ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

পলাতক গৃহকর্মী ও তার লন্ডন প্রবাসী খালাত ভাই জড়িত থাকতে পারে ॥ চুরির ঘটনা সাজানো

সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:১১, ১৬ অক্টোবর ২০১৬

সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ওয়াজি আহমেদ চৌধুরী পরিকল্পিত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন। আক্রোশের সূত্র ধরে অত্যন্ত ঠা-া মাথায় নৃশংসভাবে হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটানো হয়। হত্যার পর পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতেই চুরির নাটক সাজানো হয়েছে। নিহতের পরিবারের দাবি, এমন পরিকল্পনার সঙ্গে মামলার এজাহারনামীয় একমাত্র আসামি গৃহকর্মী পলাতক আব্দুল আহাদ, তার লন্ডন প্রবাসী খালাত ভাই আব্দুল হক, নিহতের বাড়ির দুই গৃহপরিচারিকা ছাড়াও আরও কেউ জড়িত থাকতে পারে। কারণ ঘটনার সময় হত্যাকা-ের শিকার হওয়া সেনা কর্মকর্তা ও তার একমাত্র ছেলে যার যার রুমে ঘুমিয়ে ছিলেন। সত্যিই চুরির ঘটনা হলে, অনায়াসে চুরি করে পালানো সম্ভব ছিল। কাউকে হত্যা করে চুরি করার কোন প্রয়োজনই ছিল না। সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর কাফরুল থানাধীন মহাখালী ডিওএইচএস-এর পার্ক লাগোয়া ৪ নম্বর সড়কের ১৪৮ নম্বর বাড়িটি নিহত ওয়াজি আহমেদ চৌধুরীর (৭৬)। পুরনো ধাঁচের সাদা রঙের বাড়িটি চার তলা। রাস্তা লাগোয়া বাড়িটিতে ঢুকতেই পর পর দুটি গেট। নিচতলার বাম দিকে গাড়িবারান্দা। তার লাগোয়া একটি ফ্ল্যাট। এরপরই আরেকটি গেট। সেখান দিয়ে বাড়ির মূল সিঁড়িটি উঠে গেছে। নিচতলা, তৃতীয় তলা ও চতুর্থ তলা ভাড়া দেয়া। নিহত সেনা কর্মকর্তা ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান। বছর ছয়েক আগে স্ত্রী আতিয়া চৌধুরীর মৃত্যু হয়। বড় ছেলে নাবিদ আহমেদ চৌধুরী (৪৪) প্রায় এক দশক ধরে আমেরিকায় বসবাস করছেন। বাড়িটির দ্বিতীয় তলায় একমাত্র ছেলে বাকপ্রতিবন্ধী ফুয়াদ আহমেদ চৌধুরীকে (৪০) নিয়ে দিব্যি সুখেই বসবাস করছিলেন এই অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। কিন্তু গত ৬ অক্টোবর সব কিছুই উল্টে গেল। ফুয়াদ আহমেদ চৌধুরীর সাংকেতিক ভাষায় দেয়া বর্ণনার সূত্র ধরে নিহতের ভাতিজা রেশাদ আহমেদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে জানান, চাচা ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন। নামাজ আদায় করেই হাঁটতে বেরুতেন। হাঁটার পর বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে ঘুমিয়ে যেতেন। ফুয়াদ আগাগোড়াই দুপুর বারোটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠত। গত ৬ অক্টোবর দুপুর বারোটার দিকে ঘুম থেকে উঠে ফুয়াদ। উঠেই দরজা খুলতে যায়। বুঝতে পারে দরজা বাইরে থেকে লাগানো। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করে কারো কোন সাড়া-শব্দ নেই। এরপর জোরে জোরে দরজায় কয়েকটি লাথি মারে। তাতেও দরজা খুলে না। দরজা ভাঙ্গতে ব্যর্থ হয়ে সে বাসার বারান্দার দরজা খুলে। দরজা খুলে সানশেডের ওপর নামে। সেখান থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে। এরপর নিচতলায় থাকা দুই আদিবাসী যুবক সি কে মারমা ও সেন্ট্রাল মারমাকে বিষয়টি জানায়। তারা ফুয়াদের সঙ্গে গিয়ে ফ্ল্যাটের দরজার তালা ভাঙ্গেন। এরপর ভেতরের একবারে পশ্চিম দিকের একটি রুমেও তালা দেখতে পায়। সেই রুম থেকেই ফুয়াদের পিতাকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরে তাকে ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থিত সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ফুয়াদ বিষয়টি পরিবারের অন্য সদস্য ও স্বজনদের জানায়। পরে পুলিশ ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠায়। ঘটনার সময় ফুয়াদদের বাসায় রুসানা ও মাজেদা নামের দুই গৃহপরিচারিকা এবং আব্দুল আহাদ (৩৫) ছিল। কিন্তু লাশ উদ্ধারের সময় তাদের কেউ বাসায় ছিল না। এ তিনজন গৃহকর্মচারী দীর্ঘদিন ধরেই বাড়িতে কাজ করছিল। দুই গৃহপরিচারিকার বয়স এখন পঞ্চাশের বেশি। রেশাদ আহমেদ চৌধুরী আরও জানান, এটি পরিকল্পিত হত্যাকা-। কারণ চাচাকে হত্যার জন্যই রশি দিয়ে হাত পা বাঁধা হয়েছে। ঘটনার সময় তার চাচা ও চাচাত ভাই ফুয়াদ ঘুমিয়ে ছিল। অনায়াসে গৃহকর্মী আব্দুল আহাদ চুরি করে পালিয়ে যেত পারত। কিন্তু সেটি না করে চাচাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। আর হত্যার পর বাড়ি থেকে জিনিসপত্র চুরি করে। মূলত মামলাটির তদন্ত ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতেই এমন নাটক সাজানো হয়েছে। যা একেবারেই স্পষ্ট। ফুয়াদ বাকপ্রতিবন্ধী হওয়ায় তিনিই বাদী হয়ে গত ৭ অক্টোবর রাজধানীর কাফরুল থানায় গৃহকর্মী আব্দুল আহাদকে এজাহারনামীয় একমাত্র আসামি করে এবং অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে মামলাটি দায়ের করেন। মহাখালী ডিওএইচএসের লেক লাগোয়া ১৯ নম্বর সড়কের ২৬৮ নম্বর ওয়াজি আহমেদের বাড়ির পাশের নিজ বাড়িতে বসবাস করছেন তারই সহোদর ছোট ভাই বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এজাজ আহমেদ চৌধুরী। বাড়িতে বসেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, তাদের পিতার নাম মোঃ আহম্মদ চৌধুরী। তাঁরা চার ভাই পাঁচ বোন। ভাইদের মধ্যে ওয়াজিসহ তারা দুই ভাই বেঁচে ছিলেন। বড় ভাই ওয়াজিও শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন। এক বোনের মৃত্যু হয়েছে। বাড়ি সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানাধীন ফুলবাড়ি গ্রামে। হত্যাকা-ের বিষয়ে তিনি বলেন, বড় ভাই পরিকল্পিত হত্যাকা-ের শিকার তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ ভাই ও ভাতিজা ঘুমিয়ে ছিল। অনায়াসে আব্দুল আহাদ বাড়ির জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যেতে পারত। কিন্তু সেটি করেনি। ভাইকে হত্যা করে বাড়ি থেকে মালামাল চুরি করে পালায়। মূলত ঘটনাটি ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতেই এটি পরিকল্পিতভাবে করা হয়। এর পেছনে আসল রহস্য কি তা আসামি আব্দুল আহাদ গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। তবে বিশেষ কোন আক্রোশ থেকে ভাইকে যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। যা একেবারেই পূর্ব পরিকল্পিত। তিনি আরও জানান, এত বিশ্বাসী লোক হয়ে এবং এমন একটি নিরাপদ জায়গায় এ ধরনের হত্যাকা- সত্যিই অবাক করার মতো বিষয়। আব্দুল আহাদ নিঃসন্দেহে