ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

‘আমৃত্যু বাংলা বর্ণমালার সেবা করে গেছেন সৈয়দ হক’

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১৬ অক্টোবর ২০১৬

‘আমৃত্যু বাংলা বর্ণমালার সেবা করে গেছেন সৈয়দ হক’

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কবিতারও রয়েছে শৈল্পিক রূপ। সেই বিবেচনায় সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় ভাস্কর্য ও স্থাপত্য তুলনাহীন। নিজেকে একুশ শতকের সন্তান পরিচয় দেয়া এই কবি কবিতায় নবজাগরণ ঘটিয়েছিলেন। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে জাতি যখন আপন অস্তিত্ব ভুলে যাচ্ছিল সেই অস্থির সময়ে কবিতার আশ্রয়ে করাঘাত করেছিলেন তিনি। লিখেছিলেন কালজয়ী কাব্যনাট্য পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। এভাবেই আমৃত্যু বাংলা বর্ণমালার সেবা করে গেছেন সৈয়দ হক। অমরত্বের স্থানটিকে স্থায়ী করে নিয়েছেন। এমনকি মৃত্যুর আগে চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও থেমে থাকেনি তাঁর সৃষ্টিশীলতা। অনুবাদ করেছেন শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট নাটক। রচনা করেছেন বেশ কিছু গান, কবিতা ও গল্প। সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হককে এভাবেই মূল্যায়ন করলেন কবি আসাদ চৌধুরী। শনিবার সকালে জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় সব্যসচী কবির স্মরণসভা। স্মরণসভায় সৈয়দ শামসুল হককে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান পুরুষ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। স্মরণের এ আয়োজনের প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। কবির বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে আলোকপাত কবি আসাদ চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই ও সাহিত্য সম্পাদক কবি মাহমুদ আল জামান। সভাপতিত্ব করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। স্মরণসভায় উপস্থিত ছিলেন সব্যসাচী লেখকের স্ত্রী কথাসাহিত্যিক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আনোয়ারা সৈয়দ হক এবং ছেলে দ্বিতীয় সৈয়দ হক। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন অভিনয় ও চিত্রশিল্পী আফজাল হোসেন। সঞ্চালনার ফাঁকে তিনি সৈয়দ শামসুল হকের ‘প্রণীত জীবন’ থেকে পাঠ করেন। অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন আবৃত্তিশিল্পী লায়লা আফরোজ। শুরুতেই সৈয়দ হককে নিয়ে নির্মিত একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয় এবং জাতীয় কবিতা পরিষদ আয়োজিত ৮০তম জন্মবার্ষিকী পালন উপলক্ষে কবির দেয়া ভাষণের অংশবিশেষ প্রদর্শন করা হয়। আসাদুজ্জামান নূর বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে কবিতা, গল্প, নাটকসহ সাহিত্যের বিচিত্র শাখাগুলোতে সৈয়দ শামসুল হকের মতো সাবলীল পদচারণা দ্বিতীয় কারও নেই। আধুনিক বাঙালী সৈয়দ হক হয়ে উঠেছিলেন এক বিশ্বমানব। অভিনয় জীবনে সৈয়দ হকের প্রভাবের কথা উল্লেখ করে সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, আমরা নাটকের মানুষরা তার কাছে ছিলাম পরিবারের সদস্যের মতো। আমরা সবাইকে তিনি দেখতেন একেকটি চরিত্র হিসেবে। তিনি যখন আমাদের নাটক দিতেন, তার আগে নিজে পুরো নাটকটি পড়ে শোনাতেন। তখন উপলব্ধি করতাম কিভাবে তিনি চরিত্রের ভেতরে ঢুকে পড়েন এবং সেই চরিত্রকে নির্মাণ করেন। মন্ত্রী বলেন, সাহিত্যের স্বাদ নিতে চাইলে হক ভাইয়ের কাছে আমাদের বারবার ফিরে আসতেই হবে। হাসনাত আবদুল হাই বলেন, ৬৫ বছরের বেশি শিল্প-সাহিত্য জীবনে অনায়াসে লিখেছেন সৈয়দ হক। শুধু লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন এবং এর বাইরে অন্য কিছুকে অবলম্বন করেননি। রবীন্দ্র-নজরুলের পরে এক অতুলনীয় লেখক হচ্ছে সৈয়দ শামসুল হক। সাহিত্য সৃজনে প্রতিষ্ঠা করেছেন স্বতন্ত্র শৈলী। ব্যাকরণসম্মত ভাষার পরিবর্তে তিনি সব সময় সৃষ্টি করতে চেয়েছেন নতুন আঙ্গিক। গদ্য নির্মাণ করেছেন নিজস্ব চিন্তার মিশেলে। ভাষাকে অতিক্রম করে গুরুত্ব ভাষাবোধের প্রতি। বাক্য গঠনের রীতি বদলানোর মতো দুরূহ কাজটি করেছেন সহজভাবে। প্রমিত ভাষার সঙ্গে সাবলীলভাবে মিশেল ঘটিয়েছেন আঞ্চলিক ভাষার। কবি মাহমুদ আল জামান বলেন, বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার বীজ বপন করেছিলেন সৈয়দ হক। ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত থেকে আপন সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি ও মুক্তিযুদ্ধকে বিশেষ স্থান শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টিতে। একইসঙ্গে তিনি অনুবাদ সাহিত্যেও ছিলেন অনন্য। শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট নাটকের তাঁর আরেক মহৎ কীর্তি। দ্বিতীয় সৈয়দ হক বলেন, বাবার মৃত্যুর পর এত স্মরণসভায় যাচ্ছি, তাঁকে দেখতে পাচ্ছি নানাভাবে। কখনও নাট্যকার, কখনও কবি, কখনও প্রাবন্ধিক হিসেবে। প্রতিবার কথা শুনি আর মনে হয় বাবা বেঁচে উঠলেন। যখন কথা শেষ হয়ে যায়, তখনই মনে হয় বাবা নেই। কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, নাক্ষত্রিক বিভায় দূরবিস্তারী সৈয়দ শামসুল হক সৃজনশীল প্রতিভায় হয়ে উঠেছিলেন এক বিরল কবি। ফুলের গন্ধের মতোই তিনি থেকে যাবেন অবিনশ্বর। উৎসবের গানে সাজানো লিলি ইসলামের সঙ্গীতসন্ধ্যা ॥ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উৎসব বিষয়ক গান অনুষ্ঠিত হলো বিশেষ সঙ্গীতসন্ধ্যা। আর গানগুলো গাইলেন কণ্ঠশিল্পী লিলি ইসলাম। পরিবেশন করেন উৎসব উপলক্ষে রচিত বিশ্বকবির বেশ কিছু গান। ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের (আইজিসিসি) আয়োজনে জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল শনিবার সন্ধ্যায় বসেছিল এই গানের আসর। আয়োজনের শুরুতেই আইজিসিসির পরিচালক জয়শ্রী কুন্ডু সদ্য প্রয়াত সাবেক সচিব ও লেখক রণজিৎ বিশ্বাস ও সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হককে স্মরণ করে বলেন, এই দুই গুণীর সঙ্গে আমাদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, দুজনই আমাদের অনুষ্ঠানে আসতেন। এ সময় এছাড়াও জয়শ্রী জানান, ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের অনুষ্ঠান এখন থেকে গুলশানের পরিবর্তে জাতীয় জাদুঘরে অনুষ্ঠিত হবে। প্রতি মাসে দুইবার জাদুঘরে দুটি সাংস্কৃতিক আয়োজন করা হবে। সঙ্গীত পরিবেশনের আগে লিলি ইসলাম বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিভিন্ন সময় শান্তি নিকেতনে কিছু উৎসব প্রতিষ্ঠা করেন এবং এসব উৎসব নিয়ে গান রচনা করেন। আজ এ ধরনের কিছু গান শোনাবো। এরপর প্রথমেই গেয়ে শোনান কবিগুরুর শারদ উৎসব সম্পর্কিত গান ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ’। গানের ফাঁকে ফাঁকে শিল্পী ব্যাখা করেন উৎসবকেন্দ্রিক গানগুলো রচনার প্রেক্ষাপট। হেমন্ত উৎসব সম্পর্কিত দ্বিতীয় গানের শিরোনাম ছিল ‘কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল’। এছাড়াও পরিবেশন করেন ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’, ‘আজি যত তারা তব আকাশে’, ‘বিশ্ববিদ্যাতীর্থ প্রাঙ্গণ’, ‘যদি ঝড়ের মেঘের মতো আমি’, ‘আজি শুভ দিনে’, ‘কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ’, ‘নিবিড় অমা তিমির হতে’, ‘ও আমার চাঁদের আলো’, ‘কী পাইনি তারই হিসাব’, ‘তুমি নব নব রূপে এসে প্রাণে’সহ বেশ কিছু উৎসব সঙ্গীত। শিশুদের শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চা বিষয়ক আলোচনা ॥ বিশ্ব শিশু দিবস উপলক্ষে শনিবার রাজধানীর শিশুকল্যাণ পরিষদ মিলনায়তনে ‘শিশু-কিশোরদের শিক্ষা ভাবনা, সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা ও আজকের বাস্তবতা’ শীর্ষক আলোচনাসভার আয়োজন করে শিশু নিকেতন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন এমিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। শিশু নিকেতনের সভাপতি সেলিনা খালেকের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মাহবুব। আরও বক্তব্য রাখেন কবি কাইয়ূম নিজামী, ডাঃ মাজহারুল মান্না, এম আজিজুল ইসলাম, নাসের ইকবাল যাদু, নূরুল করিম চৌধুরী জিন্নাহ প্রমুখ। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছেন, আমরা শিশুবান্ধব একটি মানবিক বিশ্ব চাই। শিশুদের ওপর থেকে বইয়ের বোঝা সরিয়ে ফেলতে হবে। তারা যাতে আনন্দের সঙ্গে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে, সে বিষয়ে কাজ করতে হবে। সে সঙ্গে শিশুকে পাঠ্যবই পড়ার আগে মনের আবেগকে ব্যক্ত করার সুযোগ করে দিতে হবে। এটাই হবে তার জন্য বড় শিক্ষা। অন্য বক্তারা বলেন, দেশীয় সংস্কৃতিচর্চা, নৈতিকতা, সৃজনশীলতা, মননশীলতা সর্বোপরি দেশপ্রেমের অভাবে অনেক শিশু বিপথে হাঁটছে। অধিকারবঞ্চিত শিশুরা পর্যাপ্ত সুযোগের অভাবে অকালে ঝরে যাচ্ছে। এ অবস্থা দূর করতে ছোটবেলা থেকেই শিশুদের মনে দেশপ্রেম, মানবিক মূল্যবোধ ও দেশীয় সংস্কৃতি চর্চার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
×