ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রমাণ করুন এতিমের টাকা চুরি করেননি ॥ খালেদার প্রতি প্রধানমন্ত্রী

বিদেশীদের কাছে নালিশ না করে কোর্টে এসে মামলা ফেস করুন

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৪ অক্টোবর ২০১৬

বিদেশীদের কাছে নালিশ না করে কোর্টে এসে মামলা ফেস করুন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সৎ সাহস থাকলে এবং বুকে বল থাকলে মিথ্যা বলে বিদেশীদের কাছে অহেতুক নালিশ না জানিয়ে আদালতে এসে মামলাগুলো যে মিথ্যা তা প্রমাণ করার জন্য বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সরকার কোন মিথ্যা মামলা দায়ের করেনি। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলাই তার ব্যক্তিগত দুর্নীতি এবং আন্দোলনের নামে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা সম্পর্কিত। চোরের মন শুধু পুলিশ পুলিশ। উনি তো এতিমের টাকা চুরি করেছেন বলেই আদালতে দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছেন। অপরাধ না করার বল যদি তার বুকে থাকত তাহলে নিশ্চয়ই তিনি আদালতে যেতেন। বুধবার গণভবনে জাতীয় শ্রমিক লীগের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়ার উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আদালতে এসে প্রমাণ করুন আপনি এতিমের টাকা আত্মসাত করেননি, মানুষ পুড়িয়ে হত্যার হুকুমের আসামি নন। তিনি বলেন, ‘আজ দেখি এতিমের টাকা মেরে খাওয়া লোকজন বলে তাদের নামে মিথ্যা মামলা দেয়া হচ্ছে। আপনারা (বিএনপি নেতৃবৃন্দ) আদালতে এসে প্রমাণ করুন, কোনটা মিথ্যা মামলা। মামলা সত্য না মিথ্যা সেটা আদালতে গেলেই (মামলা ফেস করলে) বোঝা যাবে। আপনারা কোর্টেই যেতে চান না, কনটেস্ট করতে চান না। উপরন্তু আদালত থেকে পালান।’ প্রধানমন্ত্রী ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তার বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দেয়ার প্রসঙ্গে তুলে ধরে বলেন, আমি তো কোন ভয় পাইনি। কারণ আমি কোন অপরাধ করিনি। তাই মামলা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বলেছি আমি আদালতে গিয়ে মামলা ফেস করব। মামলাদাতারা সে সময় আমাকে কোর্টে যাওয়ার ক্ষেত্রে উল্টো বিঘœ সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, তারা (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) ঘাবড়ে গেল। বলল না আপনি আসবেন (আদালতে) না। আমি বললাম, মামলা দিয়েছেন, ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছেন, কাজেই আমি আদালতে যাব এবং মামলা ফেস করব। এখন আবার বাধা দিচ্ছেন কেন? তিনি বলেন, এখন দেখা যাচ্ছে ওই মহিলা (খালেদা জিয়া) আদালতে গিয়ে মামলা ফেস করতেই সাহস পান না। যার একটাই কারণÑ তিনি তো এতিমের টাকা চুরি করেছেন। আর এই যে এতগুলো মানুষকে পুড়িয়ে মারলেন, তার হুকুমের আসামি তো তিনিই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্দোলনের নামে তারা হুকুম দিয়ে মানুষ পুড়িয়েছে। আগুনে পোড়া শরীর নিয়ে ভুক্তভোগীরা এখনও অনেকে বেঁচে রয়েছেন, স্বজনহারাদের আর্তনাদ যে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছেÑ এগুলো তারা কিভাবে অস্বীকার করবে। তিনি বলেন, ‘তারা (বিএনপি) হুকুম দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারবে আর তাদের বিরুদ্ধে মামলাও হবে না? কত আহ্লাদের ব্যাপার- আমি সেটাই চিন্তা করি।’ তিনি বলেন, বিএনপি নেত্রী সব জায়গায় নালিশ করে বেড়ানÑ এসব নাকি মিথ্যা। আমি বলব এখানে কোনটা মিথ্যা? স্বামীর সামনে যারা স্ত্রীকে পুড়িয়ে মেরেছে, মায়ের সামনে সন্তানকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, স্ত্রীর সামনে স্বামীকে নৃশংসভাবে পুড়িয়ে মারার বিচার কি তাহলে বাংলাদেশে হবে না? অবশ্যই সেই বিচার হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর জন্যই তো আসলে তারা এত মানুষ খুন করেছে। এ সময় তিনি যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানানোর মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত জাতীয় পতাকা রাজাকারদের গাড়িতে তুলে দেয়ায় সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং খালেদা জিয়ার তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘যারা এদের মন্ত্রী করেছে, আমার ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত জাতীয় পতাকার অবমাননা করেছে, তাদের বিচারও এই বাংলার মাটিতে হবে। তাদের কেন বিচার হবে না? সে প্রশ্ন উত্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী এ সময় কবিগুরুর দুটি পঙ্ক্তি উচ্চারণ করেনÑ ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।’ তিনি বিষয়টি দেশবাসীকে বোঝানোর জন্য শ্রমিক লীগ নেতাকর্মীসহ সচেতন নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই সব সাজাপ্রাপ্ত চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী এবং ভোট চুরি করে এমপি বানানোর কারণেই পরবর্তীতে দেশে ধর্মের নামে মৌলবাদ-জঙ্গীবাদ সৃষ্টি হয় এবং ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান ধরা পড়ার মতো অপরাধ সংঘটিত হয়। এ সময় তিনি ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা, ২০১৪ এবং ’১৫ সালে আন্দোলনের নামে মানুষ পোড়ানো, সহিংসতা, জঙ্গী তৎপরতায় নিহতসহ সকল হত্যাকা-ের বিচার দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশের মাটিতে বিচার অনুষ্ঠানের দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, বিএনপি নেতাদের অনেকেই আজকে বড় বড় কথা বলেন। অথচ আমরা দেখেছিÑ ২০০১ সাল থেকে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, বাংলা ভাইদের যত রকম মদদ দেয়া, শেল্টার দেয়াÑ এমনকি অপরাধ সংঘটনের পর নিরাপদে পালানোর জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে পাহারা দেয়া, সবই তারা করেছে। সারাদেশে ৫শ’ স্থানে বোমা হামলা হয়েছে, এসবের বিচার হতেই হবে। পাশাপাশি আমরা যেসব উন্নয়ন কর্মকা- শুরু করেছি সেগুলোকে অব্যাহত রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ শ্রমিকদের স্বার্থ দেখে। আমাদের রাজনীতিই হচ্ছে তাদের জন্য। কারণ আমরা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল। কাজেই আমরা ক্ষমতায় এলেই সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়। দেশের জিডিপি বর্তমানে ৭ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ তো এমনি এমনি আসেনি। আমরা সঠিকভাবে দেশ পরিচালনা করছি বলেই এটা অর্জন সম্ভব হয়েছে। আমার রাজনীতিটাই এ দেশের কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের জন্য। শেখ হাসিনা বলেন, অর্থনীতি যত উন্নত হবে আমরা ততটাই এ দেশের মানুষকে সুন্দর জীবন উপহার দিতে পারব। বর্তমান সরকারের আমলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এখন একজন দিনমজুর খাদ্য, মাছ কিনতে পারেন, কিছু টাকা সঞ্চয়ও করতে পারেন। আমরা অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছি। বেসরকারী খাতকে উন্মুক্ত করা হয়েছে। আগে মানুষকে বিদেশে পাঠালেই হতো। কোন প্রশিক্ষণের বালাই ছিল না। এসব নিয়েও তখন ব্যবসা করেছে বিএনপি। জনশক্তি রফতানি বৃদ্ধি এবং তার সরকারের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিক রফতানির প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যান্ত্রিক, আধুনিক এ যুগে যথাযথ প্রশিক্ষণ নিতে হবে। আমরা তার পূর্ণ সুযোগ ও ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তিনি বলেন, সবাই এখন স্কিলড লেবার চায়। সেজন্য প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দিয়েছি। প্রত্যেকটা সেক্টরে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। শ্রম, প্রবাসী কল্যাণ ও যুব মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিদেশে গমনেচ্ছু শ্রমিকদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের রাজনীতিটাই হচ্ছে এ দেশের সাধারণ মানুষ, একবারে নিম্নপদে থাকা মানুষদের ভাগ্যোন্নয়ন। তাদের উন্নত জীবন দেয়া এবং তারা যেন সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে সে ব্যবস্থা করা। শ্রেণী পেশায় যারা অবহেলিত ছিল; যেমন- বেদে, হরিজনÑ তাদেরও আমরা একটা মর্যাদা দিয়েছি। কারণ তারাও মানুষ, তাদের কর্মের কারণে খাটো করে দেখার উপায় নেই। তিনি বলেন, নীতি যদি ঠিক থাকে আর সঠিক পদক্ষেপ যদি নেয়া যায়, তবে দেশের উন্নয়ন সম্ভব। আমরা সেটি করে দেখিয়েছি। সকলকে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, সংগঠনটাকে শক্তিশালী করুন। কারণ সংগঠনটা সব থেকে বেশি দরকার। সমস্ত সেক্টরেই যেন আমাদের সংগঠনটা সক্রিয় থাকে সে বিষয়ে জোর দেয়ার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানান। জাতীয় শ্রমিক লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানের শুরুতে ফুলের নৌকা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানান শ্রমিক লীগের নেতৃবৃন্দ। শ্রমিক লীগের সভাপতি শুকুর মাহমুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে শ্রমিক লীগের সহসভাপতি ও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। জাতীয় শ্রমিক লীগের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শোভাযাত্রা বৃহস্পতিবার সকাল দশটায় ২৩ বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে বের হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
×