ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জুতা

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ১৪ অক্টোবর ২০১৬

জুতা

মেয়েটা ভাবেনি জুতা জোড়ার আনন্দ এভাবে ম্লান হয়ে যাবে। পাঠক ভাবতে পারেন জুতা জোড়া নতুন। যেহেতু আনন্দ শব্দটি যুক্ত। পাঠক আরও ভাবতে পারেন, জুতা জোড়া চুরি হয়ে গেছে অথবা হারিয়ে গেছে। ছিঁড়েও যেতে পারে। না, জুতা জোড়া নতুন নয় পুরনো। জুতা জোড়া চুরি হয়নি, হারিয়েও যায়নি, ছিঁড়েও যায়নি। এসবের বাইরেও অন্য কারণ থাকতে পারে। বদির স্যার যখন বললেন, পায়ের মাপে জুতা, নাকি জুতার মাপে পা-সেভেনের পুরো ক্লাস হা হয়ে যায়। বদির স্যার রাশভারি মানুষ। তিনি কোন কথা বললে হাসি ঠাট্টা নিষিদ্ধ। পুরো ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা একজন আরেকজনের মুখের দিকে চায়। একজন আরেকজনের পা চায়। বদির স্যার মেয়েটার সামনে এসে বললেন, তোমার পায়ে এত লম্বা জুতা কেন? মেয়েটা পায়ের দিকে তাকায়, আর লজ্জায় মাথা নত করে। পুরো ক্লাসের চোখগুলো উড়ন্ত থেকে স্থিরমুখী। মেয়েটির মনে হলো সে মানুষ নয়, ভিনগ্রহের কেউ অথবা চিড়িয়াখানার জন্তু। ছাত্রছাত্রীরা হেসে ফেলে মেয়েটি কান্না পায়। গলায় কান্না দলাপাকায়। আচমকা তার জুতা জোড়ার কথা মনে পড়ে। জুতা জোড়া গল্পের শুরুতেই প্রবেশ করেছে। এখন আবার। ফলে জুতা জোড়া বিস্তৃত ব্যাখ্যা দাবি করে। মেয়েটা অভাব অনটনের ভেতর দিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। মায়ের কোল জুড়ে ট্যা ট্যা করা অসুস্থ ছোট ভাই। পিঠাপিঠি এক বোন অপুষ্টিতে ভুগছে। চোখজোড়া দেখলে মনে হয় চোখ নেই- সেখানে জেগে আছে দুটো খাঁড়ি। বাবা অন্যের কাজ করে। হাঁপানি রোগী। এত অভাব-অনটন নরকের আবহাওয়া ঘিরে ইচ্ছের স্বর্গীয় আনন্দ বিরাজ করা অকল্পনীয়। যার পেট ভরে খাবার জুটে না তার তো পোশাক-আশাক জুতা জোড়ার অভাব হরহামেশা হা করা বোয়াল। শুধু দীর্ঘশ্বাস আর হা হুতাশের এক বিরানভুমি। মেয়েটার জুতা ছিঁড়ে গেছে। মায়ের পায়ের জুতা নিয়ে তাকে স্কুলে যেতে হয়। সকাল বেলা, স্কুলে যাওয়া পথে মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয় কাঞ্চনের। লোকটা মুচি। লোকটা মেয়েটাকে দেখে বলল, মা, এত লম্বা জুতা পায়ে কেন? মেয়েটা অস্পষ্ট স্বরে জবাব দেয়, কাকু জুতা ছিঁড়ে গেছে। লোকটা ধুলা-ময়লা জমে থাকা নানা রঙের জুতার ভিড় থেকে একজোড়া জুতা বের করে। তারপর, বলল নিয়ে যা। মেয়েটা বলল, লাগবে না। বদির স্যার যখন জুতা জোড়া নিয়ে প্রশ্ন তোলে; পুরো ক্লাস যখন মেয়েটার পামুখী-মেয়েটার তখন কাঞ্চন চাচার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে জুতা জোড়ার কথা। স্কুল ছুটি হলে মেয়েটা গোশতের গলি পেরিয়ে ঢুঁ মারে মুচি দোকানে। কাঞ্চন লোকটা বলল, মা, কিছু বলবি? মেয়েটা বলল, কাকু জুতা জোড়া দেবেন? কাঞ্চন বলল, নিয়ে যা। মেয়েটার কান্না পায়। জুতা জোড়া মন্দ না। পুরনো হলে অনেকদিন যাবে। মেয়েটার ইচ্ছে করে জিজ্ঞাসা করতে জুতা জোড়া কার? কোন মেয়ের? কেবা মেরামত করতে দিয়ে গেছে? সে ভাবে, মেয়েটা হয়ত তার সঙ্গেই পড়ে। জানা গেলে ধন্যবাদ দেয়া যেত। আবার ভাবে জুতা জোড়া যার হোক সে তো তাকে দেয়নি। মেয়েটা বলল, কাকু ধন্যবাদ। কাঞ্চন হা হা করে হেসে ওঠে। মেয়েটার মুখের হাসি রেখা তার ভেতরে আনন্দ ডেকে আনে। বিকাল বেলা। জুতা জোড়া হাঁটতে থাকে আর মেয়েটার দুটো পা স্থির হয়ে যায়। জুতা জোড়া হাঁটতে থাকা- এ রকম ভৌতিক