ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অবাধে চলছে শামুক নিধন

ছোট্ট জলজ প্রাণী- জীব বৈচিত্র্য ও পরিবেশ নিয়ন্ত্রক

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১২ অক্টোবর ২০১৬

ছোট্ট জলজ প্রাণী- জীব বৈচিত্র্য ও পরিবেশ নিয়ন্ত্রক

সমুদ্র হক ॥ পানি দূষণ, পরিশোধন, জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি ও পরিবেশের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ জীববৈচিত্র ধরে রাখার নিরীহ ছোট্ট জলজ প্রাণী শামুক নিধন চলছে বেপরোয়াভাবে। বৃষ্টির পানিতে জমে থাকা ও জলাভূমিতে প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে বেড়েওঠা শামুক এখন আর সহজে চোখে পড়ে না। বৃষ্টির দিনে গ্রামের পথঘাটে, বাড়ির উঠানে উঠে আসত খুবই ধীর গতিতে চলা শামুক। এখন তাও আর আসে না। ইতোমধ্যে সোনালি শামুকসহ কয়েক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ধীরে চলা এই জলজ প্রাণী বাগধারায় প্রবেশ করেছে। কোন কিছু গতি না পেলে কোন কিছু সময়মতো নির্দিষ্ট জায়গায় না পৌঁছলে বলা হয় শম্বুকগতি। এই জলজ প্রাণীটি রক্ষায় কোন ভূমিকাই নেই। দেশের সবচেয়ে বড় চলনবিলের শামুক শুধু নিধন নয় পাচারও শুরু হয়েছে। ফলে জীববৈচিত্র ও প্রাকৃতিক পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। বন্যপ্রাণি সুরক্ষা আইনে শামুক নিধন নিষিদ্ধ। নিত্যবছর বর্ষা থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত জলাভূমি ও অধিকাংশ আবাদি জমি কম-বেশি ডুবে থাকে। সেখানেই প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয় শামুক। একটা সময় এই শামুক কখনও নিধন করা হতো না। প্রয়োজনও পরত না। গ্রামীণ জীবনের সকলেই জানত এই শামুক মরে গিয়ে মাংস ও খোলস পচে আবাদি জমিতে প্রাকৃতিকভাবেই ফসফেট, পটাশ ও ক্যালসিয়াম তৈরি করে। জমিতে জৈব পদার্থের সঙ্গে প্রকৃতি থেকেই যুক্ত হয় শতভাগ খাঁটি রাসায়নিক। এই জৈব পদার্থ ও প্রাকৃতিক রাসায়নিক সার ফসলের উৎপাদন বাড়ায় একই সঙ্গে ধানগাছের শিকড় মজবুত করে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে আমন চারার উপকার করে। পাশাপাশি জলাশয়ের দূষিত পানি পরিশোধনে (ফিল্টার) বড় ভূমিকা পালন করে দূষণমুক্ত রাখে। নদী-খাল-বিলের দেশীয় মাছের অন্যতম খাদ্য শামুকের নরম ডিম। কৈ, শিং, মাগুর, ট্যাংরা, টাকি, শোল, পাবদা মাছের খাদ্যের বড় একটি অংশ যোগায় শামুক তার ডিম দিয়ে। এই খাবার না পেলে মাছের পোনা মারা যায়। শামুক নিধন হওয়ায় দেশী মাছের বিস্তার কমছে। শামুক নিধনের দৃশ্য চোখে পড়ে চলনবিল এলাকায় গেলে। সেখানে প্রকাশ্যেই সংগ্রহ করা হচ্ছে শামুক। বিলপারে যেখানে জলাভূমি আছে সেখানে নৌকা করেও শামুক সংগ্রহ হয়। প্রতিকেজি শামুক বিক্রি হয় ১শ’ ৫০ টাকা থেকে ২শ’ টাকা কেজিদরে। হালে ঢাকা-চট্টগ্রাম-খুলনার মহাজনরা এই শামুক সংগ্রহ করছে। এক শামুক ব্যসায়ী জানালেন, চলনবিল এলাকা থেকে প্রতিমাসে অন্তত ৫শ’ মেট্রিক টন শামুক সংগ্রহ করা হয়। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা-পদ্মা-মেঘনাপারে এবং ছোট নদীগুলো থেকেও শামুক আহৃত হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা শামুক সংগ্রহ ও প্রসেস করে চোরাইপথে পাচার করছে। সূত্র জানায়, খুলনা থেকে সুকৌশলে চিংড়ির মধ্যে শামুক রেখে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। উল্লেখ্য, চিংড়ি রফতানি হয় বৈধভাবেই। ব্যবসায়ীরা এই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে। বিলপারের লোকজন জানানÑ প্রতিদিন ট্রাকে করে শামুক যাচ্ছে খুলনার দিকে। শামুক নিধন রোধে আইন আছে, তবে তার প্রয়োগ নেই। বর্তমান আইনে বন্যপ্রাণি শিকার, বধ করা, সংগ্রহ করা, নিধন ও ধ্বংস করা যাবে না। বেচাকেনা করাও যাবে না। এই আইন না মানলে শাস্তি ও জরিমানার বিধান রয়েছে। জলজ প্রাণীর মধ্যে ব্যাঙ-শামুক-ঝিনুক -কাঁকড়া-কচ্ছপ রয়েছে। সূত্র জানায়, অনুমিত নিয়ে এসব জলজ প্রাণী রফতানি করা যায়। অনুমতি ছাড়াই অনেক জলজ প্রাণী বাইরে চলে যাচ্ছে চোরাইপথে। সূত্র জানায়, কোন বন্য ও জলজ প্রাণী রফতানির অনুমতি দেয়ার আগে দেখা হয় রফতানি হলে দেশের পরিবেশের কোন ক্ষতি করবে কিনা। ক্ষতি হলে তা রফতানির অনুমতি দেয়া হয় না। এই আইন বহাল থাকার পরও শামুক নিধন ও পাচার শুরু হয়েছে। ফলে কৃষিজমি হারাচ্ছে উর্বরতা, জীববৈচিত্র লুপ্ত হয়ে পরিবেশ হারাচ্ছে ভারসাম্যহীনতা।
×