ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতায় আজও আলোর মুখ দেখেনি বিশেষ কমিটি

থমকে গেছে বাংলাদেশ ভারত চলচ্চিত্র বিনিময়, জটিলতা

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১২ অক্টোবর ২০১৬

থমকে গেছে বাংলাদেশ ভারত চলচ্চিত্র বিনিময়, জটিলতা

মনোয়ার হোসেন ॥ সীমারেখা দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না শিল্পকে। তবে ঢাকাই ছবির ম্রিয়মাণ দশায় শিল্পের রাশ টেনে ধরার বিষয়টি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। এদেশে ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে নতুন বিতর্ক। প্রেক্ষাগৃহের মালিকরা বলছেন, দুর্বল ও নকল গল্প, নির্মাণশৈলীর দুর্বলতায় আক্রান্ত মানহীন ছবি দর্শক টানতে পারছে না। পাশাপাশি কমে গেছে ঢাকাই ছবির উৎপাদনশীলতা। তাই বাধ্য হয়ে প্রেক্ষাগৃহ বাঁচাতে সাফটা চুক্তির আওতায় এ দেশে টালিউডের ছবি চালাতে হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পী রাজ্জাক থেকে শুরু করে ফেরদৌস দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন টালিউডের ছবিতে। বর্তমানে জয়া আহসান, নুসরাত ফারিয়া, সোহানা সাবাসহ অনেক শিল্পী কাজ করছেন সেখানে। দুই দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সূত্র ধরেই বাংলাদেশের ছবি যেমন প্রদর্শিত হতে পারে ভারতে তেমনি ভারতেরও ছবি প্রদর্শিত হতে পারে বাংলাদেশে। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত বলিউডের ছবি যদি বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয় তবে ভারতীয় প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বাধা কেন? তাই সুস্থ প্রতিযোগিতার স্বার্থেই প্রয়োজন চলচ্চিত্রের আদান-প্রদান। আমাদের একটি ছবি প্রদর্শিত হবে ভারতে তার বিপরীতে সেদেশের একটি ছবি প্রদর্শিত হবে এদেশে। অন্যদিকে ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ঘোর বিরোধিতা করছেন পরিচালক ও চলচ্চিত্র শিল্পীদের একাংশ। তাঁদের অভিযোগ হচ্ছে, নিজের দেশের চলচ্চিত্রকে স্বয়ংসম্পূর্ণ না করে ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হলে বড় ক্ষতির সম্মখীন হবে এই শিল্প। হারাতে হবে এদেশের চলচ্চিত্রের বাজার। বাস্তবতা হচ্ছে, সাফটা চুক্তির আওতায় এক দেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হতে পারে আরেক দেশে। উভয় দেশের মধ্যে হতে পারে চলচ্চিত্রের বিনিময়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি ছবি ভারতে প্রদর্শিত হবে এবং বিনিময়ে সেখানকার একটি ছবি প্রদর্শিত হবে এদেশে। এই প্রথায় সম্প্রতি ঢাকাই ছবি ‘রাজা ৪২০’ ও টালিউডের ছবি ‘কেলোর কীর্তি’ বিনিময় হয় দুই দেশের মধ্যে। এ বাস্তবতায় ছবি বিনিময়ে বাধা দূর করতে সাফটা চুক্তিকে গতিশীল করতে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা রাখছে তথ্য মন্ত্রণালয়। সমস্যা নিরসনে তথ্যমন্ত্রীর উদাসীনতাকে দায়ী করছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। উভয় দেশের চলচ্চিত্র বিনিময় বিষয়ে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা প্রায় বছরখানে আগে সাফটা চুক্তির যথাযথ প্রয়োগে একটি নীতিমালা প্রণয়নে বৈঠক করে। তথ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সে বৈঠকে বাংলাদেশ ও ভারতের চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, পরিবেশকসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি