ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লিটন আব্বাস

জোবেদা খানম বিশ শতকের অনন্য নারী ব্যক্তিত্ব

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ১৪ অক্টোবর ২০১৬

জোবেদা খানম  বিশ শতকের অনন্য নারী ব্যক্তিত্ব

কখনও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখেননি। অথচ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএবিটি এবং ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয় থেকে করেছেন এমএ। তিনি পিছিয়ে পড়া, সুবিধাবঞ্চিত অসহায় নারীদের উজ্জ্বল উদাহরণ। তিনি উনিশ শতকের আলোকিত মহীয়সী নারী জোবেদা খানম। জোবেদা খানমের পরিবার ছিল ঐতিহ্যবাহী শিক্ষানুরাগী। তার পরিবারের প্রতিষ্ঠা পুরুষ শেখ আইনউদ্দীন সিদ্দিকী ছিলেন আধ্যাত্মিক জ্ঞানতাপস। জোবেদা খানম সেই পরিবারের নবম বংশধর। অনেক বাধার প্রাচীর থাকলেও তাকে রুখতে পারেনি কিছুই। নিজের প্রবল প্রচেষ্টা আর স্বামীর ঐকান্তিক সহযোগিতায় জোবেদা খানম গৃহে পড়াশোনা করে প্রাইভেটে মেট্রিকুলেশন, আইএ (ভিক্টোরিয়া কলেজ) বিএবিটি (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪৬) করেন অবিভক্ত ভারতের কলকাতা থেকে। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ (১৯৫০) ডিগ্রীও অর্জন করেন। তাও আবার প্রাইভেটে। পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন, কেন্টার্কি বিশ্ববিদ্যালয় আমেরিকা থেকে কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রশিক্ষণ ও ক্যারলটন বিশ্ববিদ্যালয় (আমেরিকা) থেকে বয়স্ক শিক্ষা প্রশিক্ষণ নেন। জার্মানিতে শিক্ষার ওপর সংক্ষিপ্ত কোর্সের সনদও লাভ করেন তিনি। বিস্ময়কর ও অবাক করা ব্যাপার হলো মাত্র ১৩ বছর বয়সে কিশোরী জোবেদা খানমের বিয়ে হয়। বিয়ের সাত বছর শেষে দুই শিশু সন্তান ও স্বামীর মৃত্যু হয়। এর পরও তাকে লক্ষ্য থেকে টলাতে পারেনি কোন বাধা। শিক্ষকতা করে দুই সন্তান আবদুল মান্নাফ ও জাহানারা বেগম মুন্নীকে উচ্চতর পড়াশোনা করিয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। লিউকেমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক জোবেদা খানমের জীবনাবসন হয় ১৯৯০ সালের ২৬ জানুয়ারি। জোবেদা খানম কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন। দেশ ভাগের পর ঢাকায় এসে কামরুন্নেসা স্কুলের সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৪ সালে সরকারী চাকরি হিসেবে সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক পদে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট প্রোগাম ইনস্ট্রাক্টর, ১৯৬১ সালে জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থার পরিচালক, ১৯৭১ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ, ১৯৭৬ বাংলাদেশ শিশু একাডেমির প্রথম পরিচালক এবং চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৮৩ সালে যোগ দিয়ে ১৯৮৫ সালে অবসর গ্রহণ করেন এই মহীয়সী। জোবেদা খান শুধু শিক্ষাবিদই ছিলেন না- সুপ্রসিদ্ধ সাহিত্যিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠকও ছিলেন। উপন্যাস, নাটক, গল্প, অনুবাদ, শিশু সাহিত্যসহ জোবেদা খানমের প্রকাশিত গ্রন্থ ২৫টি। এর মধ্যে শিশুতোষ ৮টি। তার অপ্রকাশিত পান্ডুলিপিও আছে। তিনি সাহিত্যে অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার (১৯৮৩) পেয়েছেন। মধ্যবিত্ত সমাজ সংসারের গল্প তার লেখার অন্যতম অনুষঙ্গ। জোবেদা খানমের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলোÑ উপন্যাস-অভিশপ্ত প্রেম (১৯৫৯), দুটি অঁাঁখি দুটি তারা (১৯৬৩)। নাটকÑঝড়ের স্বাক্ষর (১৯৬৭), ওরে বিহঙ্গ (১৯৬৮)। গল্পগুচ্ছÑএকটি সুরের মৃত্যু (১৯৭৪), জীবন একটি দুর্ঘটনা (১৯৮১), ছোটদের একাঙ্কিকা (১৯৬৩), এসো ছড়া পড়ি (১৯৮১), শাবাশ সুলতানা (১৯৮২)-সহ জীবন খাতার পাতাগুলি। জোবেদা খানম বাংলাদেশ মহিলা সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৭২-১৯৮৫ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫-১৯৮০ সাল পর্যন্ত বিজনেস এ্যান্ড ক্যারিয়ার হিউম্যান্স ক্লাবের ভাইস চেয়ারম্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইম্যান ফেডারেশনের সদস্য, বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ কাউন্সিলের জেনারেল সেক্রেটারি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পৃষ্ঠপোষক, ফ্লিম সেন্সর বোর্ডের সদস্য, আজিমপুর লেডিস ক্লাবের (১৯৬৫) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান (আজীবন), বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সদস্যসহ অনেক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এই মহীয়সী শিক্ষাবিদ ২০০৩ সালে শিক্ষায় (মরণোত্তর) একুশে পদক পান। মহীয়সী জোবেদা খানমের জন্মসাল নিয়ে মতভেদ আছে। তিনি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার বানিয়াকান্দী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ১৩২৪ সনের ৩১ শ্রাবণ (সনদে জোবেদা খানমের জন্ম তারিখ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ৫ মার্চ, ১৯২০ সাল। এ ছাড়া বাংলা একাডেমি ও ১৯৯৫ সালে কেএমএ মতীন সম্পাদিত ‘আমাদের পরিবার’ গ্রন্থে জোবেদা খানমের জন্মতারিখ ১৯১৭ সালের ১৮ আগস্ট। শর.ষরঃড়হ৮৪@মসধরষ.পড়স
×