ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

লোকজ বাদ্যযন্ত্রের কদর কমছে

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ১৫ অক্টোবর ২০১৬

লোকজ বাদ্যযন্ত্রের কদর কমছে

মহুয়া মলুয়ার প্রাচীন নগরী ময়মনসিংহে ছিল সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভা-ার। শিল্প সাহিত্যের চর্চা ছিল ঘরে ঘরে। ময়মনসিংহের সব কটি জমিদার ছিল এসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সঙ্গীতানুরাগী প্রতিটি জমিদার পরিবারেও নিয়মিত চর্চার পাশাপাশি জমজমাট আসর আয়োজন ছিল সঙ্গীতের। মূলত এসব কারণেই ওই সময়ে সঙ্গীত পিপাসুদের চাহিদার প্রয়োজনে উদ্ভাবন ঘটেছিল লোকজ নানা বাদ্যযন্ত্রের। আর এসব বাদ্যযন্ত্রের চাহিদার ওপর ভর করে গড়ে ওঠে কারিগর। বংশানুক্রমে মূলত কারিগরদের প্রসার ঘটে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। চল্লিশ থেকে সত্তর দশক পর্যন্ত বলা যায় বাদ্যযন্ত্রের কারিগরদের রমরমা বাণিজ্য ছিল। কদর ছিল বাদ্যযন্ত্রের। কিন্তু উন্নতমানের আধুনিক ও আমদানি বিদেশী যন্ত্রের দাপটে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে দেশী এই শিল্প ও এর সঙ্গে জড়িত বিরাট জনগোষ্ঠী। বেহালা আর দোতারাসহ নানা যন্ত্রের নিখুঁত কারিগর ছিলেন ময়মনসিংহ শহরের শিল্পী জালাল উদ্দিন। দেশ বিদেশের অনেক খ্যাতিমান শিল্পী ও ওস্তাদের বেহালার ও দোতারার কারিগর ছিলেন তিনি। জালালের হাত ধরেই সেদিন এই পেশায় আসেন শ্রবণ প্রতিবন্ধী ছেলে শামীম। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি আর আমদানি করা যন্ত্রের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারায় পেশা বদল করে শামীম এখন ভ্যানচালক! ময়মনসিংহের নামকরা অনেক কারিগরের এখন এমন অবস্থা। তবে এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নবাব এ্যান্ড কোং এর ৩য় প্রজন্মের রেজাউল করিম আসলাম। ১৯৪৪ সালে নবাব আলীর প্রতিষ্ঠান নবাব এ্যান্ড কোং প্রতিষ্ঠার পর এখনও এটি টিকে আছে। এই প্রতিষ্ঠানের আগে শহরের ওল্ড ক্লাব পুলিশ রোডে বর্তমানে স্বদেশী বাজার রোডে ছিল সুরেন এ্যান্ড কোম্পানি। সুরেন বাবুর তৈরি সেতার, সরোদ, তানপুরা, সারেঙ্গীর খ্যাতি ছিল উপমহাদেশজুড়ে। কলকাতার অনেক খ্যাতিমান শিল্পী ও ওস্তাদের সেতার, তানপুরা, সরোদ সরবরাহ করেন সুরেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ এনায়েত খাঁ ও ওস্তান পচানন্দসহ অনেক খ্যাতিমানের ব্যক্তিগত যন্ত্রের কারিগর ছিলেন সুরেন। কলকাতায় তখন এক নামে সবাই চিনেছে ময়মনসিংহের এই গুণী কারিগরকে। তৎকালীন সময়ে সুরেনের তৈরি বাদ্যযন্ত্র কলকাতায় গেছে রেলওয়ের ওয়াগ্যানে করে। দেশ ভাগ হওয়ার পর সুরেন ময়মনসিংহ ত্যাগ করার আগে তার তৈরি সব বাদ্যযন্ত্র তুলে দিয়ে যান ময়মনসিংহের আরেক খ্যাতিমান বাদ্যযন্ত্র তৈরির নক্ষত্র নবাব আলীর কাছে। বড়বাজার এলাকায় নবাব আলী নবাব এ্যান্ড কোং নামে বাদ্যযন্ত্রের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মূলত হারমোনিয়ামের কারিগর ছিলেন নবাব। একবার ময়মনসিংহে মহামারী দেখা দিলে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নবাব নিখোঁজ হন। পালিয়ে চলে যান উত্তরের জেলা দিনাজপুরে। সেখানে তিন বছর অবস্থানকালে স্থানীয় সাঁওতালদের কাছে শেখেন হারমোনিয়াম তৈরির নানা কৌশল। এর আগে কিছুদিন কলকাতাতেও এই কাজ শেখেন তিনি। পরে দিনাজপুর থেকে ফিরে ময়মনসিংহ এসে মনোযোগ দেন হারমোনিয়াম তৈরিতে। পাশাপাশি বেহালা, দোতারা, ঢোল, বাঁশি তৈরি করেন। তবলার জন্য এ সময় শহরে ‘তালতরঙ্গ’ নামে প্রতিষ্ঠান ছিল। একই সময়ে বিকে দাস এ্যান্ড কোং, ভাই ভাই কোম্পানি, লতিফ এ্যান্ড কোং, ছমিরন এ্যান্ড কোং, সহিদ এ্যান্ড কোং নামে বড়বাজার এলাকায় বেশকিছু বাদ্যযন্ত্র তৈরির প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয় অসংখ্য কারিগর। ওই সময়ে তানপুরা, সেতার, সরোদ, সারেঙ্গী, সারিন্দা, এস্রাজ, টুসি, ঢোল ও মেকুড়সহ অসংখ্য লোকজ বাদ্যযন্ত্র তৈরি হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানে। আর এসব যন্ত্রের চাহিদাও ছিল বেশ। বর্তমানে বড়বাজার এলাকায় এসব প্রতিষ্ঠান টিকে থাকলেও নেই দক্ষ কারিগর। বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ও চাহিদাও নেই। খ্যাতিমান কারিগরদের প্রজন্ম নতুন করে কেউ আর এই পেশায় আসছে না। লাভজনক অন্য পেশায় চলে গেছে তারা। নবাব আলী পরিবারের ৩য় প্রজন্মের আসলাম জানান, উন্নতমানের আধূনিক প্রযুক্তির বাদ্যযন্ত্রের কদর এখন অনেক বেশি। দামেও সস্তা, নিখুঁতও বটে। দেখতেও চকচকে। ফলে নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের কাছে আমদানি বাদ্যযন্ত্রের চাহিদা বেশি। তিনি জানান, চায়না কারিগরদের তৈরি বেহালা দেখতে নিখুঁত ও চকচকে বলে দেশে তৈরি কারিগরদের বেহালা পছন্দ নয় শিল্পীদের। এসব নানা কারণে দেশে তৈরি বাদ্যযন্ত্রের কদর কমে গেছে। এতে টিকে থাকতে পারছে না কারিগররা। তারপরও আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে টিকে আছে নবাব এ্যান্ড কোং। হারমোনিয়াম তৈরির জগতে নবাব এখনও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবে এসব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে শিল্পী আদনিনা মৌরি প্রিয়াংকা বলেন, এখন ওয়েস্টার্ন মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টের কদর বেশি। ফলে ফোক বাদ্যযন্ত্রের কদর কমে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম কী বোর্ড, গিটারে ঝুঁকছে। এতে এখন মিউজিক শুনে আর বোঝার উপায় নেই, কোন ধরনের গান হবে। লোকজ বাদ্যযন্ত্রের অভাবে শিল্পীর গান আর সুরে যে দরদ ছিল সেটিও মিলছে না। -বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ থেকে
×