ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শেরপুরে হাতির আক্রমণে মৃত ৫২

‘আত্তির জীবনের দাম আছে, আমগর নাই’

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ১৬ অক্টোবর ২০১৬

‘আত্তির জীবনের দাম আছে, আমগর নাই’

রফিকুল ইসলাম আধার, শেরপুর ॥ ‘ধান, কাঁডাল পাকলেই আত্তির (হাতির) পাল আমগর গেরামে নাইমা আয়ে। ঘরবাড়ি ভাইঙা ফালায়। পোলাপান নিয়া রাইত জাইগা বইসা থাহি। কী করমু, তহন তো কোন উপায় থাহে না। এহেবারে যুদ্ধের নাহাল অবস্থা। আত্তির জীবনের দাম আছে, আমগর জীবনের দাম নাই’Ñ আবেগজড়িত কণ্ঠে এ প্রশ্ন শেরপুরের ঝিনাইগাতী সীমান্তে ওপার থেকে নেমে আসা বন্যহাতির অব্যাহত আক্রমণে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের। বৃহস্পতিবার রাতে বন্যহাতির আক্রমণে নিহত হয়েছে সীমান্তের পানবর এলাকার আয়তন নেছা, জহুরুল হক ওরফে কালা জহুরুল ও আব্দুল হাই। আর একই অবস্থায় শুক্রবার রাতে নিহত হয়েছে তাওয়াকুচা এলাকার গৃহবধূ মমেনা বেগম (৫০)। এ নিয়ে গত দেড় মাসের ব্যবধানে সীমান্ত এলাকায় হাতির আক্রমণে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আটে। শনিবার সকালে সরেজমিনে সীমান্তবর্তী পাহাড়ী এলাকা পানবর, দুধনই, তাওয়াকুচা ও ছোটগজনী এলাকায় গিয়ে দেখা যায় সর্বত্র বিরাজ করছে বন্যহাতির তা-ব আতঙ্ক। নাওয়া-খাওয়া, কাজকর্ম ছেড়ে সবাই এখন ভুগছে সেই আতঙ্কে। নির্ঘুম রাত কাটে একই অবস্থায়। পাহাড়ী জনপদে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের যাতায়াতও থমকে দাঁড়িয়েছে। কথা হয় পানবর গ্রামের নিহত আব্দুল হাইয়ের বড়ভাই মোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, মাত্র দেড়মাস আগে হাতির আক্রমণে বড় ভাই রুস্তম হাজীকে হারিয়েছি। আর বৃহস্পতিবার রাতে হারিয়েছি ছোটভাই আব্দুল হাইকে। একই ঘটনায় আরও নিহত হয়েছে নারীসহ ২ প্রতিবেশী। এরপরও শুক্রবার রাতে নিহত হয়েছেন তাওয়াকুচা গ্রামের গৃহবধূ মমেনা বেগম। এভাবেই এখন সীমান্তের পাহাড়ী এলাকায় বাড়ছে হাতির আক্রমণে মৃত্যুর মিছিল। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, আর কত মায়ের বুক খালি হবে হাতির আক্রমণে? সরকার কি এর কোন সুরাহা করবে না ? একই প্রশ্ন রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে নিহত কালা জহুরুলের স্বজন নূর জাহান বেগম, আমরা আর লাশ দেখতে চাই না। নিজের খেয়ে ভিটে মাটিতেই নিরাপদে বাঁচতে চাই। নিহত আয়তন নেছার স্বামী ছুন্নত আলী প্রশ্ন রেখে বলেন, আর কত প্রাণ যাবে হাতির তা-বে। তারই মেয়ে শরিফা খাতুন শুক্রবার মা আয়তন নেছাসহ নিহত ৩ জনের লাশ দেখতে আসা স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রকৌশলী একেএম ফজলুল হক চাঁনকে দিয়েছেন ঝাঁকুনি। তিনি চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘গুলি দাও নইলে মাকে ফিরাইয়া দাও, গুলি দিয়া সব হাতি মাইরা ফেলামু। সরকার হাতি পালছে কি আমাদের শেষ করণের লাইগা? হয় হাতি থাকবে নইলে আমরা থাকমু।’ এমন বুকফাটা আর্তচিৎকার, আহাজারী আর আবেগী প্রশ্ন ওই এলাকার অনেকের। কারণ সীমান্তের ওই জনপদে বন্যহাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সাম্প্রতিককালে ওই দ্বন্দ্ব আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। পাহাড় থেকে খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে নেমে আসা বন্যহাতির দল মানুষের বাধা পেয়ে ফসলের মাঠ-বাড়িঘরে তা-ব চালাচ্ছে। এমনকি পায়ে পিষ্ট করে, শুঁড় পেঁচিয়ে তুলে আছাড় দিয়ে মানুষের জীবনহানি ঘটাচ্ছে। তেমনি সীমান্তের অধিবাসীরাও নিজেদের টিকে থাকার লড়াইয়ে নিজেদের জানমাল রক্ষায় বন্যহাতির ওপর সহিংস-হিংস্র আচরণ করছে। এতে মারা পড়ছে বন্যহাতি। সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী-শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় পাহাড়ী জনপদে হাতি-মানুষে দ্বন্দ্ব নিরসন ও সহাবস্থান নিশ্চিত করতে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয়। তবু হাতি-মানুষে ‘যুদ্ধ’ থামছেই না, বেড়ে চলেছে বন্যহাতি ও মানুষের প্রাণহানি। বিনষ্ট হচ্ছে ক্ষেতের ফসল, ল-ভ- হচ্ছে ঘরবাড়ি আর নষ্ট হচ্ছে গাছপালা। ক্ষতিগ্রস্ত করে ৫টি বসত ঘর এবং প্রায় ৪ একর জমির ফসল। এর আগে ১০ অক্টোবর রাতে উত্তর বাকাকুড়া সীমান্ত গ্রামে বন্যহাতির আক্রমণে এক গারো কৃষক নিহত ও ২ জন আহত হয়। প্রায় ৬০/৭০টি বন্যহাতির দল রাতভর ওই এলাকায় তা-ব চালিয়ে প্রায় ৪ একর জমির আধা পাকা আমন ধান ও এক একর জমির শিমুল আলুর ক্ষেত খেয়ে, পায়ে মাড়িয়ে সাবাড় করে। সেপ্টেম্বর মাসে ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী সীমান্তে কয়েকদিনের ব্যবধানে বন্যহাতির আক্রমণে ৩ জন নিহত ও ২ জন আহত হয়। এদিকে ১ অক্টোবর পশ্চিম বাকাকুড়া এলাকায় গ্রামবাসীদের বিদ্যুতের ফাঁদে একটি বন্যহাতিও মারা পড়ে। ময়মনসিংহ বন বিভাগ ও শেরপুর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কার্যালয়ের হিসাব মতে, ১৯৯৫ সাল থেকে এ বছরের ১৪ অক্টোবর ঝিনাইগাতী-শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী উপজলোর পাহাড়ী এলাকায় বন্যহাতির আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে ৫২ জনের। আহত হয়েছে ৫ শতাধিক লোক। অন্যদিকে মানুষের হাতে মারা পড়েছে ১৯টি হাতি। এর মধ্যে গত আড়াই বছরে প্রাণ গেছে ১৮ মানুষের। এছাড়া হাতির আক্রমণে ঘরবাড়ি, গাছপালাসহ কোটি টাকার বেশি মূল্যের সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে। একই সময়ে হাতি মারা গেছে ১২টি।
×