ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হোসেনী দালান এলাকায় অলিখিত ১৪৪ ধারা

তাজিয়া মিছিল ঘিরে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয়

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১২ অক্টোবর ২০১৬

তাজিয়া মিছিল ঘিরে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয়

গাফফার খান চৌধুরী ॥ গত বছর পুরনো ঢাকার হোসেনী দালানে জঙ্গী হামলায় হতাহতের কারণে এবার তাজিয়া মিছিল ঘিরে থাকছে স্মরণকালের সবচেয়ে কড়া নিরাপত্তা। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিঘœ ঘটানোর অভিযোগে তাজিয়া মিছিলকারী ১৪ পাইককে আটক করা হয়েছে। তাজিয়া মিছিলকে কেন্দ্র করে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে হোসেনী দালান, ফরাশগঞ্জের বিবিকা রওজা, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের জেনেভা ক্যাম্পগুলোসহ আশপাশের এলাকায় তল্লাশি চলছে। বিশেষ করে হোসেনী দালানের আধাকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গত সপ্তাহজুড়ে অলিখিত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। ইমামবাড়ার আশপাশের বাসাবাড়িতে আগত অতিথিদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। আর ইমামবাড়া লাগোয়া মেসগুলোর বাসিন্দাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ইমামবাড়ার দুটি ফটকে আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর বসানো হয়েছে। এছাড়া আশপাশের রাস্তা, উঁচু ভবন, স্থাপনায় বসানো হয়েছে অসংখ্য সিসি ক্যামেরা। ইমামবাড়ার আশপাশে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত সব ধরনের ভাসমান দোকানপাট তুলে দেয়া হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অতিরিক্ত পুলিশ ও র‌্যাব মোতায়েনের পাশাপাশি প্রস্তুত রাখা হয়েছে বিজিবিকে (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ)। হোসেনী দালানের অবস্থান ॥ পুরনো ঢাকার চাঁনখারপুল থেকে ডানদিকে সামান্য অদূরেই ৩০ নম্বরে হোসেনী দালান ইমামবাড়ার অবস্থান। প্রায় ৪শ’ বছরের পুরনো স্থাপনা এটি। হোসেনী দালান কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ঠিক উল্টোদিকেই স্থাপনাটি। দুটি স্থাপনার মাঝ দিয়ে প্রায় ২০ ফুট চওড়া একটি রাস্তা গেছে। হোসেনী দালানে প্রবেশের দুটি লোহার বড় গেট। প্রধান গেটটি মসজিদের দিকে। প্রধান গেট দিয়ে ঢুকতেই ১০ থেকে ১২ গজ সামনেই দোতলা দারুল কুরআন লাইব্রেরী ভবন। পূর্বদিকে ফুল ও লাড্ডুসহ খাবারের দোকান। পশ্চিমপাশেই দারুল কুরআন শেফাখানা এ্যান্ড ডেন্টাল ক্লিনিক। ক্লিনিকের সঙ্গে চওড়া কবরস্থান। কবরস্থানটি হোসেনী দালানের মূল স্থাপনা পর্যন্ত। সেখানে একটি লাইব্রেরী রয়েছে। লাইব্রেরী থেকে হোসেনী দালানের মূল স্থাপনা অন্তত ছয় শ’ গজ দূরে। মাঝখান দিয়ে অন্তত এক শ’ ফুট পাকা উঠোন। পূর্বদিকে লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা মেহগিনিসহ অন্যান্য ফলদ ও বনজ গাছের বাগান। দোতলা মূল স্থাপনা লাগোয়া একটি বড় পুকুর। যার চারদিক বাঁধাই করা। দক্ষিণদিকে একটি প্রবেশ পথ রয়েছে। তাতেও লোহার গেট লাগানো। তবে তা প্রধান ফটকের তুলনায় ছোট। হোসেনী দালানের ভেতরে থাকা কবরস্থানের দেয়াল প্রায় ছয় ফুট উঁচু ছিল। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ॥ এবার হোসেনী দালানের পশ্চিমপাশে থাকা দেয়ালের ওপর কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হয়েছে। দেয়াল লাগোয়া অন্তত ২৫টি মেস রয়েছে। মেসগুলোতে সেখানে থাকা গার্মেন্টসের বিভিন্ন ছোটখাটো মালামাল বোতাম, চেন, শার্টের কলারে লাগানো প্লাস্টিকের প্যাকিংসহ নানা জিনিসপত্র তৈরির কারখানা রয়েছে। কারখানার কর্মচারীরা মেসগুলোতে বসবাস করেন। তাদের বিশেষ নির্দেশনায় ইতোমধ্যেই ছুটি দিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের অন্যত্র সরে যেতে বলেছে কারখানা ও আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ। মেসগুলোর প্রবেশপথে পুলিশকে পাহারা দিতে দেখা গেছে। এছাড়াও আশপাশে ঘন ঘন নিরাপত্তা চৌকি বসানো হয়েছে। মেস সংলগ্ন রাস্তায় সব ধরনের ভাসমান দোকানপাট বসানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর হোসেনী দালানের দুই ফটকের সামনেসহ আশপাশের এলাকায় কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত নিষিদ্ধ করা হয়েছে সব ধরনের দোকানপাট বসানো। স্থানীয়রা বলছিলেন, দীর্ঘদিন ধরেই পুরো এলাকার বাসাবাড়িতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘন ঘন রেড দিচ্ছে। যখন তখন তল্লাশি চালাচ্ছে। বাসাবাড়িতে নতুন কোন মানুষ আসামাত্রই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছে। এদিকে তাজিয়া মিছিলে যেকোন ধরনের নাশকতা এড়াতে হোসেনী দালানের আশপাশে প্রতিটি প্রবেশ রাস্তায় চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। চাঁনখারপুলসহ আশপাশের প্রতিটি রাস্তায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। অন্যদিকে বক্সীবাজারেও বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। এককথায় হোসেনী দালানের দিকে যেতে প্রতিটি রাস্তায়ই চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। তল্লাশি চলছে সন্দেহভাজনদের দেহ ও মহিলাদের ব্যাগসহ অন্যান্য জিনিসপত্র। এবার কোন কিছুই তল্লাশি থেকে রেহাই পাচ্ছে না। হোসেনী দালান কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, গত বছর পুরো এলাকা মনিটরিং করতে ৩২টি সিসি ক্যামেরা লাগানো ছিল। এবার হোসেনী দালানেই অন্তত এক শ’ সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। দালানের প্রতিটি জায়গায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সার্চ লাইট বসানো হয়েছে। বিদ্যুত চলে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এগুলো জেনারেটরের মাধ্যমে জ্বলবে। বড় বড় জেনারেটর বসানো হয়েছে। ইমামবাড়ার প্রবেশপথ দুটিতে আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর বসানো হয়েছে। গত বছর হামলাকারীরা পরিকল্পিতভাবে হুড়মুড় করে বোমাসহ ঢুকে পড়েছিল। এবার সে সুযোগ থাকছে না। সবাইকে লাইনে দাঁড়িয়ে আস্তে দেহ তল্লাশির পর ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হবে। যেকোন ধরনের অরাজক পরিস্থিতি এড়াতে পুলিশের সোয়াত, ক্রাইসিস রেসপন্স টিম, বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, র‌্যাবের ডগ স্কোয়াড, র‌্যাবের হেলিকপ্টার ও বিজিবি প্রস্তুত রাখা হচ্ছে। হোসেনী দালানের আশপাশের উঁচু ভবনের ছাদে ওয়াচ টাওয়ার বসানো হয়েছে। সেখান থেকে বাইনোকুলারে পুরো এলাকার ওপর মনিটরিং করা হচ্ছে। বসানো হয়েছে পুলিশ ও র‌্যাবের কন্ট্রোলরুম। কন্ট্রোলরুম থেকে সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকা এলাকাগুলোর লোকজনের গতিবিধির ওপর নজর রাখা হচ্ছে। ভেতরে-বাইরে মোতায়েন করা হয়েছে অসংখ্য পুলিশ ও র‌্যাব। সাদা পোশাকে মোতায়েন করা হয়েছে অসংখ্য গোয়েন্দা সদস্য। হোসেনী দালানের ইমামবাড়ার বহু গাছে অসংখ্য গোপন ক্যামেরা বসানো হয়েছে। হোসেনী দালান ইমামবাড়ার খাদেম কমিটি সূত্রে জানা গেছে, ইমামবাড়ার ৫টি কমিটি রয়েছে। এবারের অনুষ্ঠান নিয়ে তারা আতঙ্কিত নয়। কমিটির তরফ থেকে বিপুল পরিমাণ স্বেচ্ছাসেবক মোতায়েন করা হয়েছে। তারা নিরাপত্তার বিষয়েও সতর্ক নজর রাখবেন। নিরাপত্তা নিয়ে ইতোমধ্যেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে কয়েক দফায় বৈঠক হয়েছে তাদের। সেসব বৈঠকে গত বছর হোসেনী দালানে তাজিয়া মিছিলে হামলার পাশাপাশি গুলশানের হলি আর্টিজান, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের বৃহত্তম ঈদ জামাতসহ বিভিন্ন মাজারে হামলার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। হামলার আশঙ্কা