ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্টিফেন ডাউলিং, বিবিসি

পরমাণু শক্তিচালিত বিমান

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ১৫ অক্টোবর ২০১৬

পরমাণু শক্তিচালিত বিমান

লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে রওনা হয়ে মাত্র তিন ঘণ্টায় পৌঁছে যাবেন নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে। না, এখনও এমন বিমান তৈরি হয়নি- চালু হওয়া তো আরও পরের কথা। এমনকি এর কোন নমুনাও বের হয়নি। তবে এমন বিমানের ডিজাইনটি রয়েছে স্প্যানিশ ডিজাইনার অস্কার ভিনালসের কল্পনায়। এটি হবে পরমাণু শক্তিচালিত। গতি হবে ঘণ্টায় ২৩০০ মাইল বা ৩৬৮০ কিলোমিটার। ফ্ল্যাশ ফ্যালকন নামের এই বিমান দেখতে লাগবে ভিডিও গেমের নভোযানের মতো। ২০০৩ সালে সুপারসনিক কনকর্ডের উড্ডয়ন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে এই বিমান তা পূরণ করে দেবে। অবশ্য যতদিন তা বাস্তবে না ঘটছে ততদিন এসব কিছুই স্রেফ সম্ভাবনা ও কল্পনার কথা। অস্কার ভিনালস ২০১৪ সালে বিবিসি কিউচার অনুষ্ঠানে আগামী দিনের এক অতিকায় যাত্রী বিমানের ডিজাইন দেখিয়েছিলেন যা কিনা তিমির আকৃতির। তিনি পরমাণু শক্তিচালিত যে বিমানের ডিজাইন নিয়ে ভাবছেন তার কাঠামো কনকর্ডের চেয়েও ১৩০ ফুট বেশি লম্বা। ডানা দ্বিগুণ বেশি চওড়া। বিমানটি যাতে হেলিকপ্টারের মতো টেকঅফ করতে ও অবতরণ করতে তার সুবিধার্থে এর ইঞ্জিনগুলো ২০ ডিগ্রী পর্যন্ত হেলতে পারবে। ফ্ল্যাশ ফ্যালকনের আসল ব্যাপারটা আরও বেশি বিপ্লবাত্মক। ভিনালসের এই বিমান চলবে পরমাণু শক্তিতে। এর একটি ফিউশন রিএ্যাক্টর ছয়টি ইঞ্জিনে এনার্জি পাম্প করে দেবে। বিবিসি ফিউচারের কাছে ভিনালস বলেন যে, ভবিষ্যতে বিপুল পরিমাণ বৈদ্যুতিক শক্তি লাভ করার সর্বোত্তম উৎস হতে পারে পারমাণবিক একীভবন বা ফিউশন। একই সময় এটা হবে পরিবেশবান্ধব যা কোন বিপজ্জনক বর্জ্য তৈরি করবে না। ভিনালস বলেন, পারমাণবিক একীভবন কিভাবে কাজ করে সে ব্যাপারে আমাদের খুব শুদ্ধ ধারণা আছে। এ নিয়ে অনেক প্রকল্প কাজ করছে যেমন টোকামাক, আইটার, স্টেলারেটর। তিনি আশাবাদী যে আগামী ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে একটা প্রথম স্থিতিশীল ও উৎপাদনক্ষম ফিউশন রিএ্যাক্টর পাওয়া যাবে। সস্তায় ও বিপুল পরিমাণে এনার্জি প্রাপ্তির এই উৎসটি এত শীঘ্র পাওয়া যাক আর নাই যাক ভিনালসের এই ধারণার মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্নের পুনরুজ্জীবন ঘটল যা ১৯৫০ এর দশক থেকে এয়ার এ্যাক্ট ডিজাইনারদের আচ্ছন্ন করে আছে। তাহলে কিভাবে বিমানেরম ভেতর একটা পরমাণু রিএ্যাক্টর বসান যায়। নিউক্লিয়ার ফিশন রিএ্যাক্টর আবিষ্কারের ফলে শুধু বাসাবাড়িতেই নয়, জাহাজেও সস্তায় এনার্জি লাগানোর সম্ভাবনা পূরণ হয়। ১৯৫০-এর দশকে জাহাজে ব্যবহার হতো প্রথম ছোট আকারের রিএ্যাক্টর। কয়েক বছরের মধ্যে সেটি আকারে এত ছোট করে ফেলা হয় যে সাবমেরিনে শক্তি লাগানোর কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হয়ে পড়ে। ১৯৫০ এর দশক ছিল বিমান ডিজাইনের অন্যতম স্বর্ণযুগ। