ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জার্নাল নুরুল করিম নাসিম

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ১৪ অক্টোবর ২০১৬

জার্নাল  নুরুল করিম নাসিম

বিশাল ও বৈচিত্র্যময় ভারতের অনেক জায়গায় ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও যাওয়া হয়নি। পরে এক সময়ে যেতে হয়েছে আমাকে। নিছক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে নয়। সেই বিশাল বৈচিত্র্যময় দেশ ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ ও সময় পাইনি কখনো কোনোদিন। মাঝে মধ্যে অবশ্য ব্যতিক্রম হয়েছে। যেমন দক্ষিণের শহর চেন্নাইর বেল্লোরে আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলনে ২০১৩ সালে অংশগ্রহণ করতে গিয়েছিলাম। সেই সব মুহূর্ত নিয়ে ধারাবাহিক লিখেছি দেশের অন্যতম প্রধান দৈনিক ‘জনকণ্ঠ’এর সাহিত্য সাময়িকীতে, কিন্তু সবটুকু লেখা সম্পূর্ণ হয়নি। তবে লেখাটা মোটেই ভাল দেখায় না, তা’ পাঠকও পছন্দ করে না। বলছিলাম বাধ্য হয়ে ভারতে যেতে হয়েছে। ১৯৮৬ সালের ২২ মে আমার ছোট ভাইয়ের কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করাতে ভারতের দক্ষিণের শহর ভেলোর ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল হসপিটালে যেতে হয়েছিল। দীর্ঘ দেড় বছর সেখানে বাড়ি ভাড়া করে চিকিৎসার জন্য থাকতে হয়েছে। তখন আমাদের দেশে কিডনি চিকিৎসার ব্যাপক সুযোগ সুবিধা ছিল না। আমি এক নাগাড়ে এতদিন থাকিনি, আমার আরেক ছোটভাই যে কিডনি দিয়েছিল, সে ছিল সারাটা সময়। আমার এক বিধবা মামাতো বোন ও আমার মা ছিলেন এই দীর্ঘ সময়টায়। আমি ছিলাম আসা-যাওয়ার ভেতর। তারপর হঠাৎ একসময় আমার বা চোখ দৃষ্টিহীন হয়ে পড়ে। আমি অন্ধ হয়ে যাই। এক চোখে ইসরাইলের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মোসে দায়েনের মতো পৃথিবীকে দেখতে হতো। ঢাকার বিখ্যাত দুই ডাক্তার, একজন আমার আত্মীয় অপারেশনের জন্য অনেক টাকা চাইলেন। আমার তখন অত টাকা ছিল না। মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ডিগ্রী নিয়ে বের হয়েছি। বাবা রিটায়ার করেছেন সবেমাত্র। তিনি চাইতেন আমি সরকারি চাকরি করি। তার ইচ্ছেয় আমি প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার হিসেবে সেকশন অফিসার ব্যাংকে জয়েন করি। মাসিক বেতন সর্বসাকুল্যে বারোশ’ টাকা। সময়টা ১৯৭৯, ফেব্রুয়ারি। আমি চাকরি ছেড়ে দিলাম। অতঃপর অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে বিদেশ চলে গেলাম। তখন মাদ্রাজ নাম পরিবর্তন হয়ে চেন্নাই হয়নি। মাদ্রাজ শহরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন হাসপাতাল শঙ্কর নেত্রালয়। শুধু ভারত নয়, দূরদূর দেশ থেকে চোখের রোগীরা চিকিৎসার জন্য এসে থাকে। ভীষণ ভিড়। সহজে সিরিয়াল পাওয়া যায় না। হাসপাতালের খুব নামডাক। হঠাৎ পথে একদিন এক যুবকের সাথে দেখা, থুঁতনিতে দাড়ি, চোখগুলো