ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দীর্ঘমেয়াদী এক পণ্যনির্ভর বাণিজ্য ঝুঁকিপূর্ণ

দেশের রফতানি বহুমুখীকরণের গতি মন্থর

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৫ অক্টোবর ২০১৬

দেশের রফতানি বহুমুখীকরণের গতি মন্থর

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ক্রমবর্ধমান হারে রফতানি আয় বেড়ে চললেও দেশে পণ্য বহুমুখীকরণের গতি খুবই মন্থর। নতুন পণ্যের প্রসারে তেমনভাবে এগিয়ে আসছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে ঘুরেফিরে কয়েকটি পণ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের রফতানি বাণিজ্য। এমনকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না প্রচলিত বাজারের বাইরে ভিন্ন কোন বাজার। রফতানি আয়ের ৯০ ভাগই আসছে ৪ পণ্য থেকে। এরমধ্যে তৈরি পোশাক থেকেই আসছে ৮০ ভাগ। বাকি ১০ ভাগ আসছে হিমায়িত খাদ্য, পাট ও পাটজাত দ্রব্য এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে। এমন চিত্রকে সংশ্লিষ্টরা বলছেনÑ ‘এক পণ্য নির্ভরতা।’ এক পণ্য নির্ভর রফতানি বাণিজ্য দীর্ঘমেয়াদী সময়ের অন্যতম দুর্বলতা হলেও তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘মন্থর গতিতে হলেও দেশে রফতানি বহুমুখীকরণ হচ্ছে।’ তারা এও বলছেন, ‘রফতানি বহুমুখীকরণের লক্ষ্যে সরকারের উচিত ব্যবসায়ীদের আরও বেশি চাপ দেয়া।’ বহুমুখীকরণকে উৎসাহিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, নতুন পণ্য রফতানিতে কোন ব্যবসায়ী এগিয়ে এলে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীকে প্রণোদনা দেয়া হবে। তারপরও দেশের রফতানি ঝুঁড়িতে (এক্সপোর্ট বাস্কেট) যোগ হচ্ছে না নতুন কোন পণ্য। রফতানি বহুমুখীকরণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত জনকণ্ঠকে বলেন, ‘শ্রমে উৎপাদিত পণ্য যখন দেশের বাইরে পাঠাই, এর মাধ্যমে যে আয়টা হচ্ছেÑ ধরে নেয়া যায় সেই আয়টা ভাল। অর্থাৎ বর্তমানে দেশের রফতানি আয় ভাল। রফতানি আয় যদি অর্থনীতির জন্য ভাল হয় তবে সময়ে এক পণ্য নির্ভর দীর্ঘমেয়াদী রফতানি বাণিজ্যের জন্য ক্ষতিকর। সে কারণেই পণ্য ও দেশ বহুমুখীকরণের কথা বলা হচ্ছে।’ পোশাক খাতের সমসাময়িক সময়ে যাত্রা শুরু করা চামড়া ও চা শিল্পের প্রসার না ঘটাকে ওই দুটি শিল্পের অন্যতম দুর্বলতা আখ্যা দিয়ে রফতানি বহুমুখীকরণ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) সিনিয়র গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দেশের রফতানি পণ্য সীমিত। এক পণ্য বা বহু পণ্য যেটাই হোক, তা দেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে দীর্ঘমেয়াদী সময়ে এটা কতটা টেকসই হবে তা নিয়ে একটা শঙ্কা থেকে যায়। গার্মেন্টেসের বাইরে যেতে না পারা আমাদের দুর্বলতা।’ তিনি আরও বলেন, ‘তৈরি পোশাকের সমসাময়িক অন্য পণ্যগুলো তুলনামূলক অনেক পিছিয়ে আছে।’ এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘পোশাক খাত থেকে রফতানি আয়ের ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ আসছে। এমন পরিস্থিতিতে পণ্য বহুমুখীকরণ নিয়ে বহুদিন ধরেই কাজ করছি। নতুন নতুন বাজার খোঁজা হচ্ছে। সরকার ঘোষণা দিয়েছে প্রচলিত পণ্যের বাইরেÑ নতুন কোন পণ্য রফতানি করা হলে, তাতে প্রণোদনা দেয়া হবে। মন্থর গতি হলেও বলব বহুমুখীকরণ হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, পণ্য বহুমুখীকরণকে উৎসাহিত করতে সরকারের উচিত ব্যবসায়ীদের ওপর আরও বেশি চাপ দেয়া। বহুমুখীকরণ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো’র (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান মাফরুহা সুলতানা জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করেন, তারা কোন পণ্য নিয়ে ব্যবসা করবেন, সরকার তা নির্ধারণ করে দিতে পারে না, কেবল নীতি সহায়তা দিতে পারে। ব্যবসায়ীদেরই বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতা করতে হবে।’ পণ্য বহুমুখীকরণ এবং রফতানির গন্তব্য না বাড়লে তা অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের দুর্যোগ বয়ে আনতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্বয়ং বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘অর্থনীতির মূল শক্তি রফতানি হলেও বাংলাদেশ সীমিতসংখ্যক পণ্য রফতানি করছে। আর এসব পণ্যও রফতানি হচ্ছে হাতেগোনা কয়েকটি দেশে। এজন্য রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ না করতে পারলে বা যেকোন কারণে আমদানিকারক দেশগুলো আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়বে।’ তিনি আরও বলেন, এজন্য পণ্যের ও বাজারের বহুমুখীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে কাজও শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অভ্যন্তরীণ বাজারে সম্ভাবনাময় একাধিক খাত বেড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। চাহিদা মিটিয়ে ছোট ছোট পণ্য রফতানি হচ্ছে দেশের বাইরে। প্রথমবারের মতো রফতানি হয়েছে আর্ট ক্যানভাস। বিশ্ব বাজারে রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশী সাগর কলা। আর্ট ক্যানভাস ও সাগর কলাই নয়, রফতানি হচ্ছে মাথার চুলও! ফুলের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশ এখন সাম্যাবস্থায়। রফতানি চিত্রের ইতিবাচক সময়ে খাতটির সঙ্গে জড়িতদের মনোযোগ উত্তরোত্তর রফতানি বৃদ্ধিকরণ। জানা যায়, অদূরভবিষ্যতে রফতানি হতে পারে পোল্ট্রি পণ্য। সম্ভাবনায় আছে সামুদ্রিক শৈবাল। রফতানির চিত্র ॥ স্বাধীনতাপরবর্তী দেশের রফতানি বাণিজ্য বেড়েছে কয়েকগুণ। বাণিজ্য বৃদ্ধির পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখে চলছে তৈরি পোশাক। মোট আয়ের ৮০ ভাগই আসছে এখাত থেকে। সদ্য শেষ হওয়া ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মোট রফতানি আয়ের ৮২ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। এ সময়ে মোট তিন হাজার ৪৩৫ কোটি ৭২ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। এর মধ্যে আরএমজি, হিমায়িত খাদ্য, পাট ও পাটজাত, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে তিন হাজার ৭১ কোটি চার লাখ ডলার। বাদবাকি পণ্যের অবদান মাত্র ১০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। কয়েকটি পণ্য ও গুটিকয় দেশের মধ্যে রফতানির এ ধারাকে বাণিজ্যের ঝঁকি হিসেবে বিবেচনা করছেন সংশ্লিষ্ট সবাই। ইপিবি’র তথ্যমতে, গত অর্থবছরে দেশ থেকে ৭০৫টি পণ্য রফতানি হয়েছে। সংখ্যার দিক থেকে বিশাল হলেও তৈরি পোশাক শিল্পের বাইরে হিমায়িত খাদ্য এবং পাট ও পাটজাত, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে রফতানি আয় কিছুটা বেশি থাকলেও অন্যান্য পণ্য থেকে রফতানি আয় খুবই কম। সীমিত পণ্য ও বাজারে এবং প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে টার্মস অব ট্রেড (এক ইউনিট রফতানির পরিবর্তে কত ইউনিট আমদানি করা যায়)। রফতানির ক্ষেত্রে এক পণ্য নির্ভরতা বা এক্সপোর্ট কনসেনট্রেশন থেকে বের হওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে সরকারী ও বেসরকারী কোন উদ্যোগই কার্যকর হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারী এ উদ্যোগ থেকে যাচ্ছে কাগজে কলমে। রফতানি নীতিতে অগ্রাধিকার পাওয়া খাতসমূহ ॥ ২০১৫-১৮ সালের রফতানি নীতিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার খাত হিসেবে ১২ খাতকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছেÑ অধিক মূল্য সংযোজিত তৈরি পোশাক ও গার্মেন্ট এক্সেসরিজ, সফটওয়্যার ও আইটি এনাবল সার্ভিসেস এবং আইটি পণ্য, ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য, জাহাজ নির্মাণ, জুতা ও চামড়াজাত পণ্য, পাটজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, এগ্রো প্রোডাক্ট ও এগ্রো প্রসেসড পণ্য, ফার্নিচার, হোম- টেক্সটাইল ও টেরিটাওয়েল, হোম ফার্নিশিং ও লাগেজ। বিশেষ উন্নয়মূলক খাত হিসেবে ১৪ খাতকে চিহ্নিত করা হয়। এগুলো হচ্ছে বহুমুখী পাটজাত পণ্য, ইলেক্ট্রনিক ও ইলেক্ট্রনিক পণ্য, সিরামিক পণ্য, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য (অটো পার্টস ও বাইসাইকেসহ), মূল্য সংযোজিত হিমায়িত মৎস্য, পাপড়, প্রিন্টিং এ্যান্ড প্যাকেজিং, অমসৃণ হীরা ও জুয়েলারি, পেপার ও পেপার প্রোডাক্টস, রবার, রেশম সামগ্রী, হস্ত ও কারুপণ্য, লুঙ্গিসহ তাঁতশিল্পজাত পণ্য ও নারিকেলের ছোবড়া। এ প্রসঙ্গে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান মাফরুহা সুলতানা জনকণ্ঠকে বলেন, রফতানি নীতিতে চাকরিসহ ৩০ খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১২ পণ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার, ১৪ পণ্যকে উন্নয়নমূলক খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এবারই প্রথমবারের মতো চাকরি (সার্ভিস) যুক্ত হয়েছেÑ এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ট্যুরিজম, ইঞ্জিনিয়ারিং ও আইসিটি। তিনি বলেন, ‘সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ও উন্নয়নমূলক খাত নির্ধারণে বিশাল জনগোষ্ঠী ও বেকারত্ব বিবেচ্য বিষয়। কোন পণ্য কতটুকু বেকারত্ব দূর করবে, পণ্যটির ভ্যালু চেইনের কতটুকু অংশ দেশের ভেতরে আছে তা বিবেচ্য বিষয়। যে পণ্যের ভ্যালু চেইনের বড় অংশটিই দেশের ভেতরে অবস্থান করে তাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। আবার এও বিবেচনা করা হয়Ñ পণ্যটির মূল্য কেমন, বিশ্ব বাজারে দেশের এই পণ্যটি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে কিনা। পণ্য উৎপাদনে প্রাথমিক উপকরণের পর্যাপ্ততাও বিবেচ্য। বেশিরভাগ সুবিধা দেশের ভেতরে থাকতে হবে এটাই মুখ্য।’ রফতানির নতুন পণ্য ॥ দেশের প্রাকৃতিক রতœ মুক্তা চাষে বৃহৎ আকারের বাণিজ্যিক খামারের উদ্যোগ নেয়ায় তা অচিরেই রফতানি পণ্য হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক সচিব আশা প্রকাশ করে বলেন, মানসম্মত মুক্তা উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত দেশ ভিয়েতনাম থেকে ঝিনুক এনে উচ্চমানের মুক্তা উৎপাদনে আমরা ইতোমধ্যেই ৪২৪ বিঘা জমি ক্রয় করেছি। ওই অনুষ্ঠানে তিনি আরও জানান, দেশজুড়ে খাল, পুকুর, হাওড় ও নদীগুলোসহ জলাশয়ে কৃষকরা বাণিজ্যিকভাবে মুক্তা চাষ করলে ভবিষ্যতে তা রফতানি খাতে অন্তর্ভুক্ত হবে। দেশ থেকে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামের একটি প্রতিষ্ঠান ২০ হাজার কেজি সাগরকলা পোল্যান্ডে রফতানি করে, যার রফতানি মূল্য ছিল প্রায় ৬ লাখ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষির সঙ্গে যুক্ত আছেন এমন প্রত্যেকেই বাড়ির পরিত্যক্ত জমিতে