ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বেসরকারী কলেজের উচ্চশিক্ষা ব্যয় মেটানো সম্ভব নয় ওসব গরিব ছাত্রছাত্রীর

এবার ২৩ হাজার মেধাবী শিক্ষার্থী মেডিক্যালে পড়তে পারবেন না

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১৫ অক্টোবর ২০১৬

এবার ২৩ হাজার মেধাবী শিক্ষার্থী মেডিক্যালে পড়তে পারবেন না

নিখিল মানখিন ॥ মেধা স্কোরে এগিয়ে থেকেও বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের উচ্চশিক্ষা ব্যয় মেটাতে না পেরে মেডিক্যালে পড়তে পারবেন না অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী। সরকার নির্ধারিত ফি অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থীর এমবিবিএস কোর্স সম্পন্ন করাতে সর্বোচ্চ মোট ১৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা নিতে পারবে বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় অনেক কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীপ্রতি ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা নেয়ার অভিযোগও রয়েছে। আর ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস নম্বর পেয়েও বেসরকারী কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হতে পারবেন না প্রায় ২৩ হাজার ভর্তিযোগ্য প্রার্থী। বেসরকারী কলেজে ৬ হাজার ২০৫ আসনের বিপরীতে রয়েছে ভর্তিযোগ্য প্রার্থী ২৯ হাজার ১৮৩। এর মধ্যে শর্ত ভঙ্গ করায় জরিমানাসহ বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে পড়েছে বেশ কয়েকটি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ। কিছুসংখ্যক কলেজের শিক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে জানান, পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের মধ্যে ন্যূনতম ৪০ পেয়ে ২৯ হাজার ১৮৩ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে। এবারের পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ৮৫ দশমিক ৫ নম্বর পেয়েছে এক শিক্ষার্থী। প্রাপ্ত নম্বর এবং এসএসসি ও এইচএসসির জিপিএর ভিত্তিতে মেধা তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এ বছর ৩০ সরকারী মেডিক্যাল কলেজে ৩ হাজার ২১২ এবং বেসরকারী ৬৪ কলেজে ৬ হাজার ২০৫ জন ভর্তির সুযোগ পাবে। এমবিবিএস প্রথম বর্ষে ভর্তির প্রক্রিয়া ২০ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে বলে মহাপরিচালক জানান। সরকার নির্ধারিত ফি ॥ দীর্ঘ সমালোচনা ও আলোচনার পর বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তি ফি নির্ধারণ করে দেয় সরকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করে। বেসরকারী মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজগুলোর নিজেদের ইচ্ছামতো বাড়তি অর্থগ্রহণ ঠেকাতেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু সরকার নির্ধারিত ফি মেটাতেও পারে না অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থী। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত ওই প্রজ্ঞাপনে জানা যায়, বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলো ভর্তি ফি বাবদ ১৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা নিতে পারবে। ইন্টার্ন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এছাড়া পাঁচ বছরে মোট টিউশন ফি বাবদ ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার বেশি গ্রহণ করতে পারবে না। সরকারের পক্ষ থেকে ফি নির্ধারণ করে দেয়ার ফলে বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ থেকে একজন শিক্ষার্থীর এমবিবিএস ডিগ্রী সম্পন্ন করতে মোট খরচ হবে ১৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। তবে ইন্টার্ন ফি বাবদ কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে যে টাকা গ্রহণ করবে পরবর্তীতে ইন্টার্নশিপের সময় তার লভ্যাংশসহ ফেরত দেবে। অথচ সরকারী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি ফি মাত্র ১২ হাজার টাকা (তিন মাসের টিউশন ফিসহ)। নির্ধারিত ফির দ্বিগুণ খরচ ॥ প্রতি বছরের মতো এবারও ভর্তি ফির বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। গত বছর প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে শুধু ভর্তি ফি ১৪ লাখ ২০ লাখ টাকা নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। আর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর অনেক কলেজে ভর্তির সুযোগ পেতে অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেক শিক্ষার্থীকে দিতে হয়েছে বাড়তি টাকা, যা কাগজে-কলমে লিখিত থাকে না। প্রথম শ্রেণীর মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেতে অনেক শিক্ষার্থীর গোপনে মোটা অঙ্কের টাকা দেয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। ভর্তি পরীক্ষার পাশাপাশি ভর্তি ফি নিয়ে এবারও আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন অনেক মেডিক্যাল ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক। গত সেশনের অভিজ্ঞতা তাদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলো নিজেদের মতো করে বাড়তি ভর্তি ও কোর্স ফি আদায় করে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোর বিরুদ্ধে শিক্ষার নামে বাণিজ্যের অভিযোগ উঠে আসছে। বিগত শিক্ষাবর্ষে ভর্তি ফি, উন্নয়ন ব্যয়, বিধিসহ নামী-বেনামী অনেক খাতের অজুহাত দেখিয়ে চড়া ফি আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। ওই সব প্রতিষ্ঠানের ভর্তি বাণিজ্যসহ নানা নিয়মের বিষয়টি দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মেধাবী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। অনেক মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষাদানের স্থায়ী ও পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই ॥ এদিকে অভিযোগ উঠেছে, বেসরকারী মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজগুলো সরকারী নিয়ন্ত্রণে নেই। অধিকাংশ কলেজ নিজেদের তৈরি নিয়মে চলছে। বেসরকারী মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা আইন-২০১৩ নামের একটি আইনের খসড়া প্রস্তুত করে রেখেছে সরকার। খসড়া আইনটি চূড়ান্ত ও কার্যকর শুরু হলে বিদ্যমান বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোর অধিকাংশই প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। অনেক কলেজের শিক্ষার মান প্রশ্নবিদ্ধ ॥ এদিকে কিছুসংখ্যক বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের কারণে পুরো চিকিৎসা সেক্টর প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি অধ্যাপক মাহমুদ হাসান। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, বিভিন্ন কারণে পর্যাপ্ত দক্ষ চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে না। অনেক বেসরকারী কলেজে শিক্ষক, মেডিক্যাল উপকরণ ও রোগীর সঙ্কট রয়েছে। কিছুসংখ্যক মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতাল পর্যন্ত নেই। হাসপাতাল, রোগী ও পর্যাপ্ত মেডিক্যাল উপকরণ না থাকায় শিক্ষার্থীরা প্রাকটিক্যালে পিছিয়ে পড়ে। নতুন মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আর শিক্ষকদের যোগ্যতা ভালভাবে মনিটরিং করা হয় না। একজন শিক্ষককে শিক্ষাদান ও চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হয়। অনেক সময় শিক্ষাদানের তুলনায় চিকিৎসাদানে বেশি সময় দিতে হয় শিক্ষকদের। অনেক শিক্ষক একাধিক মেডিক্যাল কলেজে সম্পৃক্ত থাকেন। তিনি আরও বলেন, বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোর মান বজায় রাখতে হবে। নিম্নমানের কলেজ থেকে বের হয়ে একজন দক্ষ চিকিৎসক এবং মানসম্মত চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব নয়। এ ধরনের চিকিৎসকরা অনেক সময় জাতির জন্য হুমকি হয়ে ওঠেন। ভাড়াটে ক্যাম্পাসে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ থাকে না। নতুন কলেজ অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও সতর্ক থাকা উচিত। মেডিক্যাল শিক্ষার মানের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, এ বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোর মান বজায় রাখতে হবে। নিম্নমানের কলেজ থেকে বের হয়ে একজন দক্ষ চিকিৎসক এবং মানসম্মত চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব নয়। এ ধরনের চিকিৎসকরা অনেক সময় জাতির জন্য হুমকি হয়ে ওঠেন। দেশের শতকরা ৬০ ভাগ চিকিৎসক বের হয় বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ থেকে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক এএসএম আহমেদ আমীন সাংবাদিকদের জানান, মেধাবী শিক্ষার্থীদের সুযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। মেধা মূল্যায়িত হবে এমন ন্যূনতম নম্বর নির্ধারিত করা দরকার। অনেক কলেজে পুরনো দিনের পাঠ্যপুস্তক দিয়ে আগামী দিনের ডাক্তারদের পড়ানো হয়। কিন্তু মেডিক্যাল প্রযুক্তি প্রতিনিয়তই পরিবর্তন হচ্ছে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের যোগ্যতা নিশ্চিত করার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন অধ্যাপক এএসএম আহমেদ আমীন। নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি নিতে পারবে না তিনটি কলেজ ॥ সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষিত বেসরকারী তিনটি মেডিক্যাল কলেজ চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। মেডিক্যাল কলেজগুলো হলোÑ আশুলিয়ার নাইটিঙ্গেল মেডিক্যাল কলেজ, রংপুরের নর্দান মেডিক্যাল কলেজ এবং গাজীপুরের সিটি মেডিক্যাল কলেজ। বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ পরিচালনা নীতিমালার শর্তপূরণ না করায় গত ১২ জুন ওই তিনটি মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম সাময়িক বন্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে এ তিন প্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির স্থগিতাদেশ বহাল থাকবে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। ১০ কলেজকে জরিমানা ॥ সম্প্রতি ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ১৫৩ শিক্ষার্থী ভর্তিতে সরকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুসরণ না করায় দশটি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজকে এক কোটি টাকা করে জরিমানার নির্দেশ দেয় দেশের সর্বোচ্চ আদালত। কলেজগুলো হলোÑ এমএইচ শমরিতা মেডিক্যাল কলেজ, সিটি মেডিক্যাল কলেজ, নাইটিঙ্গেল মেডিক্যাল কলেজ, জয়নুল হক শিকদার মহিলা মেডিক্যাল কলেজ, ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ, ইস্ট-ওয়েস্ট মেডিক্যাল কলেজ, তাইরুন নেছা মেমোরিয়াল মেডিক্যাল কলেজ, আইচ মেডিক্যাল কলেজ, কেয়ার মেডিক্যাল কলেজ ও আশিয়ান মেডিক্যাল কলেজ।
×