ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশগুপ্ত

ভ্রান্ত রাজনীতি ও জঙ্গীবাদকে পরাস্ত করা উৎসবের শান্তি

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ১৫ অক্টোবর ২০১৬

ভ্রান্ত রাজনীতি ও জঙ্গীবাদকে পরাস্ত করা উৎসবের শান্তি

এমন শান্তিপূর্ণ প্রাণবন্ত উৎসব বিরল আজকাল। পরপর দুটো বড় ধর্মীয় উৎসব। গায়ে গা লাগিয়ে উদযাপিত হলো শারদীয় দুর্গাপূজা আর পবিত্র আশুরা। এখন ধর্মীয় উৎসবগুলোই সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ। দুনিয়ার দেশে দেশে জঙ্গী-সন্ত্রাসী বা আতঙ্কবাদী নামে পরিচিতদের টার্গেট উপাসনালয় বা এ ধরনের উৎসব। উপমহাদেশের একটি দেশে এসব ঘটনা এখন নৈমিত্তিক। তাড়াতে তাড়াতে সেখান থেকে অন্য ধর্মের লোকদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করার পরও পাকিস্তানে অশান্তির যেন শেষ নেই। এখনও চলছে আত্মহনন। শিয়ারা মুসলমান কিনা, হলে কেমন মুসলমান না হলে কোথায় বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে হবে এসব পরিকল্পনায় তাদের দিন যায়। আমাদের দেশ তুলনামূলক শান্ত হলেও ইদানীং এখানেও ভয় বাড়ছে। বাড়ার কারণ আছে অনেক। গেলবার মহরমের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিপর্বে হামলা করা হয়েছিল। বড় ধরনের নাশকতা না হলেও এর পেছনে ছিল ষড়যন্ত্র আর ইন্ধন। অন্যদিকে হিন্দুদের পূজা আসার আগেই ধারাবাহিকভাবে মূর্তি ভাঙ্গার দুষ্কর্ম চলে আসছে অনেক বছর ধরে। প্রায় প্রতিদিন মিডিয়ায় ভাঙ্গা মুখ থুবড়ে পড়া দেব-দেবীর মূর্তির পাশে ক্রন্দনরত মানুষের নিরীহ মুখ দেখে সন্দেহ জাগে আসলে কি ধর্মের জোর বলে কিছু আছে? সে জায়গায় এবার বলতে গেলে কলঙ্কহীন পূজার আনন্দে ভেসেছে দেশ। আশুরা পালিত হয়েছে মহানিরাপদে। কিভাবে তা হলো? মনে করব উৎসবের ঠিক আগে কয়েকটি জঙ্গী আস্তানার সন্ধান এবং সেখানে ১২ জন জঙ্গী নিধনের কথা। এই দমন বা নিধন কতটা দরকারী ছিল সেটা শান্ত দেশ আর সমাজই জানান দিয়েছে। এদের পরিকল্পনা আর হামলা বাস্তবায়িত হতে পারলে এখন আমরা টিভিতে টিভিতে মত দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। মাইক্রোফোন হাতে আবাল বালক তরুণদের ধারাভাষ্য শুনে বোঝা যেত না আসলে কতজন গেছে আর কি ঘটেছে। সে জায়গাটা শান্ত থাকায় একশ্রেণীর মানুষের দিলে বড় চোট লেগেছে। তারা পারল না নিজের মতামত ও বিশেষত্ব জাহির করতে। তাদের আসল যে উদ্দেশ্য শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে মানুষ রাগিয়ে তোলা সেটাও হয়নি এবার। খেয়াল করবেন এজন্য সরকার ও প্রশাসনের ধন্যবাদ প্রাপ্য হলেও সুশীলদের মুখে কুলুপ। যে শ্রেণী এর সুবিধা নিতে বসে থাকে এবার তাদের আশায় ছাই ফেলে দিয়েছে প্রশাসন। কিন্তু এই নিñিদ্র নিরাপত্তা ও সতর্কতা অন্য সময় কোথায় থাকে? দেখা যাচ্ছে সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার ওপর ঘটনা নির্ভর না করলেও দুর্ঘটনা রোধ ও জীবন বা সম্পদের হানি কমাতে পারে। কোথাও কোথাও ঘটনা বন্ধও হয়ে যেতে পারে। এবার তাই ঘটেছে। সরকার ও প্রশাসনের দূরদর্শিতায় জঙ্গী দমন ও ১২ জনকে নির্মূল করা