ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আজ থেকে ২২ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১২ অক্টোবর ২০১৬

আজ থেকে ২২ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ প্রজননের মাধ্যমে বংশ বিস্তারের সুবিধার্থে আজ ১২ অক্টোবর থেকে আগামী ২ নবেম্বর পর্যন্ত সাগর ও নদী মোহনা থেকে ইলিশ আহরণ বন্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকর হচ্ছে। টানা ২২ দিন ইলিশ আহরণের পাশাপাশি মজুদ, পরিবহন, বাজারজাতকরণের ওপরও নিষেধাজ্ঞা বলবত থাকবে। সরকারী এ নির্দেশের আলোকে ইতোমধ্যেই কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বরগুনা, খুলনা, পটুয়াখালী, চাঁদপুরসহ উপকূলজুড়ে হাজার হাজার ইঞ্জিনচালিত ফিশিং বোট ও ট্রলার ক্যাপ্টেন ক্রু ও মাঝিমাল্লাসহ জেটি ও ঘাটে ঘাটে ফিরে এসেছে। মৎস্য বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশজুড়ে প্রায় ৬৭ হাজার যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক বোট মৎস্য আহরণে নিয়োজিত। এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ ইলিশ আহরণ করে থাকে। এছাড়া সাগরে ট্রলারের বিচরণ রয়েছে প্রায় আড়াই শ’। এসব যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক ফিশিং বোট ও ট্রলারে আহরণে নিয়োজিত মাঝিমাল্লা ও ক্যাপ্টেন, ক্রুর সংখ্যা প্রায় পৌনে তিন লাখ। ইলিশ উৎপাদন বাড়াতে করণীয় নিয়ে গত ৯ অক্টোবর থেকে দেশী বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ১৪ জনের একটি টিমের সাগরে নতুন গবেষণা মিশন শুরু হয়েছে। এ মিশনের অন্যতম কাজ হবে সাগরের বাংলাদেশী এলাকায় ইলিশের উৎপাদন ও আহরণ আরও বৃদ্ধিতে করণীয় কী, তা নির্ধারণ করা। এ বিশেষজ্ঞ দলে রয়েছেন দুইজন মালয়েশিয়ান ও অন্যরা বাংলাদেশী। বাংলাদেশীর মধ্যে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের চাঁদপুর স্টেশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিছুর রহমানও রয়েছেন। আশা করা হচ্ছে যেহেতু ইতোমধ্যে সুফল এসেছে আগামীতে এ সফলতা আরও বৃদ্ধি পাবে যদি সরকারী বিধি-বিধান কার্যকর থাকার পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়টি বহাল থাকে। মুঠোফোনে মঙ্গলবার বিকেলে ড. আনিছুর রহমান গবেষণা স্থল থেকে জনকণ্ঠকে জানান, ইলিশ বিচরণের প্রায় ৭ হাজার বর্গকিলোমিটারকে প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ প্রজনন এলাকা সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ থাকতে হবে। এ এলাকার একটি পয়েন্টে তাদের গবেষণা কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। আরেকটি পয়েন্টে সহসা শুরু হবে। বিশেষজ্ঞ দলটি একাধিক পয়েন্ট যাচাইবাছাই করে টানা ২৬ দিন গবেষণা কাজ চালিয়ে ইলিশের বংশ বৃদ্ধি, প্রজনন ক্ষেত্র, অভয়াশ্রম, মাইগ্রেশনসহ নানা বিষয়ে তারা সুপারিশ পেশ করবেন। ইতোমধ্যে ইলিশ ধরা শুরুতে এগারো দিন পরে পনেরো দিন এবং এবার সাত দিন বাড়িয়ে ২২ দিন করা হয়েছে। এ নিয়ে ইলিশ আহরণ, বাণিজ্যিক কার্যক্রমে জড়িতদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। একপক্ষ এটিকে সমর্থন করছে, অপরপক্ষ সময় বৃদ্ধির বিষয়টিকে অতিরিক্ত বলে আখ্যা দিচ্ছে। এর পাশাপাশি এ দুইপক্ষের বাইরে তৃতীয় পক্ষের মতামত মা ইলিশের ডিম ছাড়ার সুবিধার্থে এ সময় ন্যূনতম পক্ষে এক মাস করা উচিত। কেননা, আজ থেকে ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবত হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু ইতোমধ্যে মা ইলিশের পেটে ডিম চলে এসেছে। ডিমওয়ালা মা ইলিশ বাজারে বিক্রিও হয়েছে। সঙ্গত কারণে যেখানে একটি মা ইলিশ থেকে ১০ থেকে ১৫ লাখ ডিম আসে; সেক্ষেত্রে এ ধরনের বিপুলসংখ্যক ইলিশ ডিম ছাড়ার আগেই নিধন হলে ক্ষতির পরিমাণ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা চিন্তা করাও কঠিন হয়ে যায়। ফলে মা ইলিশের পেটে ডিম আসার আগে থেকে এবং পরিপূর্ণভাবে ডিম ছাড়া পর্যন্ত সাগর ও নদী মোহনা এলাকায় মা ইলিশ সম্পূর্ণভাবে আহরণ নিষিদ্ধ করা বাঞ্ছনীয়। মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এবার ইলিশ ধরা বন্ধের আদেশ কার্যকর হবে ২৭ জেলাব্যাপী। এগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, ঢাকা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, নরসিংদী, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, খুলনা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী ও মুন্সীগঞ্জ ইত্যাদি। এসব জেলার অধীনে সকল উপজেলা নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকবে। এছাড়া সাগর এলাকাজুড়ে ইলিশ আহরণের ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞা বলবত হবে। বিশেষজ্ঞ ড. আনিছুর রহমান জানান, যেহেতু আহরিত পুরো পুলিশের ৭০ শতাংশ মিলে বাংলাদেশী এলাকায়। বাকি ৩০ শতাংশ ভারত, মিয়ানমার ও অন্যান্য কয়েকটি দেশে আহরিত হয়। আবার বাংলাদেশে যে ইলিশ আহরিত হয় তা স্বাদে ও গুণেমানে সেরা। তাই বাংলাদেশী ইলিশের কদর সর্বোচ্চ। এর মধ্যে আবার পদ্মা ও মেঘনা অববাহিকায় আহরিত ইলিশের স্বাদ ও আকার অপেক্ষাকৃত বড়। চলতি মৌসুমের শুরু থেকে যে পরিমাণে ইলিশ মিলেছে তা নিয়ে মন্ত্রণালয়, মৎস্য অধিদফতর এবং গবেষণার স্টেশনগুলোর কর্মকর্তারা সকলেই ব্যাপকভাবে আশাবাদী। নিষেধাজ্ঞার আওতায় ২২ দিন মাঝিমাল্লারা অলস সময় কাটাবে বলে তাদের জন্য আর্থিক সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে সরকার পক্ষ থেকে। সরকারের এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, নৌ-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সকল সংস্থাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। সে অনুযায়ী চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদী মোহনায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের নজরদারি যেমন থাকবে, অনুরূপ থাকবে সংশ্লিষ্ট জেলার আওতায় প্রতিটি পয়েন্টে। এছাড়া সাগর এলাকায় নজরদারি করবে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী। মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশী এলাকা ও বিভিন্ন নদ-নদীতে যে পরিমাণ ইলিশ আহরণের সর্বোচ্চ রেকর্ড রয়েছে ঠিক তার দ্বিগুণ পরিমাণ উৎপাদিত হয়ে থাকে। নতুন যে গবেষণা কাজ সরেজমিন শুরু হয়েছে, সেক্ষেত্রে গবেষকদের প্রধান কাজ হবে উৎপাদন আরও বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কী কী ব্যবস্থা নেয়া যায় তা নিয়ে সুপারিশ করা। চলতি মৌসুমে মাছের বাজার ইলিশে সয়লাব হয়ে যাওয়ার পেছনের মূল তিনটি কারণের ওপর জোর দিয়েছেন গবেষকরা। প্রথমত, প্রজনন মৌসুমে আহরণ বন্ধ, এর পাশাপাশি মজুদ, বাজারজাতকরণ বন্ধ রাখা। অপর দুটি হচ্ছেÑ কারেন্ট জাল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা এবং ইলিশের অভয়াশ্রম যাতে আঘাতপ্রাপ্ত না হয় সেদিকে নজরদারি জোরদার রাখা। সরকারের এসব আদেশ-নির্দেশ কার্যকর হওয়ার কারণে যেহেতু ১০ থেকে ১২ শতাংশ হারে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে, সেক্ষেত্রে আরও বৃদ্ধির জন্য গবেষণা রিপোর্টকে প্রাধান্য দেয়া হবে। সূত্র জানায়, যেসব দেশে ইলিশ পাওয়া যায় সেসব দেশে ইলিশের আহরণ কমেছে। শুধু বাংলাদেশে বেড়েছে, যার প্রমাণ এবারের মৌসুম এবং এর নেপথ্যের প্রধান কারণ, শতভাগ না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকার প্রণীত আদেশ নির্দেশ মেনে চলা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বরগুনা, পটুয়াখালী, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে হাজার হাজার ইলিশ ধরার ফিশিং বোটগুলো ফিরে এসে নোঙ্গর করেছে। এছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে উল্লেখিত ২৫ জেলার বিভিন্ন পয়েন্টেও মাঝিমাল্লারা বোট নিয়ে অবস্থান নিয়েছে। আগামী ২ নবেম্বর পর্যন্ত তারা ইলিশ আহরণ থেকে বিরত থাকবে। এসব পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন থাকবে। নজরদারি থাকবে ফাঁকফোকরে অবৈধভাবে ইলিশ আহরণে বোট বা ট্রলারগুলো সাগরে যাচ্ছে কিনা। মৎস্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা আশাবাদী ইতোপূর্বেকার চেয়েও অধিকহারে এবার ইলিশ আহরিত হওয়ার ঘটনাটি সকলের মাঝে ব্যাপক আশার সঞ্চার করায় সচেতনতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। অনুরূপ আশা ব্যক্ত করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকেও।
×