ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গর্ভের সন্তানসহ জীবন গেল ৫ জনের

দুর্ঘটনা না হত্যা ॥ এ্যাম্বুলেন্স উঠিয়ে দিয়ে

প্রকাশিত: ০৫:১০, ১৬ অক্টোবর ২০১৬

দুর্ঘটনা না হত্যা ॥ এ্যাম্বুলেন্স উঠিয়ে দিয়ে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জীবন বাঁচাতে এসে এ্যাম্বুলেন্সের ধাক্কায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে জীবন দিতে হলো গর্ভে থাকা ছয় মাসের এক সন্তানসহ মা ও সাত বছর বয়সী অসুস্থ পুত্রসন্তানসহ আরেক মা এবং এক ভিক্ষুককে। সব মিলিয়ে এ্যাম্বুলেন্সের ধাক্কায় পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। স্মরণকালের ইতিহাসে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এটিই প্রথম ঘটনা। যে এ্যাম্বুলেন্সটি মানুষজনদের চাপা দেয়, তার ভেতর কেউ ছিল না। চালক নয়, হেলপার এ্যাম্বুলেন্সটি চালাচ্ছিল। ফাঁকা এ্যাম্বুলেন্সটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা নারী-শিশুদের ওপর তুলে দিলে মর্মান্তিক এ ঘটনাটি ঘটে। এ্যাম্বুলেন্সের ধাক্কায় আহত হয়েছে এক শিশুসহ বেশ কয়েকজন। খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। মন্ত্রী আহতদের চিকিৎসাসহ আনুষঙ্গিক সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে দোষী চালককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার কথা জানিয়েছেন। এমন ঘটনায় হাসপাতালজুড়ে রীতিমতো শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ভয়ে হাসপাতালের সামনে থাকা এ্যাম্বুলেন্সের চালকরা গাড়ি রেখেই পালিয়ে গেছে। এতে বিপাকে পড়েছেন রোগীসহ অনেকেই। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছিলেন, প্রতিদিনের মতো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সামনে যার যার কাজে ব্যস্ত ছিল চিকিৎসা নিতে আসা নানান বয়সী নারী-পুরুষ ও শিশু। কেউবা ওষুধের জন্য ছুটছেন আবার কেউবা সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ি ফিরছিলেন। শনিবার সকাল সোয়া নয়টার দিকে হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সামনে বিকট শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। সেই সঙ্গে চিৎকার। আর গগনবিদারী আর্তনাদ। সঙ্গে সঙ্গে শত শত লোক সেখানে জড়ো হয়। সেখানে সিলেট মেট্রো-হ-৭১-০০৬৪০ নম্বরের মানব সেবা নামের একটি এ্যাম্বুলেন্স নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হাসপাতালের প্রবেশমুখে চিকিৎসা নিতে আসা মানুষজনের ওপর তুলে দেয়। জনতা সঙ্গে সঙ্গে এ্যাম্বুলেন্সের চালক সোহেল (২৪) ও এ্যাম্বুলেন্সটিকে আটক করে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করে। এ্যাম্বুলেন্সের চাকায় পিষ্ট হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় মায়ের হাত ধরে থাকা হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসা মোঃ শাকিব (৭)। শাকিবের সঙ্গে সেখানেই অজ্ঞাত (৬০) এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে ওই বৃদ্ধ ভিক্ষুক বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে পুলিশ। ধাক্কায় গুরুতর আহত হন শাকিবের মা গুলেনুর বেগম (২৫)। বিকেল তিনটায় চিকিৎসাধীন অবস্থায়ই হাসপাতালটিতে গুলেনুর বেগমের মৃত্যু হয়। তিনি ছেলে শাকিবকে চিকিৎসা করাতে শুক্রবার পটুয়াখালী থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। উঠেছিলেন রাজধানীর রায়েরবাগের এক আত্মীয়ের বাসায়। শনিবার সকালে স্বামীসহ রিক্সাযোগে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছেলেকে চিকিৎসা করাতে এসেছিলেন। রিক্সা থেকে নেমে চালককে ভাড়া দিচ্ছিলেন। ঠিক এমন সময়ই গুলেনুর বেগমের সব স্বপ্ন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। হাসপাতালটির আবাসিক চিকিৎসক জেসমিন নাহার জানান, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে গুলেনুর বেগমের মৃত্যু হয়েছে। নিহত গুলেনুর বেগমের স্বামীর নাম ফেরদৌস। গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী এলাকায়। এছাড়া এ্যাম্বুলেন্সের ধাক্কায় আহত হন আমেনা বেগম সূর্য (৪০) নামের এক গৃহবধূ। তিনি ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। বাড়ি ঝিনাইদহের মহেশপুরে। সূর্য বেগমের স্বামী ট্রাকচালক জাকির হোসেন। গত ২৫ আগস্ট চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার দুদিন পর থেকেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি। জাকির হোসেনের সঙ্গে তার স্ত্রী ও ছয় বছর বয়সী সজিব নামে এক পূত্রসন্তানও ছিল। সকালে স্বামীর জন্য ছেলে সজিবকে সঙ্গে নিয়ে নাস্তা আনতে গেলে এ্যাম্বুলেন্সের ধাক্কায় আহত হয় তারা। আহত সজিব ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার অবস্থা প্রাথমিকভাবে আশঙ্কামুক্ত। আহত সূর্য বেগমকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভর্তির পরপরই তার পেটে প্রচ- ব্যথা শুরু হয়। ব্যথায় চিৎকার করতে থাকেন। তার চিৎকারে সেখানকার আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে আসে। তার চিৎকারে গর্ভবতীদের ওয়ার্ডে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। চিকিৎসকরা তাৎক্ষণিকভাবে সূর্য বেগমের শরীরে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন। অস্ত্রোপচারের পর সূর্য বেগমের পেট থেকে ছয় মাস বয়সী মৃত সন্তান বেরিয়ে আসে। হাসাপাতালের ক্যাজুয়াল্টি বিভাগের চিকিৎসক মোঃ আশরাফ উদ্দিন খান জানান, সূর্য বেগমের পেটের ছয় মাসের সন্তানটি এ্যাম্বুলেন্সের প্রচ- ধাক্কায় মারা গেছে আর সূর্য বেগমের ছেলে সজিবের বাম পা ভেঙ্গে গেছে। অস্ত্রোপচারের পর বিকেলেই সূর্য বেগমকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে সূর্য বেগমও গর্ভের সন্তানের মতো পরপারে চলে যান। এমন হৃদয় বিদারক ঘটনায় রীতিমতো শোকের ছায়া নেমে আসে সর্বত্র। খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। মন্ত্রী হতাহদের সার্বিক খোঁজখবর নেন। তাদের সব ধররের চিকিৎসা সহায়তাসহ প্রয়োজনীয় সুবিধা প্রদানের নির্দেশ দেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। হতাহতদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করেন। তাদের সান্ত¡না দেন। এ ঘটনায় আহত রমজান আলী (৪৫) ও বাচ্চু মিয়া (৩৫) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তারা আশঙ্কামুক্ত। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এ্যাম্বুলেন্সটির মালিক মাহফুজ। তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্টাফ। ঘটনার সময় হেলপার সোহেল এ্যাম্বুলেন্সটি চালাচ্ছিল।
×