না গেলে কি হতো ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। মানতে হবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে কঠিন। তিনি জঙ্গী দমনে জিরো টলারেন্সে বিশ্বাসী। এ নিয়ে প্রশ্নের কোন অবকাশও নেই। কিন্তু বাকিরা কি তাই? ঘাটে ঘাটে হাটে মাঠে প্রশাসনে দলে অন্দরে বাইরে কি সবাই তা চায়? চায় না বলেই তো মাঝে মাঝে মিডিয়া কাঁপিয়ে দুঃসংবাদ হয়ে ওঠে প্রধান খবর। বলছিলাম ধর্মের কথা। আজকাল বিধর্মীদের ওপর চড়াও হলে নানা ধরনের লাভ-লোকসানের হিসাব দেখতে পাই। এতে সরকার, দেশ ও জনগণকে অশান্ত করে রাখা যায়। তারপর আছে বিশ্ব মিডিয়ায় প্রচার পাবার উগ্র খায়েশ পূর্তি। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া এখন মুঠোর ব্যাপার। এমন কিছু ঘটাতে পারলে আমেরিকা ইউরোপ এশিয়া আফ্রিকা এসে হুমড়ি খেয়ে পড়বে আমাদের মাটিতে। বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ও সরকারের ভাবমূর্তি এককরে দেখতে অভ্যস্ত রাজনীতি চায় এমন কিছু ঘটুক। তাতে ঘরপোড়া আগুনে তাদের পাওয়ারের লোভ লালসার আলু সিদ্ধ হবে ভাল। সে কারণেই পবিত্র আশুরার বাণীতে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার হতাশা ছিল চোখে পড়ার মতো। তিনি বলেছেন, অন্যায় অন্যায্যতা অপশাসন এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে হবে মানুষকেই। তাদের এজন্য নামতে হবে রাস্তায়। বাণীটি আপাত সরল মনে হলেও আসলে কি তাই? যেহেতু তাদের কথা মানুষ শুনছে না। তাদের আন্দোলন সংগ্রাম বা সরকার হটানোর জেদে মানুষের সায় নেই তাই তিনি দায়টা চাপিয়ে দিচ্ছেন জনগণের ঘাড়ে। রাজনীতির যে দায় রাজনৈতিক দলের যে গঠনমূলক ভূমিকা সেখানে নেই তিনি। তাঁদের আন্দোলন বা সংগ্রামকে জনগণের খাতে নিতে না পারার কারণে অতীতেও তারা হানাহানি মারামারি আগুন জ্বালানোর ভেতর দিয়ে এদেশে জঙ্গীবাদকে পথ দেখিয়েছিল। এবারে তা না পারলেও ইন্ধন দিতে কসুর করা হয়নি। এতসবের ভেতরও উৎসবের আনন্দ একফোঁটা ম্লান হয়নি। সামাজিক মিডিয়ার সেলফি ছবি আর খবরে বোঝা গেছে কেমন আনন্দমুখর ছিল পরিবেশ। তাজিয়া মিছিল আর শোকের আবহে মহরমও জানিয়ে দিয়েছে এদেশে সাম্প্রদায়িকতা উগ্রবাদের জায়গা নেই। এতে এটা প্রমাণিতÑ এ দেশের জনগণ আসলেই হানাহানি বিমুখ। তারা যদি সত্যিকারভাবে চাইতো পূজা না হোক বা মূর্তি বিষয়ে তাদের সংস্কার থাকত কেউ চাইলেও আপদ ঠেকাতে পারত না। তারা যদি শিয়াদের ঘটনা ভেবে আশুরায় বাধা দিত তখনও ঠেকানো যেত না। এটাই পাকিস্তান বা তেমন সাম্প্রদায়িক দেশ ও জাতির সঙ্গে আমাদের তফাৎ। আমাদের মাটি জল হাওয়া আকাশ ফুল খাবার পোশাকে উগ্রতার জায়গা নেই। আমাদের জীবন ও জীবনবোধে আছে সহাবস্থান আর সমঝোতা। এখানে পূজার আনন্দে ঢাকের আওয়াজে মহরমের বিষাদে মানুষ হাতে হাত রেখে চলে। শুধু সরকার ও প্রশাসনের আন্তরিকতা আর দূরদৃষ্টি থাকলেই নষ্ট রাজনীতি এসব করতে পারে না। দুঃখের বিষয় সরকারী বা বিরোধী দল সবাই সুযোগমতো এর অপব্যবহার করে। করে বলে এর নাম নাকি রাজনীতি। মানুষ যে এমন রাজনীতি চায় না সেটাই প্রমাণ করল দু’দুটো বিশাল উৎসব। জয় বাংলার জয় এখানেই।
×