ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফসলের হেমন্ত এসেছে

হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধূমল রঙে আঁকা...

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ১৬ অক্টোবর ২০১৬

হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধূমল রঙে আঁকা...

মোরসালিন মিজান ॥ শীতের এখনও বাকি। অনেক বাকি। তবে শীত শীত ব্যাপারটা শুরু হয়ে গেছে। একটু রাত হলে অনুভব করা যায়। ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠলে তো চোখের সামনে। দৃশ্যমান। সবুজ পাতার ওপর ঘন হয়ে থাকা শিশির বিন্দু মনে করিয়ে দেয় পরিবর্তন এসেছে প্রকৃতিতে। আরও একটি পরিবর্তন। এবার হেমন্ত। আজ রবিবার ১ কার্তিক, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ। প্রিয় ঋতু শুরুর দিন। কবির ভাষায়Ñ সবুজ পাতার খামের ভেতর/হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/কোন্ পাথারের ওপার থেকে/আনল ডেকে হেমন্তকে...। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে কার্তিক অগ্রহায়ণÑ দুই মাস হেমন্ত কাল। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের ঋতু বাঙালীর ভীষণ প্রিয়। এই ঋতু চারপাশের প্রকৃতিকে যেমন নবরূপ দান করে, তেমনি রাঙিয়ে দিয়ে যায় মানুষের মন। হেমন্তের রূপ বর্ণনা করে কবিগুরু তাই লিখেছিলেনÑ হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকাÑ/ হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধুমল রঙে আঁকা।/ সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে,/ কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা।/ ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।/ দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে...। এক সময় হেমন্তের প্রথম মাসটি ছিল অনটনের। ফসল হতো না। বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা দিত। রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ও আভাস পাওয়া যায় সময়টির। কবিগুরু লিখেছেনÑ ‘শূন্য এখন ফুলের বাগান, দোয়েল কোকিল গাহে না গান,/কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে।’ এসব কারণে কার্তিকের দুর্নাম করে বলা হতো ‘মরা কার্তিক’। তবে দ্বিতীয় মাস অগ্রহায়ণে আবার উল্টো চিত্র। এই মাস সমৃদ্ধির। এ সময় মাঠের সোনালী ফসল কাটা শুরু হয়। দেখতে দেখতে গোলা ভরে ওঠে কৃষকের। এভাবে দুটি বিপরীত সময়কে একসূত্রে গাঁথার কাজ করত হেমন্ত। এখন অন্য বাস্তবতা। আগের মতো অভাব নেই। শস্যের বহুমুখীকরণের ফলে মোটামুটি সারা বছরই ব্যস্ত কৃষক। বিভিন্ন ফসল ফলান তারা। কার্তিক মাসে রিষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শীষ। পাকা ধান কাটা শুরু হয়ে যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এবারও আসতে না আসতেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ধান কাটার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। উত্তরাঞ্চল থেকে ফসল কাটা ও মারাইয়ের খবর আসছে। বগুড়া, রংপুর, নীলফামারীসহ বিভিন্ন জেলার কৃষকরা নতুন ফসল ঘরে তোলার কাজে ব্যস্ত। দিনভর চলছে ধান কাটা। ফসল কাঁধে অদ্ভুত ছন্দ তুলে সরু আইল মেঠো পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফিরছেন কৃষক। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষমাণ কৃষাণী। ধান মাড়াই, শুকিয়ে ঘরে তোলার দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় খুশি মনেই অংশ নিচ্ছেন। রাজধানী শহরে বসেও দৃশ্যটা কল্পনা করা যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে। হেমন্তের দ্বিতীয় মাস অগ্রহায়ণের প্রধান বৈশিষ্ট্য নবান্ন উৎসব। বাঙালীর প্রধান ও প্রাচীনতম উৎসবগুলোর অন্যতম নবান্ন। অগ্রহায়ণে আমন ধান কাটা শুরু হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফসল উৎপাদনের সময় এটি। প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টন আমন উৎপাদন হয় এ সময়। নতুন ধানে চলে নবান্ন উৎসব। আমন ধানের চালে প্রথম রান্না হয়। এ উপলক্ষে চলে আনন্দঘন উদ্যাপন। কোন কোন অঞ্চলে ফসল কাটার আগে বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখা হয়। বাকি অংশ চাল করে সে চালে চলে পায়েস রান্না। শুধু গ্রামে নয়, এখন শহরেও থাকে নানা আয়োজন। গ্রামের মতো না হলেও প্রতিবছর ১ অগ্রহায়ণ রাজধানী ঢাকায় প্রতীকী উৎসবের আয়োজন করা হয়। গোলাভরা ফসল আর আনন্দঘন উৎসব আনুষ্ঠানের বার্তা নিয়ে আসা হেমন্তকে তাই হেমন্তলক্ষ্মীও বলা হয়।
×