (ঢাকা অঞ্চল) মোঃ সরাফত আলী দাবি করেন, কারখানার দুটি বয়লারই অক্ষত রয়েছে। তিনি বলেন, ভবনের অধিকাংশ ধসে পড়লেও বয়লার রুম ধসে পড়েনি। তার এ বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া গেছে উদ্ধারকাজ সমাপ্ত করার পরও। গত সোমবার সেনাবাহিনী উদ্ধারকাজ সমাপ্ত ঘোষণা করার পর সরেজমিন ওই ভবনে গিয়ে দেখা যায় দুটি বয়লারই অক্ষত রয়েছে। টঙ্গীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড কারখানায় দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটিগুলো ছাড়াও বিশেষজ্ঞগণ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। বিশেষজ্ঞগণের দাবি, বয়লার বিস্ফোরণে নয়; অন্য কোন কারণে ট্যাম্পাকো কারখানায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের বয়লার পরিদর্শক ইঞ্জিনিয়ার সরাফত আলী জানান, ট্যাম্পাকো কারখানায় দুটি বয়লার রয়েছে। এগুলো আগামী ২০১৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত নবায়ন করা আছে। অগ্নিকা-ের পরও কারখানার দুটি বয়লার অক্ষত আছে। তাই বয়লার বিস্ফোরণে নয়, অন্য কোন কারণে এ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটতে পারে। তদন্তের পরই এ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে তিনি জানান। গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মোঃ আক্তারুজ্জামান জানান, ট্যাম্পাকো কারখানায় এতবড় ভয়াবহ দুর্ঘটনার উদ্ধার অভিযান শেষেও বয়লারগুলো অক্ষত রয়েছে। কারখানার বয়লার অপারেটর ইনচার্জ ইমাম উদ্দিন বলেন, কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের কোন সম্ভাবনাই নেই। আমরা বয়লার রুমে গিয়ে দেখেছি বয়লার দুটি এখনও অক্ষত আছে। গ্যাস লিকেজেও বিস্ফোরণ নয় ॥ বয়লার পরিদর্শক সরাফত আলী বয়লার বিস্ফোরণ দাবি করার পর অনেকে দাবি করেন গ্যাসলাইন বিস্ফোরণ হয়েছে। এ ধরনের দাবিও নাকচ করে দিয়েছেন তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ঢাকা মেট্রো (উত্তর) বিপণন মহাব্যবস্থাপক রানা আকবর হায়দারী। তিনি জানান, ওই কারখানায় গ্যাস লিকেজ হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সে ধরনের কোন সম্ভাবনাও পাওয়া যায়নি। গ্যাস রাইজার ও গ্যাসলাইন রয়েছে অক্ষত। তাই এটা নিশ্চিত যে, গ্যাস লিকেজ বা গ্যাস পাইপে কোন বিস্ফোরণ ঘটেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের এক কর্মকর্তা জানান, ঘটনার দিন অর্থাৎ গত ১০ সেপ্টেম্বর ওই এলাকায় বা কারখানায় গ্যাসের প্রেসার এতটাই কম ছিল যা বিস্ফোরিত হওয়ার মতো ছিল না। এ কারখানায় ট্রান্সমিশন বা হাইপ্রেসার ডিস্ট্রিবিউশন গ্যাসলাইন ছিল না। এখানে গ্যাসের সার্ভিস লাইন ছিল। ঘটনার দিন ওই এলাকায় গ্যাসের চাপ ইনলেটে ছিল ৪৫ পাউন্ড এবং আউটলেটে ছিল ২৫ পাউন্ড। সাধারণত গ্যাসলাইনে ব্যবহৃত যে থিকনেসে পাইপগুলো গ্যাসের যে পরিমাণ প্রেসার সহ্য করতে পারে সে তুলনায় বেশি থিকনেস দিয়ে পাইপগুলো তৈরী করা হয়। গ্যাসলাইনের প্রতিটি পাইপের থিকনেস শতকরা ১৮২ থেকে ৩২৬ ভাগ বেশি আছে। ফলে ঘটনার সময় যদি ৬৫ পাউন্ড প্রেসারেও গ্যাস সরবরাহ করা হতো, তবুও পাইপগুলো বিস্ফোরিত হতো না। তিনি আরও বলেন, ১০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৬টায় কারখানায় অগ্নিকা-ের খবর পেয়ে ৬টা ৪০ মিনিটে ওই এলাকার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। কাজ শেষে পূর্বের প্রেসার ঠিক রেখে শুধু এয়ারলাইন বন্ধ রেখে পরবর্তীতে পুনরায় একই স্টেশন থেকে গ্যাস সরবরাহ চালু করা হয়। যদি ওই এলাকায় লিকেজ বা গ্যাসের প্রেসার বেশি থাকত তাহলে পুনরায় গ্যাস সরবরাহ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন বাসাবাড়িতে বিস্ফোরণ বা অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটত। কিন্তু এক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি। কেমিক্যাল রাখা ছিল যত্রতত্র ॥ সূত্র জানায়, ট্যাম্পাকো কারখানার ভেতরে যেভাবে কেমিক্যাল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, সে অবস্থায় যে কোন সময় যে কোন ধরনের মারাত্মক ঘটনা ঘটতেই পারে। সূত্র আরও জানায়, ট্যাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় ব্যবহারের জন্য ইথাইল এ্যাসিটেট নামের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হতো। কারখানায় এ কেমিক্যাল ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ‘সেফটি রুল’ মানা হতো না। প্রায় ৮০টি কেমিক্যালের ড্রাম অরক্ষিত অবস্থায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা ছিল। কোন কারখানায় এ ধরনের কেমিক্যালের এতগুলো ড্রাম একসঙ্গে রাখা নিরাপদ হতে পারে না। তদন্ত কমিটির ওই সূত্রটি জানায়, খোলা স্থানে না রেখে এতগুলো কেমিক্যালের ড্রাম ভবনের ভেতরে রাখার বিষয়ে কোন আন্তর্জাতিক নিয়ম মানা হয়নি। ইথাইল এ্যাসিটেট গ্যাস বাতাসের চেয়ে প্রায় ৪০ ভাগ হাল্কা। এ কেমিক্যাল এতটাই হালকা যে, মাইনাস ৪ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রাখা হলেও এটা বাষ্পায়িত হয়ে যাবে। আর এ কারণে এ কেমিক্যাল দ্রুতগতিতে বাষ্পায়িত হয়ে বাতাসে জমা হয়। বাতাস প্রবাহিত হতে না পারলে পুরো কক্ষে বা ভবনে ওই গ্যাস জমা হয়ে মারাত্মক হয়ে ওঠে। ফলে সামান্য স্পার্কিং থেকেও সেখানে ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে। এমনকি তাপমাত্রার হেরফেরে এ কেমিক্যালভর্তি ড্রাম যে কোন মুহূর্তে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বোমায় পরিণত হয়ে বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটতে পারে বলে সূত্রটির দাবি। সূত্রটি আরও জানায়, এ জাতীয় কেমিক্যাল সাধারণত ঠা-া স্থানে রাখার নিয়ম। কিন্তু নিয়ম না মেনে ট্যাম্পাকো কারখানায় এ কেমিক্যালগুলো রাখা হয়েছিল যত্রতত্রভাবে। সূত্র জানায়, সাধারণত বাইরের চেয়ে যে কোন ভবনের ভেতরে ১০ থেকে ১৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বেশি থাকে। তাপমাত্রা বেশির কারণে ওই কেমিক্যালের ড্রাম বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটারও সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া কোন অসদুদ্দেশ্যে যদি অগ্নিকা- ঘটানো হয় তাহলে আগুনের সংস্পর্শ পেয়ে ওই কেমিক্যালের ড্রামগুলো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বোমায় পরিণত হতে পারে। ট্যাম্পাকোর ভয়াবহতা রানা প্লাজার চেয়েও অনেক বেশি ॥ সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দলের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএসএম মাহমুদ হাসান জানান, টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড কারখানাটির ভয়াবহতা রানা প্লাজার চেয়েও অনেক বেশি। এখানে রানা প্লাজার চেয়েও অনেক বেশি পরিমাণ গার্বেজ (ধ্বংসাবশেষ) জমা ছিল। এখানে ছিল ইথাইল কেমিক্যালের ড্রাম। ইথাইল ড্রামগুলো একেকটা বোমার মতো। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা ইথাইল কেমিক্যালের ড্রামগুলো বেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। সেসব ড্রামের কোনটিতে খোঁচা লাগলে তা বোমার মতো বিস্ফোরিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই এখানে বেশ ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। উল্লেখ্য, কারখানায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের ঘটনায় কারখানার মালিক বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মকবুল হেসেনকে প্রধান আসামি করে টঙ্গী মডেল থানায় এ পর্যন্ত দুটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় মকবুল হোসেনের স্ত্রীকেও আসামি করা হয়েছে। গত ১২ সেপ্টেম্বর কারখানার মালিকসহ আটজনের বিরুদ্ধে প্রথম মামলাটি দায়ের করেন নিহত শ্রমিক জুয়েলের পিতা আব্দুল কাদের। পরে ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে টঙ্গী মডেল থানার এসআই অজয় কুমার বাদী হয়ে কারখানার মালিকসহ ১০ জনকে আসামি করে দ্বিতীয় মামলাটি দায়ের করেন। দুটি মামলা দায়ের হলেও এখন পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
×