যৌথ কমিটি করার সুপারিশ করা হয়েছিল তথ্যমন্ত্রীকে। তথ্যমন্ত্রীকে প্রধান করে ওই কমিটি গঠন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ বিষয়ে উদাসীন ও নির্বিকার তথ্য মন্ত্রণালয়। এখন পর্যন্ত এ কমিটি করার বিষয়ে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে দূর হচ্ছে না এক দেশের চলচ্চিত্র আরেক দেশে প্রদর্শন সংক্রান্ত সঙ্কট। এ অবস্থায় ঢালিউড ও টালিউডের ভরসার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র। এই যৌথ প্রয়োজনার ছবি নিয়ে আবার অনেকের রয়েছে বিরুদ্ধ মত। তাঁদের অভিযোগ, যৌথ প্রযোজনার ছবিতে অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের প্রযোজক, পরিচালক ও শিল্পীর ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে ধুঁকতে থাকা চলচ্চিত্রশিল্প এখন ঘুরপাক খাচ্ছে ঢাকাই ছবি, যৌথ প্রযোজনার ছবি ও ভারতের ছবি প্রদর্শনীর ঘূর্ণাবর্তে। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে। দুই দেশের মধ্যে চলচ্চিত্র বিনিময় ও প্রদর্শনীর বাধা দূর করার বিষয়ে কমিটি গঠনের বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান। জনকণ্ঠকে তথ্যমন্ত্রী বলেন, সাফটা চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এক দেশের ছবি আরেক দেশে প্রদর্শনে আইনগত কোন বাধা নেই। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা চাইলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিঞা আলাউদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, একসময় এদেশে এক সপ্তাহে ৪-৫টি ছবি মুক্তি পেত। এক ঈদে ১৩টি ছবি মুক্তি পাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। অনেক সময় সপ্তাহে একটি নতুন ছবি মুক্তি পাওয়া নিয়েও সংশয় থাকে। মানহীন ও নকল গল্পের দোষে দুষ্ট ছবিগুলো ব্যর্থ হয় দর্শক টানতে। সেক্ষেত্রে আমরা সিনেমা হল বাঁচিয়ে রাখতে বাধ্য হয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির সিদ্ধান্ত নেই। এছাড়া বাংলাদেশের কিছু প্রেক্ষাগৃহে যখন হলিউডের সদ্য নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো মুক্তি পায় তখন শিল্পী বা কলাকুশলীরা কেউ কোনো প্রতিবাদ করেন না। অথচ একটি ভারতীয় ছবি মুক্তি দিলেই শিল্পী ও পরিচালকদের একটি অংশ প্রতিবাদে নেমে পড়ে। যদিও সাফটা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চলচ্চিত্র বিনিময় হতে পারে। উভয় দেশের চলচ্চিত্রশিল্প রক্ষার জন্যই এটা হতে পারে। কিন্তু এই নিয়মতান্ত্রিক বিষয়টিকেই এখন অস্পষ্ট করে তোলা হচ্ছে। এক্ষেত্রে তথ্য মন্ত্রণালয় কোন কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। একইভাবে তথ্যমন্ত্রীর ভূমিকাও নড়বড়ে। সমস্যা সমাধানে তাঁর কোন সদিচ্ছা নেই। সাফটা চুক্তি অনুযায়ী আমাদের একটা ছবি সেদেশে যাবে এবং সেদেশের একটা ছবি এখানে আসবে। বৈধভাবেই এই সুযোগটি রয়েছে। তাছাড়া চলচ্চিত্র বিনিময়ের কারণে একটা সুস্থ প্রতিযোগিতাও গড়ে ওঠে। প্রযোজক, পরিচালক ও শিল্পীদের মধ্যে ভাল ছবি নির্মাণের স্পৃহা বেড়ে যায়। তখন আর কেউ মানহীন চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা ভাববে না। এদেশে ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ক্ষেত্রে শিল্পী ও কলাকুশলীদের আন্দোলন প্রসঙ্গে মিঞা আলাউদ্দীন