ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মহাকাশে রেজেটা অভিযানের সমাপ্তি

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ১৪ অক্টোবর ২০১৬

মহাকাশে রেজেটা  অভিযানের সমাপ্তি

একযুগ আগে একটি ধূমকেতুকে লক্ষ্য করে এই যানটি পাঠিয়েছিল ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। ওই ধূমকেতুটির নামে সিক্সটি সেভেন পি। অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে শেষ হয়েছে মহাকাশ বিজ্ঞানের বহুল আলোচিত এই অভিযান। যে ধূমকেতুটির ওপর গবেষণা চালাচ্ছিল রোজেটা, সেই ধূমকেতুরই উপরে আছড়ে পড়ে, তার নিজেরই অভিযানের সমাপ্তি ঘটাল। সোজা কথায় বলা যায়, রোজেটা আত্মহত্যা করেছে। এই অভিযানটি পরিচালনা করা হতো জার্মানির ডার্মস্টাড শহর থেকে। কন্ট্রোল রুমের বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন, রোজেটার সঙ্গে তাদের রেডিও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এরপরেই এই মিশনের প্রধান এবং ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সির মিশন ম্যানেজার প্যাট্রিক মার্টিন রোজেটা মিশনের সমাপ্তি ঘোষণা করে বলেন, ‘রোজেটা যে সিক্সটি সেভেন পি-এর ওপর আছড়ে পড়ল, আমি ঘোষণা করছি সেটা সম্পূর্ণ সফল হয়েছে। এবং আমি ঘোষণা করছি যে এর মধ্য দিয়ে রোজেটা মিশন সমাপ্ত হলো।’ ‘এই অভিযানের বড় রকমের বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি সাফল্যের মধ্য দিয়েই এর চূড়ান্ত পরিণতি ঘটল। এই গবেষণার সঙ্গে যেসব বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী জড়িত ছিলেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ।’ কিন্তু পরিকল্পিত এই মৃত্যুর আগে রোজেটা, ধূমকেতুটি থেকে হাই-রেজ্যুলিউশনের অর্থাৎ খুবই সূক্ষ্ম এবং উন্নতমানের প্রচুর ছবি পাঠিয়েছে এই পৃথিবীতে। রোজেটাকে মহাকাশে পাঠানো হয় বারো সাড়ে বারো বছর আগে। দশ বছরের যাত্রা শেষে এটি গিয়ে পৌঁছায় সিক্সটি সেভেন পি ধূমকেতুতে। সেটি ছিল ২০১৪ সালের আগস্ট মাস। তারপর দুবছর ধরে এই রোজেটা অবস্থান করে পর্বতময় ধূমকেতু সিক্সটি সেভেন পির কাছাকাছি। সেখান থেকে গবেষণা চালায় ওই ধূমকেতুটির ওপর। বোঝার চেষ্টা করে তার গঠন, এর আচরণ ও রাসায়নিক রহস্য। এ সময় পৃথিবীতে পাঠায় এক লাখ ১৬ হাজারেরও বেশি ছবি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, রোজেটা থেকে সিক্সটি সেভেন পি-এর যেসব ছবি ও তথ্য পাঠানো হয়েছে, সেসব নিয়ে আরও অনেক বছর গবেষণা করতে হবে। এই অভিযানে এমন বিজ্ঞানীও ছিলেন যারা তিরিশ বছর ধরে এই গবেষণার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অভিযানটি যখন শেষ হয়, তখন তারা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। হাততালি দিয়ে অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করলেও তাদের চোখে ছিল পানি। ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থারই একজন শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী মার্ক ম্যাককফারেন বলেছেন, তাদের আজ মন খারাপ। আবার একই সঙ্গে তারা গর্বিতও। কারণ তারা জানেন এই মিশন থেকে তারা কতটা কি অর্জন করেছেন। এই মিশনের সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানীরা বলছেন, রোজেটার সাহায্যে তারা যেমন ধূমকেতুটির উপরিভাগ সম্পর্কে একটি ধারণা পেয়েছেন তেমনি তারা এর ভেতরেও দেখার চেষ্টা করেছেন। দেখা গেছে, হাসের মতো দেখতে এই সিক্সটি সেভেন পি ধূমকেতুতে বরফের বিশাল বিশাল সব ব্লক এবং ধারণা করা হয়। শত শত কোটি বছর আগে এসব বরফ একত্রিত হয়েই হয়ত এই ধূমকেতুটি তৈরি হয়েছে। রয়্যাল এস্ট্রনমিক্যাল সোসাইটির একজন বিজ্ঞানী রবার্ট মেসি বলছেন, মহাকাশের গভীরে রোজেটার এই মিশন ছিল খুবই সফল এক অভিযান। ‘রোজেটা একটি বিস্ময়কর সাফল্য। ছশ’ কোটি কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে অসাধারণ এক কাজ করেছে রোজেটা। তারপর এটি গিয়ে পৌঁছেছে সিক্সটি সেভেন পি ধূমকেতুটির কক্ষপথে। ২০১৪ সালে স্থিতিশীল ওই কক্ষপথে ঢুকে পড়ার আগে রোজেটা ছাড়া আর কোন যানই এই কাজটি করতে পারেনি।’ ‘রোজেটা বড় বড় যা কিছু করেছে, তার সবই মহাকাশে এই প্রথমবারের মতো ঘটেছে।’ সিক্সটি সেভেন পি এখন ক্রমশই সূর্যের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এর ফলে রোজেটার বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমাণ সৌরশক্তির দরকার ছিল সেটা সংগ্রহ করাও কঠিন হয়ে পড়ছিল। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে যে, রোজেটাকে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে যেতে না দিয়ে, এই যানটিকে তারা ধূমকেতুটির বুকে আছড়ে ফেলে ধ্বংস করে ফেলারই সিদ্ধান্ত নিলেন কেন? ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির প্রকল্প বিজ্ঞানী ম্যাট টেইলরের উত্তরে বলেছেন, রোজেটাকে যদি ঘুমিয়ে যেতেও দেয়া হতো, এই আশায় যে সে হয়ত একদিন আবারও জেগে উঠতে পারে, কিন্তু সিক্সটি সেভেন পি তখন সৌরজগতের এমন এক অবস্থানে গিয়ে পৌঁছাতো, সেখানে যে এই যানটি ঠিকমতো কাজ করত তার কোন গ্যারান্টি নেই। রোজেটাকে ষাটের দশকের রক ব্যান্ডের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেছেন, আমরা চাইনি যে মিশন শেষ করে একটা আবর্জনা এই পৃথিবীতে ফিরে আসুক। বরং এখন আমরা সত্যিকারের রক এন রোলের মতো কিছু চেষ্টা করব। বিজ্ঞানীরা রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে রোজেটার গতিমুখ পরিবর্তন করেন। ওই যানটিকে তারা পাঠাতে থাকেন ধূমকেতুটির অভিমুখে। তারপর একসময় যন্ত্রটি আছড়ে পড়ে বরফের ওপর। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির বিজ্ঞানী পাওলো ফেরি বলেছেন, ‘আমরা জানতাম না যে শেষ কয়েক মিটারে কি ঘটবে। যখন ওটা ধূমকেতুর পৃষ্ঠে আছড়ে পড়বে তখন কি হবে ওখানে সেটাও আমরা জানতাম না।’ ‘আমরা এমনভাবে প্রোগ্রাম করে দিয়েছিলাম যে এটি নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এটি যাতে ধূমকেতুটির ওপর আছড়ে পড়ে। আমরা কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি যেগুলো দুই কিলোমিটার থেকে শূন্য কিলোমিটার পর্যন্ত দূর থেকে সংগ্রহ করা। এটা খুবই, খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর সবশেষে এটার সুইচ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বরাবরের মতোই এই রোজেটা আমাদের হতাশ করেনি,’ বলেন তিনি। রোজেটাকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যেটি অবতরণ করতে পারে না। কিন্তু রোজেটা থেকে ধূমেকতু সিক্সটি সেভেন পির ওপর ছোট্ট একটি রোবট ড্রপ করা হয়েছিল। সূত্র : ইন্টারনেট
×