ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাইফুজ্জামান

অসময়ে তাঁর চলে যাওয়া

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ১৪ অক্টোবর ২০১৬

অসময়ে তাঁর চলে যাওয়া

রতনতনু ঘোষ প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, কবি ও সংগঠক। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৩ অক্টোবর ২০১৬ তারিখ পৃথিবীর এই রৌদ্র ছায়া ছেড়ে চলে গেছেন অনন্তলোকে। জন্ম, মৃত্যুর ওপর আমাদের হাত নেই। কিন্তু কর্ম নিয়ে মূল্যায়ন করার মানসিকতা সিংহভাগ মানুষের আছে। আবার কেউ কেউ আছেন উন্নাসিক। এ সব কথা বলছি এ কারণে রতনতনু ঘোষের মৃত্যুর পর নানা কথার গুঞ্জরণ চলছে চারদিকে। বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য, তরুণ লেখক প্রকল্পের পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকের বাংলা একাডেমিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের সুযোগ দেয়া হয়নি এ খবর শুনে ব্যক্তিগতভাবে আমি মর্মাহত। রতনতনু ঘোষ লিখিত গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত তালিকা : বাংলাদেশের রাজনীতি, প্রত্যাশা ও বাস্তবতা, আলোকিত বাংলাদেশ, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু, বাঙালী মননে ধর্ম ও প্রগতি, সাক্ষাতকার সমগ্র, অগ্রসর বাংলাদেশ, অপরাজেয় বাংলাদেশ, ভাষা আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি, বাংলাদেশের সাহিত্য, আলোকিত বাংলাদেশের পথ, শেখ মুজিব জনকের প্রতিচ্ছবি, রতনতনু ঘোষের সংলাপ, সাহিত্যের স্বদেশ ও বিশ^, কবিতা দেশে দেশে (রতনতনু ঘোষ সম্পাদিত), কবিতা সমগ্র, স্বদেশ সমাজ, সাহিত্য, ভবিষ্যত চিন্তা সমাজ সভ্যতা, সংস্কৃতি, রতনতনু ঘোষের কথন বিশ^, ভ্রমণের আনন্দ বাংলাদেশ, বহুমাত্রিক বিশ^ায়ন (রতনতনু ঘোষ সম্পাদিত), বিশ^ায়নের রাজনীতি, উত্তরাধুনিকতা (রতনতনু ঘোষ সম্পাদিত) উত্তরাধুনিক চিন্তাধারা দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ-রাষ্ট্র, রাজনীতি ও জনগণ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল সম্পর্ক, কবিতা বিষয়ক কথা, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র (রতনতনু ঘোষ সম্পাদতি), মুখোমুখি সংলাপ। তিনি এক ধরনের মানুষের কাছে বিশিষ্ট ছিলেন না। তবু তিনি যা করেছেন তার কিয়দংশ করতে পারে মানুষ। মানুষের সীমাবদ্ধতা আছে। নব্বই দশকে তিনি যখন ঢাকা শহরে স্থায়ী হননি তখন তিনি মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে চাকরিস্থল ও পত্রিকায় আড্ডা দিয়ে মুন্সীগঞ্জে ফিরে যেতেন। দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। পরিচয় থেকে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে ব্যস্ততার কারণে দেখা সাক্ষাত কম হলেও টেলিফোনে কথা হতো নিয়মিত। একবার কারও সঙ্গে পরিচয় হলে তিনি ধরে রাখার চেষ্টা করতেন। শাহবাগ, আজিজ মার্কেট, ধানম-ি তেজগাঁও-এর বিভিন্ন আড্ডা ঘিরে কত সময় আমাদের চলে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। এসব আড্ডায় অনেক থাকতেন। এখনও সে সব আড্ডা আছে। শুধুমাত্র রতনতনু ঘোষ আর উপস্থিত থাকবেন না এ সব আড্ডায়। প্রিয় মানুষদের জন্মদিন কিংবা বই প্রকাশের মুহূর্তে উল্লাশ প্রকাশ করবেন না। সংখ্যা কিংবা মানের দিক থেকে রতনতনু ঘোষের রচনা মান সম্মত ছিল না, এ কথা তার শত্রুরাও বলতে পারবে না। নীরবে নিভৃতে থেকে গেছেন। প্রচারের আলোয় আসেননি তিনি। রতনতনু ঘোষ আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। সুখ দুঃখে আমরা হেঁটে চলেছি অনেক দূর পথ। রতনতনু ঘোষ সমাজকর্ম ও বাংলায় এমএ করে সার্বক্ষণিক লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন। দৈনিক আজকের কাগজ, অগ্রসর দৈনিক ছিল। মুক্ত চিন্তা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে এ পত্রিকার একঝাঁক তরুণ ও প্রবীণ লেখকের সঙ্গে রতনতনু ঘোষ সহযাত্রী ছিলেন। একটা সময় ছিল নিয়মিত কলাম রচনার পাশাপাশি বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছেন তিনি। স্বৈরাচার ও সামরিক সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তিনি অন্যান্য কলাম লেখকের মতে নিয়মিত করাম লিখেছেন। প্রতিবাদ প্রতিরোধে ফুঁসে উঠেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার প্রতি তার আনুগত্য ছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিনি গ্রন্থ রচনা করেছেন। জীবনের শেষ ভাগে এসে তিনি কবিতা রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রেম, প্রকৃতি, বিরহ ও সাধারণ মানুষের সুখদুঃখ ব্যক্তিগত কথকতা তার রচনার মুখ্য প্রতিপাদ্য ছিল। তিনি একজন পরিশ্রমী লেখক ছিলেন। মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজে অধ্যাপনার দায়িত্ব পালনকালে সমাজকর্ম বিষয়ে পাঠদান, পরীক্ষার খাতা দেখা, প্রশ্নপত্র তৈরি করা, পরীক্ষা নেয়া ছাড়াও ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দেয়া ছাড়াও ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা ভ্রমণে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ছিলেন। বিভিন্ন উৎসব উদযাপন কমিটিতে তার অন্তর্ভুক্তি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ও প্রয়োজনীয়। সততা ও দায়িত্বশীলতার কারণে তিনি সবার কাছে গ্রহণীয় ছিলেন। ছোট ভাইবোনদের লেখাপড়া করানোর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তাদের সংসার জীবনে প্রবেশ করানো, পেশা গ্রহণে উৎসাহিত করতে রতনতনু অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ড. আহমদ শরীফ ও সরদার ফজলুল করিম, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ভাষা মতিন, সৈয়দ আবুল মকসুদ, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা প্রমুখ বিখ্যাত মনীষীদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক মধুর ছিল। এ সব বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের পরিবার, স্বজনদের সঙ্গে তাঁর এক অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছিল। সরদার ফজলুল করিমকে নিয়ে তিনি রচনা করেছিলেন ‘সরদারের সংলাপ’ শীর্ষক গ্রন্থ। তিনি ড. আহম্মদ শরীফের জীবনী রচনার কাজটি শুরু করেছিলেন। বিখ্যাত মনীষীদের জীবনী গ্রন্থ রচনা করেছেন। যে দেশে দলবাজি ও বিশেষ মহলের অনুগ্রহ ও আশীর্বাদ না থাকলে পুরস্কার সম্মাননা পাওয়া যায় না। সে দেশে রতনতনু ঘোষ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার, বিশেষ সম্মাননা পাবেন আশা করা যায় না। তাঁর ভাগ্যে বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পের পুরস্কার ছাড়া তেমন পুরস্কার জোটেনি ঠিক। তিনি অপরিচিত ছিলেন একথা বলা যায় না। তিনি অমর্ত্যসেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ অসংখ্য মনীষীর সান্নিধ্যে এসেছিলেন। সাক্ষাতকার গ্রহণ, ভাব বিনিময়, আড্ডাতেও তিনি এদের সঙ্গী ছিলেন বহুবার। পুরনো পত্রপত্রিকা ঘাটলে এসব তথ্য পাওয়া যাবে। রতনতনু ঘোষ একজন লেখক