বলেন, উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির সুবাদে সবাই এখন ঘরে বসেই সারা দুনিয়ার সংস্কৃতি অবলোকন করছে। সেক্ষেত্রে দর্শক যখন ঘরে বসে ভারতীয় চলচ্চিত্র বা নাটক দেখছে তখন তো করার কিছু নেই। তাই ভালো ছবি নির্মাণের প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই আমাদের টিকে থাকতে হবে। কিন্তু ভারতীয় চলচ্চিত্র এদেশে প্রদর্শনের ক্ষেত্রে অযৌক্তিকভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। আমাদের দেশের অভিনেত্রী জয়া আহসান, নুসরাত ফারিয়া, সোহানা সাবাসহ অনেকেই অভিনয় করছেন টালিউডের ছবিতে। অভিনেতা ফেরদৌস এর আগে নিয়মিত অভিনয় করেছেন টালিউডের ছবি। নায়করাজ রাজ্জাকও সেদেশের অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন। তাহলে কেন ভারতের চলচ্চিত্র আমাদের এখানে প্রদর্শনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে? বরং উভয় দেশ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটি নীতিমালার আওতায় একে অপরের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের অংশ হিসেবে চলচ্চিত্রের আদান-প্রদান হতে পারে। এ বিষয়ে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সহ-সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান বলেন, বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র হচ্ছে ভারত। তাই ভারতের চলচ্চিত্র এদেশে প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বিরোধিতার কিছু নেই। তবে এ জন্য একটি যথাযথ নীতিমালা থাকতে হবে। সে লক্ষ্যে প্রায় বছরখানেক আগে বিএফডিসিতে ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশকদের সঙ্গে আমাদের মিটিং হলো। সে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো দুই দেশ মিলে সাফটা চুক্তির অধীনে বিশেষ একটি কমিটি গঠন করা হবে, সেই কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে কিভাবে উভয় দেশের চলচ্চিত্র বিনিময় হবে। সমস্যা সমাধানে একটি রূপরেখা তৈরি করে তথ্যমন্ত্রীকে সুপারিশ করা হলো। তথ্যমন্ত্রীকে প্রধান করে কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হলো। কিন্তু তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতায় আজও আলোর মুখ দেখেনি সেই কমিটি। ফলে উভয় দেশের মধ্যে চলচ্চিত্র বিনিময়ও থমকে গেছে। উল্টো বাড়ছে জটিলতা। রাজধানীর পুরনো ও জনপ্রিয় প্রেক্ষাগৃহ মধুমিতার স্বত্বাধিকারী নওশাদ উদ্দীন ইফতেখার বলেন, বাংলাদেশে এখন ছবির উৎপাদন কমে গেছে। একইভাবেই প্রযোজকের সংখ্যাও হ্রাস পেয়েছে। ভাল পরিচালকের সংখ্যাও ক্রমশ কমে আসছে। রাজ্জাক, ববিতা, শাবানা, আলমগীর, কবরী, রোজিনা, সোহেল রানা, সালমান শাহ, শাবনূর কিংবা মৌসুমীর মতো দর্শকপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য শিল্পী তৈরি হচ্ছে না। তাঁদের এই শূন্যতা হাল আমলের শিল্পীরা পূরণ করতে পারছে না। তার মধ্যে আবার নতুন ছবির অধিকাংশই ভুগছে গল্পহীন ও দুর্বল নির্মাণশৈলীতে। অবস্থান এমন যে শাকিব খান অভিনীত ছবি ছাড়া অন্য শিল্পীর ছবি দর্শক টানে না এবং ব্যবসাও করে না। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে আমরা ভারতীয় ছবির দিকে ঝুঁকছি। সম্প্রীতি টালিউডে কেলোর কীর্তি ছবিটি আমাদের প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয়েছে এবং খুব ভাল ব্যবসা করেছে। একইভাবে যৌথ প্রযোজনার ছবি বাদশা ও শিকারীও ব্যাপক দর্শক টেনেছে। সাফটা চুক্তির আওতায় বৈধভাবেই বাংলাদেশের একটা ভারতে প্রদর্শিত হবে এবং সেদেশের ছবি এদেশে প্রদর্শিত হবে। কিন্তু ভারতীয় ছবি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে একটি মহল অযৌক্তিকভাবে বিরোধিতা করছে। এমনকি বলা হচ্ছে সাফটা চুক্তির ভেতরেও নতুন করে নীতিমালা করতে হবে। ওই চুক্তি যখন সম্পন্ন হয় তখন এমন কোন কথা ছিল না। আক্ষেপ করে এই প্রেক্ষাগৃহ প্রদর্শক বলেন, বাধ্য হয়ে গত সপ্তাহেও আমার সিনেমা হলে হলিউডের ছবি চালিয়েছি। কারণ, দর্শক টানবে এমন কোন নতুন ছবি আমি পাইনি। এ সপ্তাহে অমিতভাভ রেজা নির্মিত মৌলিক গল্পনির্ভর আয়নাবাজি ছবিটি বেশ ভাল দর্শক টানছে। তবে এমন মৌলিক ছবি তো সারা বছর পাওয়া যায় না। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে আগামী বছর আমার প্রেক্ষাগৃহটি ৫০টি বছর পূর্ণ করলেও এখন এই অর্ধশতাব্দী পুরনো প্রেক্ষাগৃহটি বন্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনা করছি। গত ৪০ বছরে তো আমরা কখনও ভারতীয় ছবির দিকে ঝুঁকিনি। ঢালিউডের একটি নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি চালানোর জন্য আকুল হয়ে থাকতাম। আর এখন প্রেক্ষাগৃহ বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থেই আমরা ছবি আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছি। দেশের নির্মাতা কিংবা প্রযোজকরা আমাদের মানসম্পন্ন ছবি উপহার দিলে আমরা ছবি রফতানির কথা ভাবব না। তার বদলে এদেশের চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কিছু মানুষের কাছে নিজেকে ভারতবিদ্বেষী হিসেবে তুলে ধরাই প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলচ্চিত্র বিনিময় এবং যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার কথা উল্লেখ করেন চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াত। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে চলচ্চিত্র বিনিময়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। আমাদের দেশের একটা ছবি যদি ভারতে প্রদর্শিত হয় একইভাবেই ভারতেরও একটা ছবি প্রদর্শিত হবে এদেশে। তবে আমাদের চলচ্চিত্রের বাজার ধরে রাখার বিষয়েও সচেতন হতে হবে। তাই সমস্যা নিরসনে প্রয়োজন দুই দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়। চলচ্চিত্র বিনিময় প্রথাটিকে এগিয়ে নিতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা দরকার। সাফটা চুক্তির অধীনে বিনিময় প্রথাটিকে সময় উপযাগী একটি কাঠামোর মধ্যে দাঁড় করাতে হবে। এমনটা হলে উভয় দেশের চলচ্চিত্রের জন্যই মঙ্গলজনক হবে। সমতার ভিত্তিতে দুই দেশের ছবির বিপণন হবে। যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে বলেন, এ ধরনের ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে সম-অধিকার রক্ষা করতে হবে। উভয় দেশের শিল্পী, কলা-কুশীল ও পরিচালককে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। একইভাবে একটি ছবিতে কে কতটুকু বিনিয়োগ বিনিয়োগ করবে এবং কিভাবে লভ্যাংশ বণ্টন হবে সেটাও নিশ্চিত করে উল্লেখ থাকতে হবে। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, সাফটা চুক্তির আওতায় দুই দেশের মধ্যে চলচ্চিত্রের আদান-প্রদান হতেই পারে। এক্ষেত্রে উভয় দেশের মধ্যে সমমানের ছবির বিনিময় হতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ভারতের একটি নতুন ছবি এনে আমাদের একটি পুরনো ছবি পাঠানো হচ্ছে সেখানে। তাই সাফটা চুক্তিটির যথাযথ প্রয়োগের জন্য ছয় মাস আগে তথ্য মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আমরা এই চুক্তির ভেতরেই একটি নীতিমালা তৈরির সুপারিশ করেছিলাম। যেখানে বাংলাদেশ ও ভারতের চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, শিল্পী প্রদর্শকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি যৌথ কমিটি করার কথা বলা হয়েছিল। ওই কমিটির মাধ্যমেই এক দেশের ছবি আরেক দেশে বিনিময় বা প্রদর্শনের বিষয়টি নির্ধারিত হবে। ওই কমিটি যাচাই করবে উভয় দেশের মধ্যে কোনো ছবিগুলো বিনিময় হবে। এক দেশের ছবি আরেক দেশে কেমন চলছে কিংবা কতটা ব্যবসাসফল হচ্ছে সে বিষয়েও পর্যবেক্ষণ করবে এই কমিটি। এটা হলে এক দেশের ছবি আরেক দেশে প্রদর্শন নিয়ে কোন সমস্যাই হতো না। কোন পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। তবে এই কমিটি করার বিষয়ে এখন পর্যন্ত তথ্য মন্ত্রণালয় কোন ভূমিকা রাখেনি। মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতায় জটিলতা নিরসন না হয়ে উল্টো বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে হলিউডের ছবি প্রদর্শন প্রসঙ্গে গুলজার বলেন, হলিউডের ছবি এখানে প্রদর্শন হলেও সেটার দর্শক কম হওয়ায় তেমনভাবে প্রভাব পড়ে না। তাই এ বিষয়ে আমরা তেমন সোচ্চার নই। সিনেমা হল মালিকদের নি¤œমানের ছবির কারণে দেশের ছবির পরিরবর্তে ভারতের ছবি আনার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা মানছি বছরে যতগুলো ছবি নির্মিত হচ্ছে তার বেশিরভাগই মানহীন হচ্ছে। তার মধ্যেও কিছু ছবি ভাল হচ্ছে এবং ব্যবসা করছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আমাদের হল মালিকরা ছবির প্রদর্শন করলেও প্রযোজকদের ন্যায্য পাওনা দিতে গড়িমসি করেন। তার মধ্যে আবার বুকিং এজেন্ট নামের একটি তৃতীয় পক্ষ সৃষ্টি করে প্রযোজক ও পরিচালকদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। কিংবদন্তি চলচ্চিত্রশিল্পী নায়করাজ রাজ্জাক বলেন, এখন আসলে ঢালিউড ও টালিউড দুই চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতেই মন্দা যাচ্ছে। দুই দেশের ছবির ব্যবসাটা ভালো চলছে না। সাংস্কৃতিক বিনিময় প্রথা অনুযায়ী এক দেশের ছবি আরেক দেশে প্রদর্শিত হতেই পারে। এক্ষেত্রে সাফটা চুক্তির আওতায় উভয় দেশের মধ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটি যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। ভারতের ১০টা ছবি যদি বাংলাদেশে প্রদর্শিত হয় একভাবেই বাংলাদেশের দশটি ছবিও ভারতে প্রদর্শনের সুযোগ থাকতে হবে। নন্দিত চলচ্চিত্রশিল্পী ববিতা বলেন, যৌথ প্রযোজনা কিংবা চলচ্চিত্র বিনিময়Ñসব কিছুই হতে হবে সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। এক দেশের ছবি আরেক দেশে প্রদর্শনের উভয় দেশের চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টদের একটি কেন্দ্রবিন্দুতে আসতে হবে। যদি সবাই একমত হয়ে কাজ করে তাহলে উভয় দেশের চলচ্চিত্রের জন্যই তা কাক্সিক্ষত ফল বয়ে আনবে। সেক্ষেত্রে সাফটা চুক্তির আওতায় নীতিমালা তৈরির মাধ্যমে হতে পারে চলচ্চিত্রের আদান-প্রদান। ভারতের চলচ্চিত্রে প্রিয়মুখ হয়ে যাওয়া এদেশের অভিনেতা ফেরদৌস বলেন, সুষ্ঠু একটি নীতিমালা মেনে দুই দেশের মধ্যে চলচ্চিত্রের আদান-প্রদান হলে আপত্তির কিছু থাকে