ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

টঙ্গী এলাকার দেড় হাজার একর জমি প্রভাবশালীদের দখলে;###;অবৈধ বালুর ব্যবসা, ইমারত, সমবায় সমিতি, শিক্ষা ও শিল্পকারখানার স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে;###;ভুল সীমানার খুঁটি আর অনিয়মে ক্ষমতাসীনদের কালো হাত

একদার প্রমত্ত তুরাগ এখন সরু খাল, সর্বত্র শকুনির থাবা ॥ অপ্রতিরোধ্য দখলবাজি

প্রকাশিত: ০৫:১১, ১৬ অক্টোবর ২০১৬

একদার প্রমত্ত তুরাগ এখন সরু খাল, সর্বত্র শকুনির থাবা ॥ অপ্রতিরোধ্য দখলবাজি

শাহীন রহমান ॥ অপ্রতিরোধ্য দখলের মহোৎসব চলছে রাজধানীর পশ্চিম ও উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তুরাগের বুকজুড়ে। দখলের শিকার হয়ে এক সময়ের প্রমত্ত তুরাগ এখন মৃত খালে রূপ নিয়েছে। এরপরও দখলের থাবা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর বছিলা থেকে শুরু করে মিরপুর বেড়িবাঁধ, আশুলিয়া থেকে টঙ্গী পর্যন্ত সর্বত্রই রয়েছে তুরাগ দখলের শকুনির থাবার আঁচড়। তবে বেশিরভাগ এলাকা দখল করে চলছে বালু ব্যবসায়ীরা। এছাড়া মাটি ভরাট করে নদীরপাড় দখল, বালু ফেলে ভরাট, নদী তীরবর্তী জায়গা দখল করে শিল্প-প্রতিষ্ঠানসহ কাঁচা-পাকা সব ধরনের দখলবাজি তো রয়েছেই। অবশ্য নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, নদী দখলের তালিকা করে এ বছরের মধ্যে বড় বড় স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়া হবে। এছাড়া নদী দূষণমুক্ত করতে একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। কাজও শুরু করা হয়েছে। এমনকি নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে লন্ডনের টেমস নদীর আদি ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে। সরেজমিন তুরাগের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দখলের বৈধতা দেয়া হয়েছে ভুলভাবে পিলার স্থাপনের মধ্য দিয়ে। এভাবে পিলার স্থাপনের ফলে তুরাগের হাজার হাজার একর জমি দখলদারদের কবলে চলে গেছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে পিলার দিয়ে যে সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে তাও কেউ মানতে চায় না। বালু ও মাটি ফেলে পিলার পর্যন্ত ঢেকে দেয়া হয়েছে। গাবতলীর দু’পাশে তুরাগে দু’পাড় বাঁধাÑ এ অংশে দখল তুলনামূলক অনেকটা কম। তবে এ অংশ বাদ দিলে বছিলা, মিরপুর বেড়িবাঁধ অংশ থেকে বিরুলিয়া ব্রিজ, বিরুলিয়া থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত বেশিরভাগ বালু ফেলে ভরাট করা হয়েছে। এ অংশে নদী দখল করে বালুর ব্যবসা যেমন চলছে, আবার বালু ফেলে পাড় দখল করে দখলের বৈধতা দেয়া হয়েছে। এছাড়া একাধিক স্থানে শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। আশুলিয়া থেকে টঙ্গী পর্যন্ত দখলের নানান চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। সরেজমিন দেখা গেছে, এই এলাকায় নদীর সীমানার ভেতরে গড়ে উঠেছে অট্টালিকা, সমবায় সমিতি, মার্কেট, শিক্ষা ও শিল্প-প্রতিষ্ঠান। পরিবেশবিদদের মতে, নদীর সীমানা খুঁটি স্থাপনে ভুল ও অনিয়মের কারণে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের টঙ্গী অঞ্চলে তুরাগ নদের প্রায় দেড় হাজার একর জমি প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে। সীমানার দুই শ’ গজের মধ্যে কোন স্থাপনা তৈরি না করার নিয়ম থাকলেও তুরাগের দুই তীরে ডায়িং কারখানা, হাউজিং প্রতিষ্ঠান, প্রস্তাবিত মেডিক্যাল কলেজ ও বিভিন্ন সংগঠনের নামে তীরবর্তী জায়গা দখলে নিয়ে জায়েজ করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় প্রশাসনের নাকের ডগায় দিনে-রাতে সমানে চলছে এ দখলবাজি। তবে এলাকাবাসী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব দখলের সঙ্গে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনরা জড়িত। তাদের ছত্রছায়ায় প্রতিনিয়ত চলছে দখলের কাজ। অথচ কারও প্রতিবাদ করার সাহস পর্যন্ত নেই। মিরপুর বেড়িবাঁধ অংশে নবাবেরচর এলাকায় নদী থেকে বালু উত্তোলন করে পাড় দখল করে চলছে অবৈধ বালুর ব্যবসা। নবাবেরবাগ এলাকার ১০ থেকে ২০ অংশে এসব জায়গায় প্রকাশ্যে বালু তুলে ব্যবসা করা হচ্ছে। স্থানীয় এক বাসিন্দা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, এখানে বালুর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। বিশেষ করে স্থানীয় এমপির কাছের লোকজন বালু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এছাড়া নবাবেরবাগ এলাকায় যে অংশ দিয়ে তুরাগের শাখা খাল বয়ে গেছে তাও দখল করে একাধিক পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। এলাকাবাসী দাবি করেছেন, নদীর জায়গায় লিজ নিয়ে খাল বন্ধ করে পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। এসব