ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আকিল জামান ইনু

চীন-উত্তর কোরিয়া ॥ প্রেম ও বাণিজ্য সঙ্কটে সম্পর্ক

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ১২ অক্টোবর ২০১৬

চীন-উত্তর কোরিয়া ॥ প্রেম ও বাণিজ্য সঙ্কটে সম্পর্ক

চীন-উত্তর কোরিয়ার দ্বিপাক্ষিক সঙ্কটের সম্পর্ক সামনে রেখে একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। বর্তমান চীনের স্থপতি মাও সে তুং বলেছিলেন, ‘চীন আর উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক ঠোঁট আর দাতের মতোই ঘনিষ্ঠ’, এমনকি তার বড় ছেলে দুই কোরিয়ার যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত হন। আবেগ কিংবা প্রেমের দিকটা বিবেচনায় রেখেও বলা যায় কূটনীতিতে কোন প্রেমই স্বার্থহীন নয়, মহান মাওয়েরও উত্তর কোরিয়া প্রেমের পেছনে স্বদেশের স্বার্থ ছিল অবশ্যই, কিন্তু বিপরীত চিত্রটা পাল্টে যায় তখন যখন উত্তর কোরিয়ার স্থপতি কিম ইল সং মাওয়ের মতোই স্বদেশের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্বকে গুরুত্ব দিয়ে নিজস্ব পথে চলেন, তার পথটি ছিল সহজ ও পরিষ্কার- উত্তর কোরিয়া আত্মশক্তিতে উঠে দাঁড়াবে এবং অন্য কোন রাষ্ট্রের নাকে দড়ি বাঁধা পুতুল হবে না, কিমের পথটি ছিল লাল চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দুবিবদমান পক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে নিজ স্বার্থ হাসিল, সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন আর নেই আছে চীন, বেজিংয়ের কাছে উত্তর কোরিয়ার বিদ্রোহী মনোভাব খুব প্রীতিকর নয়। আর বেজিংভিত্তিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক বর্তমান বাস্তবতায় চীন পরিবর্তিত হয়েছে পুঁজিবাদী বিশ্বাসঘাতকে পিয়ংইয়ংয়ে জন্ম নেয়া চীন প্রবাসী এক উত্তর কোরিয়ান বলেন ‘চায়না প্রবাসী উত্তর কোরিয়া হিসেবে আমরা স্বদেশে মোটেই স্বাগত নই। তিনি আরও বলেন স্বদেশে আমার পক্ষে সেনাবাহিনীতে যোগদান অথবা বিশ্ববিদ্যালয় গমন কোনটাই সম্ভব ছিল না তাই আমি চায়নাতে চলে আসি।’ উত্তর কোরিয়ার প্রতি চীনের সমর্থন ইতোপূর্বে কখনই সন্দেহের মুখে পড়েনি। এর মূল কারণ ছিল দুটি প্রথমত, উত্তর কোরিয়ার পতন যদি এক কোরিয়া সৃষ্টি করে তবে মার্কিন প্রভাবিত সেই কোরিয়া চীনের জন্য হুমকি বলেই বিবেচিত হবে। দ্বিতীয়ত, কিমের পতন মানেই চীনে প্রবাসী মিলিয়নেরও বেশি উত্তর কোরিয়ার মধ্যে এক পুনর্মিলন এর জোয়ার সৃষ্টি করবে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা চীন-উত্তর কোরিয়ার সুসম্পর্কে ফাটল ধরিয়েছে। উত্তর কোরিয়ার আণবিক বোমা পরীক্ষা চীনকে বাধ্য করেছে প্রতিবেশী দেশটির ব্যাপারে সতর্ক অবস্থান গ্রহণে। গত মার্চে জাতিসংঘ আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উত্তর কোরিয়ার শিপিং ব্যাংকিং খাতগুলোতে যেমন প্রভাব ফেলেছে তেমনি আকশযানের জন্য তরল জ্বালানি ক্রয়-বিক্রয়েও সমস্যার সম্মুখীন করেছে। জাতিসংঘের এই নিষেধাজ্ঞা ভিন্ন মাত্রা পায় যখন চীন তাতে সম্মতি প্রদান করে : সত্য হলো এই নিষেধাজ্ঞা পরিবর্তিত উত্তর কোরিয়ার জন্য আঘাত হয়েই দেখা দেবে। বর্তমান সৈরশাসকের দাদা ও বাবা দুজনেই বেসরকারী খাতকে নির্মমভাবে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। কিম জং উন ও এ ব্যাপারে আরও নির্মম, অর্থনীতিকে তিনি নিজের মতোই পরিচালনা করতে চান। বৈদেশিক মুদ্রার আরেকটি বড় অংশ আসে হাজারো উত্তর কোরিয়া যারা বর্তমানের দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান তাদের প্রেরিত অর্থ থেকে, বর্তমান অর্থ প্রবাহ অক্ষুণœœ রাখার জন্য চীনের সমর্থন একান্ত আবশ্যক। চীন দীর্ঘদিন ধরেই উত্তর কোরিয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে যাতে তারা চীনের অর্থনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করে এর মাধ্যমে একটি কার্যকরী জোট গঠন করা সম্ভব হয়। জন ডেলুরি যিনি বর্তমানে সিউলের ইয়ন সেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইনিজ স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তার মতে, ‘অন্য কিছুই বেজিংকে এতটা সন্তুষ্ট করবে না যতটা করবে তাদের প্রার্থিত অর্থনৈতিক সংস্কার।’ প্রশ্ন হচ্ছে উত্তর কোরিয়া সংস্কারের পথে কতটা অগ্রসর হবে? চীন এগিয়েছে অনেকটা পথ, মাত্র ছয় মাইল দূরের সীমান্ত শহরের ইয়ালু নদীর ওপর নির্মিত হয়েছে ৩৫০ মিলিয়ন ডলারের ব্রিজ, নতুন রাস্তা, গড়ে তুলেছে ফ্রি ট্রেড জোন, ওয়্যারহাউস, ২০ তলা এ্যাপার্টমেন্ট, দোকানপাট, কিন্তু দোকানগুলো শূন্য কারণ সীমান্তের উত্তর কোরীয় অংশে তারা কিছুই করেনি। ট্রেড ফ্রি জোনের একটি ফার্নিচার ওয়্যারহাউস মালিক সু লি বলেন, আন্তঃ সীমান্ত বাণিজ্যের জন্য গড়ে তোলা হলেও অপর পক্ষের অবদান খুব কম। এটি কেবল ডেলডংয়ের স্থানীয় চাহিদা পূরণে সক্ষম। পিয়ংইয়ং একলা চলো নীতির আছে একটি অন্ধকার দিক, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য তারা বেছে নিয়েছে চরম অনৈতিক পথ যেমন, ড্রাগ সরবরাহ বিশেষত ক্রিস্টাল ম্যাথ, নকল ওষুধ ও মুদ্রা চোরাচালানের মাধ্যমে পাচার করছে চীন, সিউলস্থ কোরিয়া ইনস্টিটিউট অব লিবারেল ডেমোক্রেসির পরিচালক গত ৭ জুলাই এক নিরাপত্তা কনফারেন্সে বলেন, পিয়ংইয়ং ৬৮০০ পেশাদার হ্যাকার ব্যবহার করছে, যাদের কাজ হলো প্রতারণা, ব্ল্যাকমেল এবং অনলাইন জুয়াড় চক্রে গড়ে তোলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, এই অর্থের বার্ষিক পরিমাণ ৮৬০ মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়াও উত্তর কোরিয়ার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি বড় উৎস প্রবাসী শ্রমিক যারা মূলত চীনে কর্মরত। এ ছাড়া রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যেও কোরীয় শ্রমিক কাজ করছে। উত্তর কোরীয় সরকার বহির্বিশ্বে নানা দেশে ১৩০টি রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করে থাকে। তাদের শাখা আছে বেজিং, ইয়াঙ্গুন, ভøাডিভসটক কোনম পেন, ঢাকার মতো শহরে। বর্তমান পরিস্থিতিতে চায়না উত্তর কোরীয় শ্রমিকদের বহিষ্কার করতে পারে। এ ছাড়াও উত্তর কোরীয় সামরিক বাহিনীর এলিট অংশের জন্য বিলাস সামগ্রী যেমন ফ্ল্যাটস্ক্রীন টিভি কিংবা ডিভিডি প্লেয়ার সরবরাহও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই সুবিধাগুলো সেনাবাহিনীকে কিমের পক্ষে রাখতে ভূমিকা পালন করত। উত্তর কোরিয়ার সর্বশেষ আণবিক পরীক্ষার পর হিলারি ক্লিনটন পিয়ং-ইয়ংয়ের সঙ্গে সংলাপের প্রস্তাব করেন। তার রিপাবলিকান প্রতিপক্ষ ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইচ্ছা কিম সাম্রাজ্যের সঙ্গে একটি ফলপ্রসূ সমঝোতায় আসা। কিন্তু সত্যিকার অর্থে কিমকে আণবিক অস্ত্র পরীক্ষা থেকে বিরত রাখার ব্যাপারে ওয়াশিংটনের করার আছে সামান্যই। ট্রয় ইউনিভার্সিটির পিংকস্টোনের মতে, ‘আণবিক শক্তিতে সক্ষমতা অর্জনকে উত্তর কোরিয়া বিবেচনা করছে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও উন্নয়নের আবশ্যিক শর্ত হিসেবে।’ কিমের সামনে সবচেয়ে বাজে দৃষ্টান্ত হচ্ছে সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন ও মোয়াম্মার গাদ্দাফী যারা আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের পথ থেকে সরে এসেও শেষ পর্যন্ত করুণ পরিণতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিম ভালই জানেন তার পিছিয়ে আসার পথ নেই, তেমনি নেই কোন সমঝোতা থেকে লাভের সম্ভাবনা। কিমকে আরও বিবেচনায় নিতে হবে কিছু দেশীয় ফ্যাক্টরও। তার বিশ্বাস একমাত্র আণবিক বোমাই নিজ দেশে তার পারিবারিক শাসনকে নিশ্চিত করতে পারে সেই সঙ্গে বিশ্বের যে কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে সমান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করবে। কিমকে আরও বিবেচনায় রাখতে হবে দুই কোরিয়া একত্রীকরণের যে সুপ্ত বাসনা তার দেশবাসীর মনে আছে সেটিকেও। দক্ষিণ কোরিয়া এ বিষয়ে প্রচার-প্রচারণায় প্ররোচিত করে আসছে উত্তর কোরীয়দের দীর্ঘদিন ধরেই। আর এক কোরিয়া মানে কিমের ভাগ্য জানতে গণক হওয়ার প্রয়োজন নেই। সার্বিক বিবেচনায় কিমের সামনে সবচেয়ে সহজ পথটি ছিল পারমাণবিক শক্তি অর্জন এবং পিয়ং ইয়ং সেটি নিজ চেষ্টায় অর্জন করেছে। তাদের দুটি পারমাণবিক পরীক্ষা ও ২০টি দূরপাল্লার মিসাইল পরীক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে কোন সময় আরেকটি পারমাণবিক পরীক্ষার সক্ষমতা তাদের আছে। ট্রয় ইউনিভার্সিটির পিংকস্টনের অভিমত হচ্ছে, ‘উত্তর কোরিয়া যে কোন আন্তর্জাতিক বা অভ্যন্তরীণ হুমকির মোকাবেলা করে ভায়োলেন্স দিয়ে।’ ধারণা করা হচ্ছে ২০২০ সালের মধ্যে উত্তর কোরিয়া দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে মার্কিন সীমান্তে আঘাত হানার সক্ষমতা অর্জন করবে। আপাতত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও সমস্যা অন্যত্র। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত মিত্র দক্ষিণ কোরিয়া আর জাপানের নিরাপত্তা হুমকির মুখে। জুলাই ৭ এ দক্ষিণ কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র যৌথ ঘোষণায় বলে, দক্ষিণ কোরিয়ার মাটিতে মার্কিন ‘টারমিনাল হাই এলটিচুড এরিয়া ডিফেন্স (থাড) এন্টি ব্যালাস্টিক মিসাইল সিস্টেম স্থাপন করবে। যা হিট টু কিল নামেও পরিচিত। থাডের ডিজাইন করা হয়েছে মার্কিন, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের সুরক্ষার জন্য। সমস্যা হলো ইতোমধ্যে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে মার্কিনীদের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত চীনের জন্য ‘থাড’ মোতায়েন একটি হুমকি বলেই চীন গণ্য করছে। সহজ কথায় কিমের আস্ফালন এশিয়াতে মার্কিন উপস্থিতি জোরদার করছে আর চীন বিষয়টিকে দেখছে তাদের জন্য হুমকিস্বরূপ। কিম কোন পরিস্থিতিতে এক চুল জায়গা ছাড়তে নারাজ। একমাত্র ভরসা চীন। চীনের রয়েছে কিছু কৌশলগত ও কার্যকরী প্রভাব উত্তর কোরিয়ার ওপর। সেই প্রভাব এখন প্রশ্নের মুখে। গত মেতে এক প্রজন্মে একবার অনুষ্ঠিত হওয়া উত্তর কোরীয় লেবার পার্টি কংগ্রেসে প্রথমবারের মতো চীনা প্রতিনিধিরা অনুপস্থিত ছিল, যেখানে কিম চেয়ারম্যানের ভূমিকা পালন করেন। আবার ‘থাড’ মোতায়েনকে সামনে রেখে চীনা সেনাবাহিনীর উর্র্ধতন কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা ২৭ জুলাই কোরীয় যুদ্ধ জয় দিবসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় উত্তর কোরিয়ার সাম্প্রতিক কার্যক্রম বলছে পিয়ংইয়ংয়ের ওপর বেজিংয়ের প্রভাব সীমিত হয়ে আসছে। তাদের স্যাটেলাইট কর্মসূচী অথবা সেপ্টেম্বরে চাইনিজ শহর হানজুতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনের পরই উত্তর কোরিয়ার আণবিক পরীক্ষা এই প্রভাব কমে আসার ইঙ্গিত বহন করে। রেমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সি ইন হং বলেন, ‘আমার ধারণা এই মুহূর্তে পিয়ং ইয়ংয়ের ওপর বেজিংয়ের বিশেষ নিয়ন্ত্রণ নেই আর পিয়ং ইয়ং তাদের কার্যক্রম দ্বারা বেজিংকে বিব্রত করে চলছে অনবরত। কিমের কাছে নিজের নিরাপত্তা ও অবস্থান প্রশ্নে কোন প্রেম কিংবা শত্রুতা বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য নয় দীর্ঘ পরীক্ষিত বন্ধু চীনের মনোভাব। প্রশ্ন যখন চীন-কিমকেও দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে তার চলার পথ। তথ্য সূত্র : টাইমস ও ঝাংচি
×