ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চীনের সঙ্গে সম্পর্কের সেতুবন্ধ পদ্মা সেতু

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১৫ অক্টোবর ২০১৬

চীনের সঙ্গে সম্পর্কের সেতুবন্ধ পদ্মা সেতু

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মাওয়া থেকে ফিরে ॥ শরত বিদায় নিচ্ছে। একদিন বাদেই হেমন্ত। ধবল শিশিরের বিন্দু বিছিয়ে পড়ছে পদ্মা তীরে ঘাসে। ভোরের এই অপরূপ দৃশ্য দেখতেই আবার সোনা রোদ সবকিছুতে এক চাঙ্গা ভাব ছড়িয়ে দিচ্ছে। নীল আকাশে মেঘের ভেলা। মেঘের ছোটাছুটি আর মেঘের ডাকের মাঝে কখনও বৃষ্টির ছটা। সব কিছুতেই যেন এক ছন্দ। এরপর সন্ধ্যার রূপ এর চেয়ে কম ভাল লাগার নয়। প্রকৃতিতে এই বিশেষ রূপ আর ছন্দেই এগুচ্ছে পদ্মা সেতুর নির্মাণযজ্ঞ। হরদম কাজ চলছে। পদ্মায় কাজে সকলেই বিশেষ এক ছন্দে এগুচ্ছে। তাই চারদিকেই যেন সেতু তৈরির অগ্রগতির ছোঁয়া। পদ্মা সেতুর কাজে নিয়োজিত কয়েক হাজার কর্মীর মধ্যে বিদেশী ৪৫৯ জন। এর মধ্যে চীনা নাগরিকই অধিকাংশ। শুক্রবার চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরে এসেছেন তাই তাদের মধ্যে একটু বেশিই ভাল লাগার। নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক এক চীনা প্রকৌশলী মনে করেন, পদ্মা সেতু যেমন বাংলাদেশের জন্য অগ্রগতির মাইলফলক। আবার চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্কের সেতুবন্ধন হয়ে থাকবে এই পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতুর অগ্রগতির নানা খবর জমা হয়েছে গত সাত দিনে। এর অন্যতম হচ্ছে- এক হাজার টন ধারণক্ষমতার ভাসমান ক্রেন চীন থেকে চট্টগ্রাম পোর্টে এসে পৌঁছে গেছে। পদ্মা সেতুর নতুন হ্যামারের জন্য এই বিশাল ক্রেন আনা হয়েছে চীন থেকে। গত ১০ অক্টোবর এটি পোর্টে পৌঁছার পর এখন কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের কাজ চলছে। এরপরই টাক বোর্ট ভাসমান ক্রেনটিকে টেনে নিয়ে আসবে মাওয়ায়। এদিকে দুই হাজার কিলো জুল ক্ষমতার জার্মানি হ্যামারবাহী চালানটি এখন বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি। আগামী ১৮ অক্টোবর এটি মংলা পৌঁছার কথা রয়েছে। এদিকে পদ্মা সেতুর অবিরাম কাজে নতুন গতি এসেছে সংযোগ সেতুর (ভায়াডাক্ট) কাজে। জাপানের উচ্চপর্যায়ের টেকনেশিয়ান ঘুরে যাওয়ার পর থেকে এই কাজে গতি এসেছে। আজ শনিবার জাজিরা প্রান্তে সংযোগ সেতুর আরও দুটি পাইল স্থাপন শুরু হচ্ছে। এর আগে আরও চারটি পাইল স্থাপন হয়। জাপানী প্রফেসনাল সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার সোতমো কানামরির নেতৃত্বে কনিয়া ওবা এবং মাসাকাজু ইয়ামাউচু হাতে-কলমে নানা বিষয় প্রশিক্ষণ দিয়েছেন কর্মরত প্রকৌশলীদের। চারদিনের সফরে তারা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাটির তলদেশের পাইলের অবস্থান নিশ্চিত করছেন। জাপানী ইকো সাউন্ডার যন্ত্রটি প্রকল্প এলাকায় আগে থেকেই আনা হয়েছিল। কিন্তু এটি যথাযথভাবে ব্যবহারের নিশ্চিত করছেন দলটি। পরে বিশেষ নিরাপত্তায় তারা শনিবার আবার জাপান ফিরে যান। আরও নতুন খবর হচ্ছে- চীন থেকে ১৭ হাজার টন স্ট্রিল প্লেটের বিশাল চালান বৃহস্পতিবার মাওয়ায় পৌঁছেছে। ৬০ মিলি ভারি এই স্ট্রিল প্লেড দিয়েই স্টিলের পাইল তৈরির করা হবে। পদ্মা সেতুর জন্য এমন ২৪০টি স্টিলের পাইল প্রয়োজন হবে। এ পর্যন্ত প্রায় ৬৫ শতাংশ অর্থাৎ ১৮৫টি স্ট্রিল পাইল তৈরি হয়ে গেছে। আবার যার মধ্যে ৩৭টি নদীতে স্থাপন হয়েছে। তবে আরও বাকি স্টিল পাইল তৈরির জন্যই এই স্ট্রিল প্লেড আনা হয়েছে। এই স্ট্রিল প্লেড দিয়ে পাইলের ৯৫ শতাংশ কাজই সম্পন্ন করা যাবে। এদিকে নতুন শুষ্ক মৌসুমে নদী শাসনের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আসন্ন শুষ্ক মৌসুমে নদী শাসনের কাজের কর্ম পরিকল্পনা দিয়েছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দেয়া এই কর্মপন্থা যাচাই বাছাই করছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। নতুন মৌসুমের কর্মপন্থা বিষয়ে অনুমতি পেলেই পরবর্তী মৌসুমের কাজ শুরু হবে। অনুমতি পাওয়ার পরপরই ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই মাওয়া প্রান্তে