ছিলেন। অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেও তিনি ব্যক্তিবিশেষের কাছে সমাদৃত হতে পারেননি। এ লজ্জা আমাদের সকলের। ব্যক্তিগতভাবে জীবিত অবস্থায় কারো ওপর কারো অভিমান কিংবা বিরাগ থাকতে পারে। থাকেও। কিন্তু মৃত্যুর পর সবাই এর উর্ধে চলে যায়। রতনতনু ঘোষ সবকিছুর উর্ধে। তার বিধ্বাস্ত্রী, ভাইবোন, মা ও আত্মীয়স্বজন তাদের প্রিয় মানুষকে হারিয়েছেন। এ শূন্যতা তাদের পূরণ হওয়ার নয়। রতনতনু ঘোষ বিড়ালের গলায় ঘণ্টি বাঁধার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। লেখকদের সংগঠিত করা, সাধারণ মানুষকে কবিতা অনুরাগী করে তোলার পেছনে তিনি নিরন্তর পরিশ্রম করেছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি সাহিত্য কর্মের পেছনে ছুটেছেন। তিনি সমাজের অসঙ্গতি দেখে ফুঁসে উঠেছেন। ভাষা শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। অথচ হঠাৎ তিনি চলে গেলেন। তার এই অগস্ত্য যাত্রার পর পৃথিবী আগের মতোই চলছে। কোথাও কোন ক্রন্দন নেই। চোখ ভারি হয়ে আসছে শুধুমাত্র প্রিয় মানুষ ও বন্ধুদের। তাঁর কথা কর্তব্য, টুকরো স্মৃতি কেবলই মনে পড়ে। এক সময় এসব কিছুও মিলিয়ে যাবে। বিনয়, আন্তরিকতা, সদাচরণ মানুষের ভূষণ। আমাদের সমাজ থেকে ক্রমে ক্রমে এ সব হারিয়ে যাচ্ছে। মানবিক গুনাবলীর অন্তর্নিহিত সমাজ ক্রুরতা, হিংস্রতা ও পরশ্রীকাতরতায় আক্রান্ত। আমরা মুখ ফিরিয়ে থাকব তাতো হয় না। দিল খোলা মনের মানুষ রতন তনু ঘোষের জন্ম ১৯৬৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর। কেকে উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, হরগঙ্গা কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। মুন্সীগঞ্জে বেড়ে ওঠা সমাজ কর্ম ও বাংলায় এমএ-তে সর্বশেষ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে তার লেখাপড়া। স্থিত হয়েছিলেন মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজে অধ্যাপনা সূত্রে। ঢাকার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত তিনি চষে বেড়িয়েছেন। বস্তবতা এক তিনি চলে গেছেন। যারা আমরা দীর্ঘদিন তার সাহচর্য উপভোগ করেছি তাদের স্মৃতিতে তিনি চির জাগরুক। মধ্য দুপুরে কিংবা গভীর রাতে তার ডাক পাব না ফোনে কিংবা সাক্ষাতে। বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা তার সঙ্গে হয়েছে। আবার সাধারণ বিষয় নিয়েও তর্ক বিতর্ক হয়েছে। দর্শন, রাজনীতি সাহিত্য নিয়ে তার সঙ্গে একান্ত আড্ডা হয়েছে। তিনি এখন স্মৃতি। রতনতনু ঘোষ একজন শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক ছিলেন। তাঁর অগ্রন্থিত রচনা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এগুলো গ্রন্থিত হওয়া জরুরী। কোন প্রতিষ্ঠান কিংবা প্রকাশনা সংস্থা তাঁর অগ্রন্থিত রচনা প্রকাশের উদ্যোগ নিলে তাঁকে সম্মান দেখানো হবে। বিস্মৃতি প্রবণ জাতি আমরা। ভয় হয় তিনি না অন্য সব শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যের মতো হারিয়ে না যান। রতনতনু ঘোষের আত্মার শান্তি কামনা করছি। আমরা নিয়তি নির্ভর মানুষ। কত কাছের মানুষ চলে যায়। রতনতনু ঘোষ দুই হাতে লিখেছেন। যে কোন বিষয় নিয়ে লিখতে বললে লিখতে পারতেন। একাকীত্ব, দুঃখ বেদনা কাজ তাঁকে লেখালেখি থেকে বিরত রাখতে পারেনি। ব্যস্ত মানুষ হয়ত শরীরের দিকে খেয়াল দিতে পারেননি। তাইতো চলে গেলেন অকালে, অসময়ে। অনন্তলোকে যেখানেই থাকুন না কেন আমাদের দীনতা ক্ষমা করবেন রতনতনু ঘোষ। আমরা জীবিত বা মৃত কাউকে সম্মান করতে জানি না।
×