কেমন ঘোলাটে ও নিষ্ঠুর, প্রচ- আত্মবিশ্বাসী। সে বললো, শংকর নেত্রালয়ে যান, অন্য কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। আমার একটা চোখ বোমা মারতে গিয়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এখন অনেকটা ঠিক হয়ে গেছে। তবে তিন মাসের আগে সিরিয়াল পাবেন কিনা সন্দেহ। আমি একটু উদ্বিগ্ন। তা’হলে কি হবে? আমি কি শেষ পর্যন্ত অন্ধ হয়ে যাবো? যুবকটি আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললো, মাদ্রাজ মুসলিম ইউনিয়ন অফিসে গিয়ে তাদের মাধ্যমে যেতে পারেন। তাড়াতাড়ি সিরিয়াল পাবেন। আমার কারো কাছে যেতে হয়নি। আমি সরাসরি রিসেপসনে গেলাম। সেখানে বসে আছে দীর্ঘকায় এক শ্যামল সুন্দরী। চমৎকার ইংরেজি বলে। যে কারণেই হোক সে আমার প্রতি কিছুটা সদয় হলো। সে বললো, তুমি যেহেতু বাংলাদেশী, তোমাকে বিদেশী কোটায় আমি অন্তর্ভুক্ত করে দিচ্ছি।’ তাকে ধন্যবাদ জানালাম, হৃদয়ের গভীর অন্তর্¯’ল থেকে কৃতজ্ঞতা জানালাম। অনেক কথা হলো, ব্যক্তিগত কথা, জীবনের কথা, তার দেশের কথা, তার ভবিষ্যতের কথা। সে এতকথা আমাকে কেন বললো জানি না। আমার লেখার কাজে এই তথ্য একদিন কাজে আসবে। খুব অল্প সময়ে ভিনদেশী এক নারীর সাথে ¯িœগ্ধ সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠবে কে জানতো। সে ডাক্তারের সাথে অ্যাপয়েন্ট তারিখ দিয়ে দিলো এবং একজন মহিলাকে সাথে নিয়ে আসার অনুরোধ জানালো। আমি তখনো বিয়ে করিনি। স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী। আমি আপাকে এসে সব কথা বললাম। পরদিন আপা আমার সাথে গেলেন হাসপাতালে। অপারেশনের একদিন আগে হাসপাতালে থাকতে হবে। একদিন পরে হাসপাতাল থেকে আমাকে ছেড়ে দেয়া হবে। তখন বাইরে কোনো হোটেলে দু’একদিন থাকতে হবে। তামিল ডাক্তার মঞ্জু কুলকারনি ফর্সা ও লাবণ্যময়ী। তিনি আমার চক্ষু অপারেশন করলেন। পরদিন ব্যান্ডেজ খুলতেই পৃথিবীকে আমি নতুন চোখে দেখলাম। এতদিন এই সুন্দর পৃথিবীর যা হারিয়েছিলাম, যা দেখতে পাইনি পুরোপুরি, এখন তা’ দেখতে পেয়ে খুশীতে মন ভরে উঠলো। রিসেপশনের সেই ভদ্রমহিলা আমাকে সহযোগিতা না করলে আমি এই সুন্দর পৃথিবীকে দেখতে পেতাম না। পরে জানলাম তিনি কলকাতার মেয়ে, কবিতা লেখে। ডাক্তার মঞ্জু কুলকারনির কাছেও আমি কৃতজ্ঞ। শঙ্কর নেত্রালয় অপারেশন বাবদ ভারতীয় মুদ্রায় মাত্র ছয়শত টাকা চার্জ করেছিল। আমার ছোট ভাইয়ের কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের আগে ডোনারের ব্লাড ক্রসম্যাচিংয়ের জন্য কন্যা কুমারীতে যেতে হয়েছিল। সেটাও বাধ্য হয়ে, উপায় ছিল না। নিছক ভ্রমণের জন্য নয়। ভারতের গার্ডেন সিটি হায়দ্রাবাদের হোটেলে একরাত্রি অবস্থান করতে হয়েছিল, সেটাও বাধ্য হয়ে। সমগ্র শহরটা পরদিন ঘুরে দেখার মতো সময় পাইনি। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় মনের অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যায়।
×