পুরোদমে নদী শাসনের কাজ শুরু হবে। পদ্মা সেতু পাল্টে দেবে প্রকল্প এলাকার চেহারা। অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের পাশাপাশি এলাকার পর্যটন খাতে যোগ করবে নতুন মাত্রা। বিশেষ করে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রকল্প এলাকায় নির্মিত সার্ভিস এরিয়াগুলোর কাজ শেষে সাধারণের জন্য খুলে দেয়া হলে তার সুফল পাবেন দেশের পর্যটনপ্রেমীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি মাসের মধ্যেই সার্ভিস এরিয়া নির্মাণের কাজ শেষ হবে। এ যেন ধীরে ধীরে গড়ে উঠা এক নতুন শহর। অজস্র স্বপ্নকে বুকে নিয়ে যা জেগে উঠছে উত্তাল পদ্মা নদীর পাড়ে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত যে স্বপ্ন, তার কাজের সুবিধার জন্য মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর এবং মাদারীপুরে গড়ে তোলা হয়েছে তিনটি সার্ভিস এরিয়া। এর মধ্যে এক ও দুই নম্বর সার্ভিস এরিয়ায় মূল সেতু, নদী শাসন প্রকল্প ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা থাকছেন। ৩ নম্বর সার্ভিস এরিয়ায় থাকার ব্যবস্থা হয়েছে সেনা কর্মকর্তাদের। আপাতত এই ৩টি সার্ভিস এরিয়া দেশী-বিদেশী প্রকৌশলী, বিশেষজ্ঞদের আবাসন এবং গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হলেও এগুলোকে ঘিরেই পদ্মার দু’পারে গড়ে উঠছে পর্যটন সম্ভাবনা। বিশেষ করে দুই নম্বর সার্ভিস এরিয়াটিকে পুরোপুরি গড়ে তোলা হচ্ছে পর্যটনবান্ধব করে। তিনটি সার্ভিস এরিয়া নির্মাণে সার্বিক তদারকি করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সেতুর কাজ শেষ হলে ৭৭ হেক্টর এলাকা জুড়ে নির্মিত দুই নম্বর সার্ভিস এরিয়ায় পর্যটকদের জন্য থাকবে আবাসনের পাশাপাশি আধুনিক সব সুবিধাই। চলতি মাসের মধ্যেই নির্মাণকাজ শতভাগ শেষ করে সার্ভিস এরিয়াগুলো সেতু বিভাগের হাতে হস্তান্তর করার কথা রয়েছে। অবিরাম চলছে পদ্মা সেতুর কাজ। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে দ্বিতল বিশিষ্ট সেতুটি নির্মাণে এক নতুন ধাপ অতিক্রম করছে। ১৫০ মিটার পরপর পিলার ৪২টি পিলারের ওপর সেতুটি বসাতে চলছে নানা কাজ। এখন সুপার স্ট্রাকচার জোড়া লাগানোর কাজও এগিয়ে চলেছে। তাই সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছে ডিসেম্বরের মধ্যেই পদ্মা সেতুর দৃশ্য হতে শুরু করবে। সেভাবেই ৩৭, ৩৮ ও ৩৯ নম্বর পিলার তৈরি হচ্ছে। এই তিন পিলারের উপরই দুটি সুপার স্ট্রাকচার স্থাপনের কথা রয়েছে। মাওয়ার কুমারভোগের ওয়ার্কসপেই সুপার স্ট্রাকচার ফিটিংকরা হচ্ছে। এরপর ক্রেনে করে স্থাপন করা হবে এই পিলারের ওপর। এরপর দ্বিতল এই সুপার স্ট্রাকচার নাটবল্টু দিয়ে এমনভাবে পিলারের সঙ্গে লাগিয়ে দেয়া হবে যে ট্রেন আর বাস চলচল করবে এর ওপর দিয়েই। ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ের সেতুটি চার লেনবিশিষ্ট সেতুটিতে মোট ৪১টি স্প্যান (অংশ) থাকছে, যার প্রতিটির দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান আব্দুল কাদের জনকণ্ঠকে জানান, স্প্যান বড় হওয়ার কারণে রিইনফোর্সড কংক্রিট দিয়ে তৈরি না করে ওজন কমাতে এই সেতুটির মূল অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে স্টিল দিয়ে। তীব্র বায়ুপ্রবাহ ও ভূমিকম্পজনিত ধাক্কা মোকাবেলায় বেছে নেয়া হয়েছে ওয়ারেন ট্রাস ফর্ম। পুরো সেতুটির ভার বহন করার জন্য থাকছে ৪২টি পিয়ার (পিলার), যার প্রতিটির নিচে থাকছে গড়ে প্রায় ৬টি পাইল। পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সায়েদুল আলম পিপিএম জনকণ্ঠকে জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাইরে মাওয়ায় একটি চীনা রেস্টুরেন্ট করা হয়েছিল। যেখানে চাইনিজরা নিয়মিত আসতেন। কিন্তু প্রকল্প এলাকার বাইরে এই রেস্টুরেন্ট থাকায় যথাযথ নিরাপত্তা বেস্টনীর মধ্যে রাখা যাচ্ছিল না। তাই এই রেস্টুন্টে শুক্রবার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে এই বারটি (রেস্টুন্টে) প্রকল্প এলাকার ভেতরে করার জন্য। সেভাবেই এখন চাইনিজরা রাজি হয়েছে। পদ্মা সেতু এলাকায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে বলে এসপি জানান।
×