ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কাজী সুফিয়া আখতার

বিবাহ বিচ্ছেদ ও নারীর পারিবারিক সামাজিক অধিকার

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ১৪ অক্টোবর ২০১৬

বিবাহ বিচ্ছেদ ও নারীর পারিবারিক সামাজিক অধিকার

পূর্ব প্রকাশের পর বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমান অধিকার স্বীকৃত। কিন্তু পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে কোথাও নারী-পুরুষ সমঅধিকার ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত নয়। নারীদের ‘হেয়’ করে দেখার প্রবণতা এই সমাজের সব শ্রেণীতে কমবেশি অধিকাংশ পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান। এই মানসিকতার জন্য যৌতুকবিরোধী আইন থাকা সত্ত্বেও বিয়েতে কন্যার বাবাকে যৌতুক দিতে হয়। ছেলেপক্ষের কাছে এটা বৈধ হয়ে গেছে। কারণ সমাজ এটা গ্রহণ করেছে। অধিকাংশ ছেলে ভাবে ও বিশ্বাস করে যাকে বিয়ে করছে তার চেয়ে সে শ্রেষ্ঠ। ফলে যৌতুক নেয়াটাকে সে আত্মসম্মানহানির কোন বিষয় বলে মনে করে না। শিক্ষিতÑনিরক্ষর উভয়ের ক্ষেত্রেই এই বিষয়টি দেখা গেছে। কৃষি ক্ষেত্রে কর্মরত ছিল (দিনমজুর) এমন অনেক ছেলে বিয়েতে নেয়া যৌতুকের টাকায় কুয়েত এবং ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলে যেতে সমর্থ হয়। তারপরেও সংসারে কোন বিষয়ে নারীর মতামত প্রদানের কোন সুযোগ থাকে না। নারীর এই অধীনতা বা অধস্তন রূপ আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে যখন যৌতুকের টাকার জন্য বা বারবার যৌতুক আনার জন্য তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয় কখনও গাছের সঙ্গে বা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে। হয়ত বিয়ের সময় এই মেয়েটির কোন মতামতও নেয়া হয়নি। কিন্তু সে যেন অত্যাচার করার আধার। পৃথিবীর সব দেশেই বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন। সংসার সুখের স্বপ্ন, ভালবাসা ও আস্থার আশ্রয়স্থল। একসময় এই ভূখ-ের মুসলিম সম্প্রদায়ের ছেলেদের বিয়ে করতে হলে মেয়ের বাবাকে পণ দিয়ে বিয়ে করতে হতো। পণ বা যৌতুক প্রথা শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত ছিল। কারণ হিন্দু মেয়েরা সম্পত্তির ভাগ পেত না। অবশ্য ‘কুমার’ সম্প্রদায়ের মেয়েদের বিয়েতে ছেলেদের পণ দিতে হতো। কারণ মেয়েরা সরাসরি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। স্বাধীনতার পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে কিছুসংখ্যক মানুষের নৈতিক অবক্ষয় ঘটে এবং তারা শর্টকাট পথে ধনী হওয়ার অভিলাষে ও ভোগ লিপ্সায় বিয়েতে যৌতুক নেয়ার প্রচলন শুরু“করে। সেই সময়ের মানুষের কর্মহীনতা এবং অর্থনৈতিক কারণে ও কিছুসংখ্যক ফুলেফেঁপে ওঠা মানুষের লোক দেখানো আভিজাত্য প্রকাশে কালে কালে যৌতুক প্রদান সামাজিকভাবে গ্রহণীয় হয়ে ওঠে। এই সময়ে স্বর্ণের দাম বেড়ে যায়। বিয়েতে বাবা মেয়েকে গয়না দিয়ে সাজিয়ে দেবেন, তাহলে বিয়ে হবেÑ ছেলেপক্ষের এমন দাবিতে যৌতুকপ্রথা সমাজে গেড়ে বসে। মেয়ের বিয়ে না হলে সমাজ সব সময় মেয়ের বাবাকে ছি ছি করেছে। কিন্তু মেয়ের বাবার সঙ্গতি আছে কিনা তা বিবেচনা করে পাশে দাঁড়ায়নি। বঙ্গবন্ধু ফুলের মালা পরে মেয়েদের বিয়ে করতে উৎসাহিত করলে কিছুসংখ্যক মেয়ে তাতে সায় দেয়। কিন্তু ছেলের অভিভাবকদের কারণে তা বেশিদূর গড়ায়নি। ছেলেকে মানুষ করতে খরচ হয়েছে। এই খরচের টাকা এখন মেয়ের বাবার কাছ থেকে আদায় করতে হবে। ব্যাপারটা এমন যেন মেয়ে পড়াতে মেয়ের বাবার কোন টাকা-পয়সা খরচ হয়নি। অলিখিতভাবে এই ঘৃণ্য নিয়ম বৈধরূপে বাংলাদেশে বিরাজমান। নারী অধিকার ও মানবাধিকার রক্ষাকল্পে গঠিত সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব তথ্য এটাই সাক্ষ্য দেয় যে, ফ্যামিলি কমপ্লায়েন্সগুলোর বিষয়ে অর্থাৎ সংসারে নারীর মতামত প্রদান, তার ইচ্ছা অনিচ্ছা জানা, সুযোগ-সুবিধা, অবসর, স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি, বিনোদন, মেধা বিকাশের সুযোগ, সম্মান ও মর্যাদা পাবার অধিকারগুলোর বিষয়ে অধিকাংশ পরিবারে কোন গুরুত্ব বা মনোযোগ দেয়া হয় না। এখনও পর্যন্ত আমাদের দেশের অধিকাংশ নারী-পুরুষ বিশ্বাস করে ঘর-সংসার, ছেলেমেয়ে ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সেবা-যতœ নারীর প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য। এই বিশ্বাসে সমস্যা ছিল না। সমস্যা হলো ঘরের কাজগুলোর ‘কাজ’-এর স্বীকৃতি নেই। ঘরের কাজগুলো সরাসরি সংসারে অর্থ আনে না এ কথা সত্যি কিন্তু এগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উৎপাদনশীল কাজ। ‘মায়ের ভালবাসা’ ‘স্ত্রীর ভালবাসা’র এই কাজগুলোকে অর্থনীতির মাপকাঠিতে এতকাল কেউ হিসাব করতে সম্মত হননি। তাতে নারীকে কেবলই প্রান্তিক স্তরে ঠেলে দেয়া হয়েছে। সংসারটা এককভাবে ‘কর্তা’র বলে গণ্য হয়েছে। সহস্র কাজ সম্পাদন করে শতাব্দীর পর শতাব্দী নারী নিজগৃহে পরবাসী হয়ে, বোবা প্রাণী হয়ে রয়েছে। নারীর জন্য সমাজ সৃষ্ট এই আত্মঘাতী বৈষম্য বরাবরই সমাজপতিদের ধর্তব্যের বাইরে থেকেছে। যৌতুকের অত্যাচার থেকে বাঁচতে এখন অনেক মেয়েই স্বেচ্ছায় বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটায়। বিয়েতে যৌতুক প্রদানে বাধ্য হওয়া, নারী নির্যাতন বৃদ্ধি, নারীর অধস্তনতা এবং সাংসারিক কাজের অস্বীকৃতি, নারীর চাকরি করা ভাল চোখে না দেখা, পরিবার ও সমাজে নারীর সম্মানহীনতার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা বৃদ্ধির ঘটনায় নারীর এগিয়ে থাকার বিষয়টি সহজেই অনুমান করা যায়। বিবাহ বিচ্ছেদের নেতিবাচক প্রভাব থেকে সমাজকে রক্ষা করতে ‘নারী আজ ক্যারিয়ার সচেতন হয়েছে’ বলে তার উপর দোষ চাপিয়ে কোন লাভ নেই। ভালভাবে বাঁচার অধিকার সকলেরই আছে। এই ইচ্ছা কোন দোষের নয়। নারী সাহসী হয়েছে। নারী শিক্ষিত ও সচেতন হয়েছে। এটা শুভলক্ষণ। দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিতে কল্যাণময়ী নারী প্রশংসনীয় ভূমিকা ও অবদান রাখছে। আজ বিবাহ বিচ্ছেদের নেতিবাচক প্রভাব থেকে সমাজকে রক্ষা বা বিবাহ বিচ্ছেদের হার কমিয়ে আনতে উল্লেখিত নারীর জন্য নির্ধারিত কাজগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘কাজ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। দেশের জিডিপিতে গৃহস্থালির কাজ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাতে সংসারে নারীর অবস্থান সম্মানজনক হবে। এক্ষেত্রে অর্থনীতির হিসাবটা একমাত্র না হলেও জরুরি। পরিবারে নারী-পুরুষের সমান সুযোগ ও সমতার পরিবেশ তৈরি করার লক্ষ্যে সরকারকে সিডও সনদের ধারা-২ এবং ধারা-১৬(১)গ থেকে অবিলম্বে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করতে হবে। যৌতুক আইন বাস্তবায়নে সরকারকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে সচেষ্ট হতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার প্রশাসনকে আরও কাজে লাগাতে পারে। সংসারে স্ত্রীকে নীচু দৃষ্টিতে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ছেলেদের পাল্টাতে হবে। সংসারের খুঁটিনাটি বিষয়ে তাদের মত প্রদানের সুযোগ রাখতে হবে। মূল্য দিতে হবে তাদের মতামতের। তাদের মেধা বিকাশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। সংসার এবং সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হবে। ফ্যামিলি কমপ্লায়েন্সের বিষয়ে নারী-পুরুষ উভয়ের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
×