ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে পাক হস্তক্ষেপে আমরা হতাশ ॥ শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৫ অক্টোবর ২০১৬

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে পাক হস্তক্ষেপে আমরা  হতাশ ॥  শেখ হাসিনা

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ সম্প্রতি ভারতের বহুল প্রচারিত ইংরেজী দৈনিক ‘দ্য হিন্দুকে’ একান্ত ও বিশদ সাক্ষাতকার দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাক্ষাতকারে বাংলাদেশের সার্ক সম্মেলনে না যাওয়ার কারণ, পাকিস্তানের সন্ত্রাস রফতানি, পাক-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের টানাপোড়েন, চীনা প্রেসিডেন্টের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর, হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলা, প্রেস ফ্রিডম ও সাম্প্রতিক নানা বিষয়ে কথা বলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। ব্রিকস-বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে ভারত যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে এই বিরল সাক্ষাতকারটি দেন শেখ হাসিনা। এ সময় নিয়ন্ত্রণ রেখা মেনে চলতে ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি পরামর্শ দেন তিনি। সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেন সাংবাদিক সুহাসিনী হায়দার। ওই সাক্ষাতকারের চুম্বকাংশ জনকণ্ঠ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো : প্রথমেই বাংলাদেশের সার্ক সম্মেলনে না যাওয়া প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ইসলামাবাদের সন্ত্রাসবাদে মদদ দেয়া নিয়ে বাংলাদেশ ‘হতাশ। তবে এই সম্মেলনে ভারত ও বাংলাদেশের না যাওয়ার কারণ সম্পুন্ন ভিন্ন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা মূলত পাকিস্তানের সন্ত্রাস রফতানি বিষয়ে হতাশ। সন্ত্রাসবাদ সব জায়গায় ছড়িয়েছে। এ কারণে আমাদের অনেকেই পাক জনগণের ওপর অসন্তুষ্ট। আর ভারত সার্ক সম্মেলন থেকে সরে এসেছে উরি হামলার কারণে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেছেন, সার্ক সম্মেলন থেকে সরে আসার পেছনে তার সরকারের অন্যতম প্রধাণ কারণ হলো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিচার ও সাজা কার্যকর নিয়ে পাকিস্তান কঠোর সমালোচনা করে। এই বিষয়টিতে ঢাকা চরমভাবে হতাশ হয়েছে। তিনি বলেন, পাকিস্তানের এই ধরনের আচরণে দেশটির সঙ্গে সকল কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে আমার ওপর চাপ ছিল। তা সত্ত্বেও আমি বলেছি, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বজায় থাকবে। এবং আমাদের দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যারও সমাধান করতে হবে। তিনি বলেন, প্রকৃত কারণ হলো আমরা পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি। আর পাকিস্তান পরাজিত শক্তি। এ সময় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তার কথা স্মরণ করেন শেখ হাসিনা। পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ রেখায় ভারতের সাম্প্রতিক আক্রমণ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ রেখা মেনে চলা উচিত। তাহলেই শান্তি আসবে। আশির দশকে বাংলাদেশই সার্কের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দেশ ছিল। কিন্তু এই বছর পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বর্জন করল বাংলাদেশ। এ ঘটনার মধ্যে দিয়ে কি সার্ক শেষ হয়ে গেল? এই প্রশ্মের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, না কারণটা ঠিক তা নয়। সার্ক সম্মেলন বর্জন বিষয়ে আমরা আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছি। আমার মনে হয় এই অঞ্চলের বর্তমান পরিবেশে এখন সার্ক সম্মেলনে যাওয়ার প্রকৃত পরিবেশ নেই। আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) একটি স্পর্শকাতর বিষয়। কিন্তু পাকিস্তান এই বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। এমনকি সেদেশের পার্লামেন্টেও এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পাকিস্তান অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য করে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা শুরু করেছিল। এতে আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটা তাদের (পাকিস্তানের) কোন বিষয় নয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- এবং গুমের মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ চালানোর কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সমর্থন হারাচ্ছে। এই প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক যে মানবাধিকার সংগঠনগুলো ভুক্তভোগীদের চেয়ে অপরাধীদের অধিকারের পক্ষেই বেশি সোচ্চার। এ সময় তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে কী হচ্ছে? যখন সেদেশের স্কুল কিংবা অন্য কোথাও হামলা হয় তখন সেখানকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কী করে? তারা কি হামলাকারীদের হত্যা করে জিম্মিদের উদ্ধার করে না? নিজেদের ওপর হামলা করলে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি হামলাকারীদের হত্যা করবে না? চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ে বাংলাদেশ সফর। এই দুই নেতার ব্রিকস-বিমসটেক সম্মেলনে যোগদান। এবং