সাগরকলার গাছ লাগাতে পারেন। যেসব মাঠে ফসল হয় না এমন ক্ষেতে কলার বাগান করার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে পারেন দেশের রফতানি বাণিজ্য। খাতটি হয়ে উঠতে পারে আরও সম্ভাবনাময়। এক প্রবন্ধের তথ্য থেকে জানা যায়, সরকারের লক্ষ্য রয়েছে ২০১৮ সালের মধ্যে পোল্ট্রিপণ্য রফতানি করার। সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা, খাতটি ঘিরে ২০২০ সাল নাগাদ ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, যেখানে বর্তমানে ৬০ লাখের অধিক মানুষ কর্মরত রয়েছে। প্রত্যাশ্যা অনুযায়ী খাতটি এগিয়ে গেলে দেশের রফতানি বাণিজ্যের তালিকায় যুক্ত হবে আরও একটি নতুন নাম। তবে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনের নেতারা মনে করে, পোল্ট্রিখাত এখনও তেমন সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠেনি। বিশ^বাজারে কয়েক বছর ধরেই দেশ থেকে রফতানি হচ্ছে ফুল। পূর্বাপর সময়ে ফুলের পুরো চাহিদাই মেটানো হতো আমদানি করে। বর্তমানে ফুলের আমদানি-রফতানিতে সাম্যাবস্থায় রয়েছে। ফুল চাষের প্রসার ঘটানোর মাধ্যমে খাতটিকে আরও জনপ্রিয় করে তোলা যেতে পারে, বাড়ানো যেতে পারে রফতানি আয়। চারু ও কারুশিল্পীদের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের কয়েকটি দেশে রফতানি হচ্ছে আর্ট ক্যানভাস। বনানীতে অবস্থিত দু’টি প্রতিষ্ঠান এসব আর্ট ক্যানভাস রফতানি করছে। শিল্পের সঙ্গে জড়িত একজন জানান, মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এসব আর্ট ক্যানভাস রফতানি করে দেশের মুখ উজ্জ্বল করে চলছে। জলজ সম্পদ হিসেবে সামুদ্রিক শৈবালের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। শৈবাল মানুষের ভক্ষণযোগ্য ও শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তথ্যমতে, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বিশেষত সেন্টমার্টিন দ্বীপে ১৪০ প্রজাতির অধিক শৈবাল পাওয়া যায়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যÑ গুরুত্বপূর্ণ এ সম্পদ দেশের অর্থনীতিতে কোন ভূমিকা রাখছে না। খাতটিতে ব্যবসায়ীরা এগিয়ে না আসায় সমুদ্রতটে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ এই সম্পদ। গবেষকদের প্রত্যাশা, শৈবাল চাষ ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে সামুদ্রিক শৈবাল মিয়ানমার, জাপান, সিঙ্গাপুর, ব্রাজিল, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি করা সম্ভব হবে। খাতটির উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের তালিকায় যুক্ত হতে পারে আরও একটি নতুন নাম। দীর্ঘমেয়াদী সময়ে রফতানি বাণিজ্যে আইসিটি পণ্য একটি সম্ভাবনাময় খাত। খাতটি থেকে প্রতিনিয়তই বাড়ছে রফতানি আয়। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে খাতটি রফতানির শীর্ষ কাতারে উঠে আসবে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত মনে করেন, ২০ থেকে ৩০ বছর মেয়াদে তথ্য ও প্রযুক্তি খাত খুব সম্ভাবনাময় হয়ে উঠবে। উঠে আসতে পারে শীর্ষ কাতারেও। আর আইটি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন পণ্য হিসেবে আইটি সার্ভিস ও সফটওয়্যার রফতানি করে এগিয়ে যেতে পারে দেশ। রফতানি বাণ্যিজ্যে নতুন পণ্যের প্রবেশাধিকার প্রসঙ্গে এফবিসিআই’র প্রথম সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘রফতানির ক্ষেত্রে প্রচলিত পণ্য থেকে প্রায় ৮২ শতাংশ আয় হচ্ছে। ফলে বহুমুখীকরণ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে চামড়া, প্লাস্টিক, ফার্নিচার, আইসিটি, শিপ ব্লিডিং, হ্যান্ডিক্রাফটের সম্ভাবনা খুব ভাল। বর্তমানে আমরা ফিনিশড গুডসকে প্রাধান্য দিচ্ছি। পণ্য বহুমুখীকরণ করতে হলে হাজারীবাগের ট্যানারি দ্রুত স্থানান্তর করে হেমায়েতপুরে স্থাপিত প্রতিটি কোম্পানিকে কমপ্লায়েন্স করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশ থেকে মাথার চুলও রফতানি হচ্ছে। রফতানির ক্ষেত্রে কৃষি পণ্য ও মাছের ভবিষ্যত ভাল। রফতানির ক্ষেত্রে পণ্য ও দেশ বহুমুখীকরণের লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’ বাজারে আসা নতুন পণ্য ও নতুন উদ্যোক্তারা দীর্ঘমেয়াদী সময়ে টিকে থাকতে পারে না উল্লেখ করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সিনিয়র গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘দেখা যায়Ñকোন কোন ক্ষেত্রে নতুন উদ্যোক্তারা রফতানি বাজারে ২ বছরের বেশি টিকে থাকতে পারে না। চ্যালেঞ্জটা শুধু পণ্যের ক্ষেত্রে নয়, উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রেও। একজন বা দুজন উদ্যোক্তা কোন একটি রফতানি খাত দখল করে আছে। এ ক্ষেত্রে বাজারে আসা নতুনদের আমরা কিভাবে তৈরি করছি তাও চিন্তার বিষয়। নতুন উদ্যোক্তারা কতদিন পর্যন্ত বাজারে টিকে থাকতে পারছে, কেন থাকতে পারছে না তা বের করা রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ও সরকারের দায়িত্ব। একই সঙ্গে পণ্যের গুণগতমান উন্নয়নেও সরকারকে কাজ করতে হবে।’ দেশ বহুমুখীকরণ ॥ দেশের পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে গন্তব্য কয়েকটি দেশই। এক্ষেত্রে ইউরোপ ও আমেরিকাই প্রাধান্য পাচ্ছে। একক দেশ হিসেবে আমেরিকা থেকে রফতানি আয় সর্বোচ্চ, যদিও বর্তমানে দেশটিতে জিএসপি সুবিধা স্থগিত রয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আয় হচ্ছে জার্মানি থেকে। এশিয়ার বাজারগুলোকে প্রাধান্য দেয়া হলে ভবিষ্যতে চীন ও জাপান বাংলাদেশের বড় বাজার হয়ে উঠতে পারে। সিপিডি’র গবেষক গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘গার্মেন্টসের বাইরে অন্য পণ্যের চাহিদা আছে এমন দেশে আমাদের নেটওয়ার্কিং বাড়াতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেই আমাদের রফতানি বাড়েনি। রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, লাতিন আমেরিকা বাংলাদেশের জন্য আরও বড় বাজার হয়ে উঠতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারকেই বড় অবদান রাখতে হবে। যেসমস্ত দেশে সুবিধা পেতে পারি সেসব দেশে ডিউটি ফি, ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট ও রুলস অব অরিজিন নিয়ে কাজ করা যেতে পারে।’ আর এ প্রসঙ্গে দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমেদ বলেন, ‘বহির্বিশ্বের অনেক দেশ কম্পিটিশন ডি ভেল্যু করে। এটা তৈরি পোশাক খাতের জন্য চ্যালেঞ্জ। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পণ্যের দাম কমালে আমাদের মুনাফা হ্রাস পায়। তবু কাজ চলছেÑ জাপান, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকার বাজারে প্রবেশের চেষ্টা চলছে। এছাড়া পণ্য বহুমুখীকরণ নিয়েও নতুন নতুন উদ্যোক্তাদের পরামর্শ দিচ্ছি।’ সংশ্লিষ্টরা জানান, সামগ্রিকভাবে রফতানি ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। এক পণ্য নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পারলে হ্রাস পাবে বাণিজ্য ঝুঁকি। সম্ভবনাময় হয়ে উঠবে একাধিক খাত। উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে দেশের রফতানি আয়।
×