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশাল অগ্রগতি ঘটেছিল। তথাপি বিমানে রিএ্যাক্টর ব্যবহারের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কারণ বিমানে ফিশন রিএ্যাক্টর বসানোর ব্যাপারে কিছু বড় ধরনের সমস্যা আছে। এক্ষেত্রে ক্লোজড লুপ সিস্টেম অর্থাৎ বর্জ্য জ্বালানি পুনর্ব্যবহার করার মতো রিএ্যাক্টর থাকলেই শুধু চলবে না বিপুল মাত্রায় ভারি শিল্ডিংয়ের প্রয়োজন হবে। কারণ নিউক্লিয়ার ফিশন থেকে প্রচুর নিউট্রন তৈরি হয় সেগুলো দারুণ ক্ষতিকর হতে পারে। পাশ্চাত্যে পরমাণু শক্তিচালিত একমাত্র যে বিমানটি উড়েছিল সেটি ছিল ১৯৫০ এর দশকের প্রথমদিকের কনভেই যার বি-৩৬ বোমারু বিমান যা ব্যাপক পরিসরে পরিবর্তন করা হয়েছিল। বিমানটি আগে থেকেই ছিল আকারে বেশ বড়সড়। তার ওপর বিকীরণ বাইরে বেরোতে না দেয়ার জন্য ওতে ১১ টনের শিল্ড বা বর্ম যোগানো হয়েছিল। এই বিমানটি আকাশে উড়েছিল ৪৭ বার। এ সময় এর ভেতরকার রিএ্যাক্টরটির আকাশপথে ব্যবহার পরীক্ষা করে দেখা হয়েছিল কিন্তু কখনই প্রকৃতপক্ষে বিমানে শক্তি যোগানোর কাজে তা ব্যবহার করা হয়নি। নিউক্লিয়ার ফিশনের শক্তিচালিত বিমানের ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা থাকায় এর আর কোন উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা করা হয়নি। পারমাণবিক রিএ্যাক্টর আছে এমন বিমানে যাত্রীরা উঠতেও নিশ্চয়ই রাজি হতো না। তাহলে নতুন করে এখন আবার পরমাণু শক্তিচালিত বিমানের কথা ভাবা হচ্ছে কেনÑ অন্তত অস্কার ভিনালসের ধারণায়? কারণ ভিনালস যে বিমানের কথা ভাবছেন সেটি শক্তি পাবে নিউক্লিয়ার ফিশন বা বিভাজন থেকে নয় বরং নিউক্লিয়ার ফিউশন বা একীভবন থেকে। এক্ষেত্রে দুই বা ততোধিক এ্যাটম একটি বৃহত্তর এ্যাটমে পরিণত হয়ে অধিকতর শক্তি বা এনার্জি উৎপাদন করবে অথচ তা থেকে পরিবেশ দূষণকারী বর্জ্য তৈরি হবে না। পারমাণবিক একীভবন এখনও অবশ্য অনেক দূরের ব্যাপারে। প্রযুক্তির দিক থেকেও এখন নাগালের বাইরে। এ জাতীয় রিএ্যাক্টরগুলো এখনও পরীক্ষামূলক স্তরে আছে। তথাপি বিমানে এমন রিএ্যাক্টর ব্যবহারের ভাবনা থেকে ভিনালসকে নিবৃত্ত করা যায়নি। তার ফ্ল্যাশ ফ্যাকন আজকের প্রযুক্তি ছিল ওড়ানোর পরিকল্পনাটি হয়ত অনেক বেশি উচ্চাভিলাষী। কিন্তু বিমান চলাচলের ইতিহাসে এমন অর্জন ভূরি ভূরি আছে যা এক সময় অসম্ভব বলে ভাবা হতো। বিমানে নিউক্লিয়ার ফিউশনের ব্যবহার একদিন হয়ত সত্য হয়ে দেখা দেবে।
×