বিশ্বাসী লোক ছিল। আহাদের বাড়ি সিলেটেরই বিশ্বনাথ উপজেলায়। আহাদের খালাত ভাই আব্দুল হক দশ বছর আগে ওয়াজির বাড়িতে দশ বছর কাজ করেছে। এরপর আমরা আব্দুল হকের ওপর খুশি হয়ে তাকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেই। তার ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। পরিবার পরিজন নিয়ে আব্দুল হক সুখে শান্তিতে রয়েছে। আব্দুল হক চলে যাওয়ার পর তারই আপন খালাত ভাই আব্দুল আহাদকে ওয়াজির বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে দিয়ে যায়। প্রথম দফায় প্রায় তিন বছর একনাগাড়ে কাজ করে। আহাদ বিবাহিত। ওর পরিবার সিলেটের বিশ্বনাথের গ্রামের বাড়িতে থাকে। তিন বছর কাজ করার পর আহাদ চলে যায়। মাস দুয়েক আগে আবার কাজের জন্য আসে। চাকরি তার খুব প্রয়োজন বলে কাকুতি মিনতি করে। এরপর লন্ডনে থাকা আব্দুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। আব্দুল হকও আহাদকে কাজ দেয়ার জন্য বলে। এরপর যথারীতি আহাদ আবার কাজে যোগ দেয়। তা প্রায় দুই মাস ধরে আহাদ কাজ করছিল। বড় ভাইকে হত্যার পর ধারণা করা হচ্ছে, আহাদ অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ভাইয়ের বাসায় কাজ নিয়েছিল। তার উদ্দেশ্যই ছিল ভাইকে হত্যা করা। কারণ যেভাবে রশি দিয়ে বেঁধে হত্যা করা হয়েছে, তাতে স্পষ্টই বোঝা যায়, এটি পরিকল্পিত হত্যাকা-। আর হত্যাকা-ের ধরন দেখে মনে হচ্ছে, আক্রোশ থেকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তবে ভাইয়ের ওপর আব্দুল আহাদের আক্রোশ থাকার তেমন কোন কারণ তার জানা নেই। আর চুরির ঘটনাটি নিছক সাজানো। ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতেই চুরির নাটক সাজানো হয়েছে। এমন হত্যাকা-ের পেছনে আহাদ ছাড়াও আরও কেউ জড়িত থাকতে পারে। কেউ আহাদকে দিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটিয়ে থাকতে পারে। এদিকে কাফরুল থানা পুলিশ জানায়, উদ্ধারকালে লাশের গলায় কালো দাগ এবং বুকের বাঁ পাশে আর ডান পায়ের গোড়ালিতে আঘাতের চিহ্ন ছিল। গত ৭ অক্টোবর ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ সোহেল মাহমুদ জানান, ওয়াজি আহমেদ চৌধুরীর গলায় রশি পেঁচিয়ে পা বেঁধে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে আলামত পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে কাফরুল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আসলাম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, এজাহারনামীয় একমাত্র আসামি আব্দুল আহাদকে গ্রেফতার করতে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত আছে। তাকে গ্রেফতার করতে পারলেই ঘটনার প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসবে। মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা কাফরুল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আসলাম উদ্দিন জনকণ্ঠকে জানান, এজাহারনামীয় একমাত্র আসামি আব্দুল আহাদকে গ্রেফতার করতে তাদের গ্রামের বাড়ি, পরিচিতজনসহ আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতেও খোঁজখবর এবং অভিযান চালানো হচ্ছে। আহাদকে গ্রেফতার করতে পারলেই ঘটনার প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসবে।
×