মাথায় রেখেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। শুধু হোসেনী দালানে নয়, এমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকছে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে অবস্থিত আটকেপড়া পাকিস্তানীদের বসবাসকারী জেনেভা ক্যাম্পগুলোতেও। এছাড়া বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকছে ঢাকার ফরাজগঞ্জের বিবিকা রওজাকে ঘিরে। মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের জেনেভা ক্যাম্পের আশপাশের সব রাস্তায় অতিরিক্ত পুলিশ ও র‌্যাব মোতায়েন করা হয়েছে। বসানো হয়েছে অসংখ্য নিরাপত্তা চৌকি। বেশ কিছু সিসি ক্যামেরাও বসানো হয়েছে মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের জেনেভাক্যাম্পগুলো ঘিরে। এছাড়া যেসব রাস্তায় তাজিয়া মিছিল যাতায়াত করবে, সেসব রাস্তায় আগ থেকেই অতিরিক্ত পুলিশ ও র‌্যাব মোতায়েন করা হয়েছে। নিরাপত্তায় বিঘœ ঘটানোর অভিযোগে ১৪ পাইক আটক ॥ মঙ্গলবার হোসেনী দালান থেকে তাজিয়া মিছিল বের হয়। মিছিল থেকে নিরাপত্তা বিঘিœত করার অভিযোগে ১৪ পাইককে আটক করে পুলিশ। চকবাজার থানার ওসি শামীমুর রশিদ তালুকদার জানান, নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ধারালো অস্ত্র বহন করায় মঙ্গলবার বিকেলে তাদের আটক করা হয়। মহরমের তাজিয়া মিছিলে ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ মাতম তুলে যারা দা, ছোরা, কাঁচি, বর্শা, বল্লম, তরবারি নিয়ে বিশেষ পোশাকে সজ্জিত হয়ে নিজেদের শরীর রক্তাক্ত করেন তারা পাইক হিসেবে পরিচিত। প্রসঙ্গত, গত বছর তাজিয়া মিছিলের বিষয়টি মাথায় রেখেই এ বছর ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া ঢাকায় দিনেরবেলায় তাজিয়া মিছিল বের করার নির্দেশ জারি করেছেন। মিছিলে বহনকারী নিশানের উচ্চতা ১২ ফুটের বেশি হতে পারবে না বলে বিধিনিষেধ জারি করেন তিনি। মিছিলে দা, কাঁচি, ছুরি, বল্লম বহন নিষিদ্ধ করা হয়। তাজিয়া মিছিল ঘিরে তিনস্তরের নিরাপত্তা বলয় থাকছে বলেও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। তাজিয়া মিছিলের বিষয়ে মোহাম্মদপুরে অবস্থিত মার্কেট ক্যাম্পের চেয়ারম্যান এসকে গোলাম জিলানী জানান, তাজিয়া মিছিল ঘিরে কোন ধরনের অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির সম্ভবনা নেই। এ বিষয়ে তারা সতর্ক রয়েছেন। পবিত্র আশুরার যাবতীয় কর্মকা- শান্তিপূর্ণভাবে পালনের জন্য ক্যাম্পবাসীর প্রতি তারা আহ্বান জানিয়েছেন। তাজিয়া মিছিলে যেকোন ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। তাজিয়া মিছিল ঘিরে নাশকতার সম্ভবনা নেই জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অন্যতম মুখপাত্র উপকমিশনার মাসুদুর রহমান। র‌্যাবের তরফ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি থাকার কথাও জানিয়েছেন র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান। উল্লেখ্য, হিজরি পঞ্জিকার ১০ মহরম মুসলিম বিশ্বে আশুরা পালিত হয়। এক হাজার ৩৩২ বছর আগে এই দিনে মহানবী হযরত মুহম্মদ (স.)-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসেন (রা.) ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে শহীদ হন। দিনটিকে স্মরণ করে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন তাজিয়া মিছিল বের করেন। কারবালার রক্তাক্ত স্মৃতি স্মরণে এ সময় অনেককেই ‘হায় হোসেন-হায় হোসেন’ মাতম তুলে নিজের দেহে আঘাত করে রক্ত ঝরান। চার শ’ বছরের ইতিহাস ভেঙ্গে গত বছরের ২৩ অক্টোবর হোসেনী দালানে হ্যান্ডগ্রেনেড দিয়ে হামলা করে জঙ্গীরা। এতে দুজন নিহত ও শতাধিক আহত হন। পরবর্তীতে হামলাকারীরা ধরা পড়ে। হামলাকারীদের অধিকাংশই জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের সদস্য ছিল। এ মামলায় ১০ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশীট দিয়েছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
×