ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিদায় বন্দনা চারুকলায়

হৃদয়ে ছিলে জেগে দেখি আজ শরতমেঘে...

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১৫ অক্টোবর ২০১৬

হৃদয়ে ছিলে জেগে দেখি আজ শরতমেঘে...

মোরসালিন মিজান ॥ এখনও নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। কাশবনে যে দোল লেগেছিল, থামেনি এখনও। শিউলির মিষ্টি ঘ্রাণ অটুট আছে। সব দেখে মনে হয়, শরতের বুঝিবা শুরু হলো! আদতে শেষ। শেষ হতে চলেছে। আজ শনিবার ৩০ আশ্বিন। বিদায় নিচ্ছে শরত। তার একদিন আগে শুক্রবার সকাল সকাল জেগে উঠেছিল চারুকলার বকুলতলা। গান হয়েছে। নাচ হয়েছে। বাদ যায়নি কথা কবিতা। সব মিলিয়ে সুন্দর একটি আয়োজন। দিনব্যাপী আয়োজনের মধ্য দিয়ে শরতকে বিদায় জানায় রাজধানী শহর ঢাকা। সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর আয়োজনে ব্যস্ত নগরীর সবাই ছুটে এসেছিলেন এমন নয়। তবে প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ, শুদ্ধ গানে সুরে নিজেকে খুঁজে ফেরা মানুষ এসেছিলেন আগ্রহ নিয়েই। দুই পর্বের অনুষ্ঠান দারুণ উপভোগ করেন তারা। অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল ৭টায়। তার কিছু আগে গিয়ে দেখা যায় ভেজা, বর্ষণসিক্ত বকুলতলা। হৃদয়ে ছিলে জেগে,/দেখি আজ শরতমেঘে...। সেই মেঘে ধুয়ে সাফ গাছের সবুজ পাতারা। আর নিচে ফুলের সৌন্দর্য। বকুল ফুল যেন বিছিয়ে রাখা হয়েছিল মাটিতে। আর শিউলি ফুল মালা হয়ে স্থান করে নিয়েছিল মেয়েদের খোঁপায়। কেউ কেউ যতœ করে হাতে পেঁচিয়ে নিয়েছিলেন। পোশাকে ছিল সাদা আর নিলের উপস্থিতি। সব মিলিয়ে চমৎকার আবহ। ঠিক তখন বেজে ওঠে অসিত বিশ্বাসের এস্রাজ। বেশ কিছু সময় ধরে চলে রাগসঙ্গীত। পর পরই মঞ্চে আসেন প্রিয়াঙ্কা গোপ। এই কণ্ঠের জাদু সম্পর্কে সবাই কম বেশি অবগত এখন। বরাবরের মতোই কণ্ঠটাকে বাজান শিল্পী। দারুণ খেলে যান। ছয় মিনিটের পরিবেশনা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেন শ্রোতা। মুগ্ধতা কাটতে না কাটতেই মঞ্চে আসে নটরাজ। নাচের মুদ্রায় শরতের বন্দনা করে একদল শিশু শিল্পী। ব্যাকগ্রাউন্ডে তখন বাজছে- আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা।/ নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই- লুকোচুরি খেলা...। কচিকাঁচা বটে। সুন্দর কোরিওগ্রাফি। দলীয় পরিবেশনা উৎসবের রং ছড়িয়ে দেয় গোটা এলাকায়। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় নাচ নিয়ে আসে নৃত্যজন। খুব পরিচিত একটি গানের সঙ্গে নাচেন শিল্পীরা। গানটি- শরৎ তোমার শিশির ধোওয়া কুন্তলে,/বনের-পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে/ আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি...। ‘আজ শরতের আলোর বাশি বাজলো’ গানের সঙ্গে নাচে নৃত্যাক্ষ। স্পন্দনের শিল্পীদের নাচও ছিল উপভোগ্য। দলীয় সঙ্গীতের প্রথম পরিবেশনাটি নিয়ে আসে সুরসপ্তক। শিল্পীরা গানে গানে শরৎ নয় শুধু, অন্য ঋতুগুলোরও যৎকিঞ্চিত বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করেন। আয়োজক সংগঠন সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী গায় ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ গানটি। পঞ্চভাস্বরের শিল্পীরা কবিগুরু থেকে গেয়ে যান- আমার নয়ন-ভুলানো এলে।/ আমি কী হেরিলাম হৃদয় মেলে...। ওস্তাদ মোমতাজ আলী খান সঙ্গীত একাডেমির শিল্পীরা শোনায় লোকজ সুর। বিমান চন্দ্র বিশ্বাসের কণ্ঠেও ছিল লোকায়ত সুরের মুর্ছনা। তার গাওয়া ‘আজ শরতের আকাশে ভাসে সাদা মেঘের ভেলা’ গানটির কথা কবিগুরু দ্বারা প্রভাবিত। সুর আর গায়কীর জন্য মন্দ লাগে না। বিজন চন্দ্র মিস্ত্রির কণ্ঠে ছিল ‘শিউলি ফুলে মালা দোলে’। মহাদেব ঘোষের গানে বিদায়ের সুর বাজে। তিনি গেয়ে যান- আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে।/ বাঁশি, তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে।/তোমার বুকে বাজল ধ্বনি/বিদায়গাথা, আগমনী, কত যে...। গান নাচের পাশাপাশি ছিল কবিতার আয়োজন। অনুষ্ঠান মঞ্চে কবিতা নিয়ে আসেন নায়লা তারান্নুম কাকলী। তার আবৃত্তিতে ঠিক শরত ছিল না। সদ্য প্রয়াত কবি সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা থেকে আবৃত্তি করেন তিনি। কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানান। অনুষ্ঠানের শরত কথন পর্বে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। অতিথিদের নিয়ে মঞ্চে ওঠেন আয়োজক গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট। বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। একেকটি ঋতু একেকভাবে প্রকৃতিকে সাজায়। বাঙালীর মনকে রাঙিয়ে দিয়ে যায়। অত্যন্ত প্রিয় ঋতু শরতের বেলায় কথাটি আরও বেশি সত্য। শরত এলে প্রকৃতিতে নতুন প্রাণের ছোঁয়া লাগে। নীল আকাশের দিকে তাকালে ব্যস্ত নাগরিক জীবনের ক্লান্তি ভুলে যায় শহুরে মানুষ। শরত বন্দনার জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান বক্তারা। বিকেলেও ছিল অভিন্ন আয়োজন। চলে রাত পর্যন্ত।
×