পার্ক স্থাপনের সঙ্গে স্থানীয় এমপির আত্মীয়স্বজনও রয়েছেন। নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার চার নদ-নদীর মধ্যে তুরাগের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। পাড়ে বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা গড়ে তুলে এটিকে এমনভাবে দখল করা হয়েছে, যা পরিণত হয়েছে সরু খালে। তারা অভিযোগ করে বলেন, নদীর সীমানা নির্ধারণেও যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে না। টঙ্গী ব্রিজ থেকে আশুলিয়া হয়ে মিরপুর পর্যন্ত বেশ কিছু স্থানে নদীরপাড় থেকেও ৭-১০ মিটার ভেতরে সীমানা পিলার স্থাপন করা হয়েছে, যা বেআইনী। মূলত রাজনৈতিক কৌশলে এসব নদী দখল করা হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে মিরপুর বেড়িবাঁধ অংশে তুরাগে দখল এবং বালুর ব্যবসা বন্ধে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেছে, বর্তমানে বেড়িবাঁধের একটি অংশেও কাঁটাতারের বেড়া নেই। সবই চলে গেছে বালু ব্যবসায়ীদের দখলে। পাড় দখল করে নদী থেকে বালু তুলে অপ্রতিরোধ্য আগ্রাসন চালানো হচ্ছে তুরাগের বুকে। এছাড়াও তুরাগের বছিলা অংশে রায়েরবাজার বউবাজার খাল ও সংলগ্ন নদীতে চলছে অবৈধ দখল ভরাট। মেট্রো হাউজিং, শিকদার গ্রুপসহ অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালী মহল প্রতিনিয়ত দখল করে চলেছে নদীতে। রায়েরবাজার সংলগ্ন বালুরমাঠ এলাকায় ইতোমধ্যেই ভরাট করে ফেলা হয়েছে নদী সংযোগকারী খাল। এসব এলাকায় নদীর সীমানা নির্ধারণী পিলার অমান্য করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য আবাসিক ব্যবসায়িক ভবন ও কল-কারখানা। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেছেন, পিলার বসানোর ভুলেই মূলত তুরাগ দখলকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। বৈধতা পেয়েছে দখলদাররা। পাড় দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে হাজারও স্থাপনা। দখল এখনও চলছে। দখল করা হয়েছে বিনোদন পার্কের নামে। গড়ে তোলা হয়েছে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বসতি, শিল্প-কারখানাসহ নানান স্থাপনা। পিলারের সীমার ভেতরে যেমন দখল করা হয়েছে, তেমনি পিলার থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেও চলছে দখল। অথচ পরিবেশবিদরা বলছেন, ভুল পিলার স্থাপনের কারণে দখল হয়ে গেছে কোটি বর্গফুট আয়তনের নদীর জমি। আদালত সঠিক স্থানে পিলার বসানোর জন্য নির্দেশনা দিলেও তা কার্যকর হয়নি। যদিও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, ঢাকার চারপাশের নদী দখল করে গড়ে ওঠা বড় স্থাপনাগুলো এ বছরই গুঁড়িয়ে দেয়া হবে। নদী দূষণমুক্ত করতেও নতুন প্রকল্পের প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, যে হারে দখল হয় দখলদার উচ্ছেদ করার সক্ষমতাও সরকারের রয়েছে। সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সরকার কাজ করছে। এ বছরের মধ্যেই বড় বড় স্থাপনাগুলো গুঁড়িয়ে দেয়া হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, নদী দখলমুক্ত করতে সরকারের আন্তরিকতার কোন ঘাটতি নেই। ইতোমধ্যে নদী দখল করে গড়ে তোলা শত কোটি টাকার ব্যবসাও গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ধলেশ্বরী দখলদার দ্বীন ফার্নিচার নামে শত কোটি টাকার একটি আসবাবপত্রের কারখানা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। নদী দখলমুক্ত করতে বিআইডব্লিউটিএর ওপর চূড়ান্ত তালিকা করতে দেয়া হয়েছে। তাদের কর্মকর্তারা তালিকা করছেন। অবশ্য পরিবেশবিদরা বলছেন, বিভিন্ন সময় দখল-উচ্ছেদ ও পুনরুদ্ধারের নামে হঠাৎ হঠাৎ চলে কর্তৃপক্ষের প্রহসন। এতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাধারণ অসচেতন দুর্বল মানুষদের ব্যাপক হয়রানি করা হয়। কিন্তু বড় বড় দখলদার পাশে থাকলেও তাদের কিছুই হয় না। অধিকাংশ উচ্ছেদ অভিযানে থাকে না কোন সমন্বিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি। ফলে দখল মুক্তকরণের নামে ভাঙ্গা ভবন কিংবা ভরাটকৃত মাটি ও বালু আবারও নদীতে ফেলে দিয়ে বরং নদীর বেশি ক্ষতি করা হয়। সৈয়দ আবুল মকসুদ এ বিষয়ে বলেন, নদী দখলের সঙ্গে যুক্ত ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা রয়েছেন। এখন সরকারী প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলো নদীর পাড়ে স্থাপনা গড়ে তুলছে। তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গা ও আশপাশের উপনদীগুলো রক্ষার জন্য বুড়িগঙ্গা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করা প্রয়োজন। তাদের কাজ হবে নিয়মিত মনিটরিং। নদী কতটা দখল হলো, আর কতটা দখলমুক্ত হলোÑ এ বিষয়ে মাসিক প্রতিবেদন পেশ করা।
×