না। সাফটা চুক্তির যথাযথ প্রযোগের মাধ্যমে এক দেশের ছবি অন্য দেশে প্রদর্শিত হতেই পারে। এ বিষয়ে উচ্চবাচ্য করার কিছু দেখি না। এটা উভয় দেশের চলচ্চিত্রের জন্য ফলপ্রসূ হবে। তাই এ বিষয়ক জটিলতা নিরসনের তথ্য মন্ত্রণালয়ের যথাযথ ভূমিকা রাখা উচিত। এছাড়া বর্তমান উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির কারণে সবকিছুই সবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে আছে। ভারতীয় ছবি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে নীতিমালার বাইরে ফাঁকি দিয়ে কিছু করা হলে সেক্ষেত্রে আমরা প্রতিবাদ করব। একইভাবে যথাযথ নীতিমালা অনুসরণ করে যৌথভাবে ছবি নির্মাণ হতেই পারে। দুই দেশের শিল্পী ও কলাকুশীলদের অংশগ্রহণ এবং বাণিজ্যের বিষয়ে সমান অংশীদারিত্ব থাকলে সেটা উভয় দেশের চলচ্চিত্রের জন্যই মঙ্গলজনক হবে। সময়ের আলোচিত অভিনয়শিল্পী জয়া আহসান বলেন, আসলে সীমারেখা দিয়ে শিল্পকে আটকে রাখা যায় না। তবে শিল্পের আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে ভারসাম্য থাকতে হবে। ঢালাওভাবে শুধু ভারতীয় ছবি যেমন এদেশে প্রদর্শন কাক্সিক্ষত নয়, তেমনি এদেশের ভাল কাজটা সেদেশে প্রদর্শিত হওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সেক্ষেত্রে বুঝতে হবে ওদের দেশের দর্শক আমাদের কোন ধরনের ছবিগুলো দেখতে চায়। তাই একটা গ-ির মধ্যে থেকে কপি করা ছবিগুলো ভারতে পাঠানোর মানে হয় না। সেদেশের দর্শক দেখতে চায় আমাদের মৌলিক গল্পনির্ভর ছবিগুলো। এজন্য সাফটা চুক্তির অধীনে উপযুক্ত নীতিমালার মাধ্যমে এক দেশের ছবি আরেক দেশে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা উচিত। কথা হয় দেশে বর্তমানে যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণের অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টি মিডিয়ার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলিমুল্লাহ খোকনের সঙ্গে। এদেশে ভারতীয় ছবির প্রদর্শন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাফটা চুক্তি অনুযায়ী আমাদের ছবি ভারতে প্রদর্শিত হবে এবং ভারতের ছবি এদেশে প্রদর্শিত হবে। অথচ ভারতীয় ছবি এদেশে প্রদর্শন নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। হলিউডের ছবি যথন এদেশে চলে তখন উচ্চবাচ্য না হলেও ভারতীয় ছবি প্রদর্শনের বেলায় বদলে যায় দৃশ্যপট। আসলে হলিউড ও ভারতীয় উভয় ছবিই তো বিদেশী ছবি। এক্ষেত্রে দ্বৈত আচরণ দেখা যায় আমাদের কিছু পরিচালক ও শিল্পীদের মাঝে। যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এক্ষেত্রেও শুরুতে অনেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। একটি স্বার্থান্বেষী মহল এই কাজটি করেছে। মূলত তাদের কারণেই ঢাকাই ছবিতে কাটপিস জুড়ে দেয়া নকল গল্পের ছবি হলবিমুখ করেছে দর্শককে। অথচ এখন যৌথ প্রযোজনার ছবিগুলো পরিবার নিয়ে হলে বসে দেখছে অনেকেই। নিয়ম মেনেই এসব ছবি নির্মিত হচ্ছে। এছাড়া যৌথ প্রযোজনার ছবির কারণে দেশের শিল্পীদের পরিচিত বাড়ছে। তাঁদের মধ্যে নুসরাত ফারিয়াসহ অনেকেই ভারতের ছবিতে কাজেরও সুযোগ পেয়েছে। এছাড়াও জয়া আহসান নিজের মেধায় একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন টালিউডে। একইভাবে সোহানা সাবাসহ অনেকেই এখন সেদেশে অভিনয়ের সুযোগ পাচ্ছে। ভবিষ্যতেও এই সুযোগ অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছি।
×