চীনের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কের বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে দিল্লী। বেজিংয়ের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কের কারণে কি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসার বিষয়টি পিছিয়ে যাবে? এ প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, প্রকৃতপক্ষে ভারতের সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে। বিশেষ করে ২০০৭-২০০৮ সালে ভারত বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত কোটা দেয়ার পর। আমরা একসময় ভারত থেকে খাদ্য আমদানি করতাম। কিন্তু আমরা এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর এই কারণেই আমার মনে হয় ভারতের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা কমছে। আমরা এখনও অনেক প্রধান প্রধান দ্রব্য ভারত থেকে আমদানি করি। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভাল। এই সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাবে। চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার, প্রতিরক্ষা অংশীদার। বাংলাদেশ চীনের ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ উদ্যোগে বড় ভূমিকা পালন করেছে। আঞ্চলিকভাবে বাংলাদেশ চীনের কথিত ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ হয়ে উঠছে বলে ভারতের যে উদ্বেগ রয়েছে তা কি বাস্তবসম্মত নয়? এই প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আপনারা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার ভাল সম্পর্কের কথা বলেছেন। আপনাদের যদি সেটা মনে হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকছে বলে কী করে অভিযোগ করতে পারেন? আমাদের নীতিমালা খুব পরিষ্কার। আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রয়েছে এবং আমরা তা বজায় রাখতে চাই। আমি বিশ্বাস করি সুসম্পর্কের জন্য কানেকটিভিটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিআইএন নেটওয়ার্ক স্থাপন করেছি এবং এর ফলে ভুটান, ভারত এবং নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল হয়েছে। চীন, ভারত আর মিয়ানমারের সঙ্গেও আমরা বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডর স্থাপন করেছি যেন আমরা সবাই একসঙ্গে হয়ে নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য বাড়াতে পারি। আর তাতে আমাদের জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল হবে। আমাদের জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। আর তাতে আমাদের অঞ্চলে সবচেয়ে লাভবান কে হবে? ভারত। বাংলাদেশের বাজারে ভারতই বেশি সুবিধা নিতে পারে। আপনাদের সেটা অনুধাবন করা প্রয়োজন। গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলা হওয়ার পর আপনার সরকার বলেছিল যারা হামলায় জড়িত তারা আইএস সদস্য নয়, স্থানীয়। কিন্তু যেখানে আইএসের পক্ষ থেকে এ হামলার দায় স্বীকার করা হয়েছে, যেখানে প্রধান সন্দেহভাজনই আইএস দ্বারা প্রশিক্ষিত সেক্ষেত্রে অভিযোগটি অস্বীকার করার ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী? এই প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘হতে পারে তাদের কেউ কেউ আইএস দ্বারা উদ্বুদ্ধ। তবে এখানে আইএসের কোন সাংগঠনিক অস্তিত্ব নেই। কারও কাছে এখানে আইএসের ঘাঁটি থাকার প্রমাণ থাকলে সেই প্রমাণ দেয়া উচিত। আমরা হামলাকারীদের শনাক্ত করেছি। আমরা জানি তারা কোথা থেকে এসেছে। তারা স্থানীয়।’ গণতন্ত্রের আরেকটি অংশ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। এরপরও সম্প্রতি একজন স্বনামধন্য সম্পাদককে গ্রেফতার, কঠোর সাজার বিধান রেখে নতুন ডিজিটাল আইন চালুর মধ্য দিয়ে সেই ইঙ্গিতই মিলছে যে আপনি সংবাদমাধ্যমকে কঠোর হাতে দমন করছেন.... এই প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনার উত্তর ছিল... আমি যখন ক্ষমতায় এসেছি তখন আমাদের একটিমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল ছিল, এখন ২৩টি চ্যানেল রয়েছে। কারা চালু করেছে এগুলো? কারা শত শত সংবাদপত্রকে অনুমোদন দিয়েছে? আর যদি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাই না থাকত তবে স্বাধীনতা যে নেই এ কথাটিই বা তারা লেখার সুযোগ পায় কিভাবে? আমরা সম্পাদক শফিক রেহমানকে অন্য অপরাধে গ্রেফতার করেছি। তিনি যদি দেশবিরোধী কাজ করেন তবে তাকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। বাংলাদেশে তো অনেক সম্পাদক রয়েছেন। কয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে?’ চলতি সপ্তাহে ব্রিকস-বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে আপনি ভারত যাচ্ছেন। আর চলতি বছরের পর আপনার ভারতে দ্বিপাক্ষিক সফরে যাওয়ার আশা করা হচ্ছে। এই সফরে আপনি কি অর্জন করতে চান? এই প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, এই অঞ্চলের প্রধান প্রধান সমস্যা প্রায় সমান। আমাদের অভিন্ন শত্রু দারিদ্র। এই দারিদ্র নিমর্ূূলে আমাদের অবশ্যই লড়াই করতে হবে। তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের বিদ্যমান অনেক সমস্যা রয়েছে। আমি মনে করি এসবের সমাধান করতে হবে। আর বাংলাদেশÑভারত গঙ্গার পানি চুক্তি সম্পন্নের মাধ্যমে ইতোমধ্যে কিছু সমস্যার সমাধান করেছে। তিনি বলেন, আমি আশা করছি বিমসটেক নেতারা বিমসটেককে একটি নতুন উন্নয়ন ব্যাংক গঠনে সহায়তা দেবে।
×