বা অলৌকিক ঘটনা ঘটলে গল্প বাঁক নেবে এটাই স্বাভাবিক। মেয়েটা বিকেলের বাতাস খেতে খেতে; মিঠা রোদে ফড়িং ওড়া দেখতে দেখতে নিঃশব্দে হাঁটছিল। তার খুব ভাল লাগছিল যে, জুতা জোড়া পা ফেলার তালে তালে শব্দ করছে না। আজ ক’দিন মায়ের জুতা জোড়া কি রকম অদ্ভুত আওয়াজ করত- কেমন লজ্জা আর বিরক্ত ডেকে আনত। একটা লোক তার পাশে দাঁড়িয়ে শিস কাটে। লোকটা মধবয়সী। মেয়েটার পরিচিত। মেয়েটা কোন কথা বলে না। মেয়েটা ভাবে জুতা জোড়া। মেয়েটা ভাবে কাঞ্চন চাচার কথা। কাল তাকে ক্লাসে লজ্জা পেতে হবে না। বদির স্যার বলবে না, পায়ের মাপে জুতা, নাকি জুতার মাপে পা-এ যে তার কি আনন্দ। বিকেল বেলা মেয়েটা পাতাবনে। না, কোন নাচুনে পাখি তাকে ডাকেনি। তাকে ডাকেনি কোন পাখির বাসা অথবা প্রকৃতির ডাকেও সে পাতা বনে যায়নি। জুতা জোড়া হাঁটতে থাকলে মেয়েটা ট্যা ট্যা করা ভাইয়ের কথা ভাবে না। মায়ের কথা ভাবে না। বাবার কথাও ভাবে না। মনে মনে সে অপুষ্টিজনিত বোনটির মৃত্যু কামনা করে। মেয়েটা ভাবে বোনটিকেও দেখতে হবে সাপের ছলমের পাশে ফোঁস ফোঁস করা আরেকটা সাপ। এ সাপ তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিস কাটা লোকটা। যে তার জন্য দলা দলা মেঘের বন্দোবস্ত করছে। মেয়েটা অসহায় নিরীহ খরগোস ছানা। মেঘের ভিড়ে যেতে যেতে দেখে পৃথিবী রৌরবের রূপে সেজেছে। মেয়েটা অন্য গ্রহের দিকে যেতে যেতে ভাবে জুতা জোড়ার লাফ। বিকেল বেলা পাতাবনে মেয়েটা পা দুটো স্থির হয়ে যায় আর জুতা জোড়া হাঁটতে থাকে, অথবা লাফাতে থাকে। জুতা জোড়ার গল্প এখানেই শেষ হতে পারত। যেহেতু পা দুটো স্থির হয়ে গেছে। কিন্তু জুতা জোড়া যখন আপনা আপনি শিসকাটা লোকটাকে চওড় লাগায়-তখন কাহিনী বিস্তৃত ব্যাখ্যা খোঁজে। সন্ধ্যা ঘিরে টোঙাবিলের লোকজন দেখে পাতাবনে মেয়েটা শুয়ে আছে। পায়ের ফাঁকে শুকিয়ে গেছে রক্তের দাগ। জুতা জোড়া কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে দৃশ্যমান সাপের ছলম ঘিরে। লোকজন যখন এ দৃশ্য দেখে হা-হুতাশ করছে জুতা জোড়া তখন আলোচনার বাইরে। কালো জামের প্রবেশ ঘটলে কালিজিরা অপাঙ্ক্তেয়। কিন্তু শিসকাটা লোকটা জুতা জোড়ার কথা ভাবছে। মেয়েটা যখন হাত-পা নাচিয়ে অন্য পৃথিবীতে যাচ্ছে তখনই ঘটনাটা ঘটে। ঘটনাটা লোকটার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। জুতা জোড়া মেয়েটার পা থেকে ছিটকে এসে তার দু’গালে দু’চড় লাগায়। সন্ধ্যাবেলা মেয়েটার পাতাবনে শুয়ে থাকা গল্প জেগে থাকে টোঙাবিলের হাটে। বদির স্যার চা দোকানের টেবিলে পা ছড়িয়ে বসে যখন বলেন, আহা মেয়েটাকে সকালে জুতার জন্য বকেছি। তখন দোকানে বসে থাকা লোকজন হা- হুতাশ করে । কেউ কেউ বলে, মেয়েটা বাবা পাগল হয়ে যাবে। কেউ কেউ বলে, মেয়েটা বেঁচে থাকলে ভাল পাস আনত। মুচি কাঞ্চন এসব শুনে হু হু করে কেদে ওঠে। সে কান্নার স্বরে বলে, মেয়েটা বেঁচে থাকলে সমাজের মুখ উজ্জ্বল করত। বড় ভাল মেয়ে ছিল। মেয়েটাকে ঘিরে এসব গল্প যখন ডালপালা ছড়ায় তখন আরেকটা ঘটনা ঘটে। জুতা জোড়া সেলুন দোকানের সব আয়না ভেঙ্গে দেয়। এ কা- বা জুতা জোড়া কেউ দেখতে পায় না। লোকে দেখে কেবল আয়না ভাঙতে। এ দৃশ্য কেবলই শিসকাটা লোকটা দেখতে পায়। সে দেখে জুতা জোড়া তাকে চড় মারছে। ফলে লোকটা দু’গালে হাত দেয় আর সেলুনের আয়না ভাঙে। লোকটা ঘরে ফেরে। সে আয়না থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকে। কিন্তু তার মনের আয়না থেকে কিছুতেই জুতা জোড়ার চড় মুছে দিতে পারে না।
×