ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনকে প্রাধান্য দিচ্ছে

চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করে সুবিধা নিতে চায় বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ১৬ অক্টোবর ২০১৬

চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করে সুবিধা নিতে চায় বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে রাজনৈতিকভাবে সুবিধা পেতে চায় বিএনপি। এ জন্য দলটি কিছু কর্মকৌশলও হাতে নিয়েছে। এর মাধ্যমে চীনের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে ভূরাজনীতিতে যতটুকু সম্ভব অবদান রেখে দেশের রাজনীতিতে সুবিধাজনক অবস্থানে ফিরে আসতে চায় বিএনপি। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠককালে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তাঁর দলের অবস্থান তুলে ধরেছেন। আর শি জিনপিংও খালেদা জিয়াকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন বলে দলের নেতারা মনে করছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন হয় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। পরবর্তীতে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হয়েও সে সম্পর্ক অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেন। এ কারণে তিনি বেশ ক’বার চীন সফরে যান। কিন্তু বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া শেষবার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বিভিন্ন কারণে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের কিছুটা অবনতি হয়। এর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আগের চেয়ে জোরদার করার কৌশল নেয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সকল দলের অংশগ্রহণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের সহযোগিতা চেয়ে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও প্রতিবেশী প্রভাবশালী দেশ ভারত আওয়ামী লীগের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ায় বিএনপি বেকায়দায় পড়ে। এক পর্যায়ে বিএনপি চীনের সহযোগিতা পাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু চীন এ বিষয়ে কারও পক্ষে-বিপক্ষে সহযোগিতার হাত না বাড়িয়ে নীরব থাকে। এ পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় বিএনপিকে ছাড়াই আওয়ামী লীগ সমমনা দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচন করে ফেলে এবং সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনায় নিয়োজিত হয়। কিন্তু সরকার পতনের লক্ষ্যে টানা ৯২ দিন সহিংস আন্দোলন করেও সফল হতে না পেরে ক্ষমতা থেকে অনেকদূরে চলে যায় বিএনপি। এদিকে আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়াসহ সামনে এগিয়ে যাওয়ার সব পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিএনপি নির্দলীয় পরিবেশে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার লক্ষ্যে আবারও নতুন করে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব ও ভারতের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোন সহযোগিতার আশ্বাস না পেয়ে চীনের সহযোগিতা চায় বিএনপি। কিন্তু ভারতকে পাশ কাটিয়ে চীনকে দিয়ে সুবিধা আদায় করা এত সহজ নয় সেটিও মাথায় রাখে বিএনপি হাইকমন্ড। এ জন্যই ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের বিষয়টিকে প্রধান্য দেয় বিএনপি। সূত্রমতে, বিএনপি হাইকমান্ড মনে করছে ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে এ অঞ্চলে ভারতের প্রভাব অব্যাহত থাকলে আওয়ামী লীগ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। তবে চীনকে দিয়ে যদি ভারতের ওপর প্রভাব বিস্তার করে বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে বিএনপি লাভবান হবে। সে ক্ষেত্রে পরবর্তীতে বিএনপি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কিছুটা পরিবর্তন ঘটিয়ে আবারও ক্ষমতায় যেতে পারবে। চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ৪০ মিনিটব্যাপী বৈঠককালে খালেদা জিয়া এ বিষয়টি মাথায় রেখেই যাবতীয় আলাপ-আলোচনা করেছেন। এ অঞ্চলে ভারতের প্রভাব অক্ষুণœ থাকলে বিএনপি যে রাজনৈতিকভাবে সুবিধা করতে পারবে না তা সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য থেকেই বোঝা গেছে। দলীয় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, বিএনপি ভূরাজনীতির শিকার। আর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠককালেও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াও চীনের মাধ্যমে ভূরাজনীতির পরিবর্তন চেয়েছেন। আর খালেদা জিয়ার এ চাওয়াকে চীনও ইতিবাচক হিসেবেই নিয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে বৈঠক না করলেও বিরোধী দলে না থাকা সত্ত্বেও বিরোধী দলের মর্যাদায় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করতে পেরে বিএনপি কিছুটা উৎফুল্ল হয়েছে। দলের নেতাদের বক্তব্যেও এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে। শনিবার এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশের বিরোধী দলকে গুরুত্ব না দিয়ে খালেদা জিয়াকে সাক্ষাত দিয়ে জনগণের উদ্দেশে একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন বলে মনে করছে বিএনপি। তিনি বলেন, চীন বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্বে বিশ্বাস করে। কোন দেশের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে এলে সরকারী ও বিরোধী দলের সঙ্গে কথা বলেন। আর সেই বিরোধী দলকে স্বীকৃতি দেয় যারা সংসদে থাকে। কিন্তু চীনা প্রেসিডেন্ট রওশন এরশাদের সঙ্গে বৈঠক না করে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পরিষ্কারভাবে এদেশের জনগণকে চীনের প্রেসিডেন্ট এই বার্তা দিয়ে গেলেন যে, দশম জাতীয় সংসদ যেহেতু নির্বাচিত সংসদ নয় তাই এই সংসদে জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি বা বিরোধী দল নেই। সেজন্যই জাতীয় সংসদের বিরোধী দলকে চীনের প্রেসিডেন্ট কোন গুরুত্ব দিলেন না। অতত্রব এটাও আমরা মনে করি যে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এ দেশের জনগণের জন্য একটি ইশারা দিয়ে গেছেন। সেই সঙ্গে তিনি সরকারকেও পরিকল্পিতভাবে মেসেজ দিয়ে গেছেন। সেই কারণে চীনের প্রেসিডেন্টের এ সফর ভূ-আঞ্চলিক রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ। আরেক অনুষ্ঠানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বৈঠককে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেন। সেই সঙ্গে চীনের সঙ্গে করা চুক্তিগুলোকেও তিনি ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেন। তবে ভারত ও বাংলাদেশের সার্ক সম্মেলন বর্জনের বিষয়টিকে তিনি কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আমাদের দলের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়াও বিএনপি ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানের আমলেই প্রথম চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের উন্নয়ন হয়। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন অব্যাহত রাখেন। তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে ও বিরোধী দলের নেতা থাকার সময়ও বার বার চীন সফরে গিয়েছেন। এবার চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠককালেও বিএনপির সঙ্গে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আরও সম্পর্ক বৃদ্ধির বিষয়ে খালেদা জিয়া কথা বলেছেন। চীন গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করলে সেখানে বাংলাদেশের অধিকতর নিরাপত্তার বিষয়টি যেন নিশ্চিত করা হয় এ নিয়েও চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা হয়। এ ছাড়াও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া শি জিনপিংয়ের সঙ্গে আরও কথা বলেছেন যা আমি সব শুনিনি। আমি আশা করছি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও বিএনপি উপকৃত হবে।
×