ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আজ পবিত্র আশুরা, অপ্রীতিকর ঘটনা রোধে কড়া নিরাপত্তা

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১২ অক্টোবর ২০১৬

আজ পবিত্র আশুরা, অপ্রীতিকর ঘটনা রোধে কড়া নিরাপত্তা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কারবালার প্রান্তরে শোকাবহ ঘটনার ঐতিহাসিক দিন আজ। ১০ মহরম পবিত্র আশুরা। নানা কারণে এদিন ইসলামের ইতিহাসে ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ হলেও জনপ্রিয় ধারণা অনুযায়ী আশুরার শোকাবহ দিন হিসেবেই পালন করা হয়ে থাকে। বিষাদময় ঘটনার স্মরণ করেই বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এ ঘটনা স্মরণে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে মিছিল, মাতম ও শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদায় পবিত্র আশুরা পালনের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। দিনটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ, বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তাঁরা ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠায় ইসলামের শেষ নবী হযরত মুহম্মদ (স) এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইন ও তাঁর পরিবারবর্গের আত্মত্যাগ মানবজাতির জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে উল্লেখ করেন। এদিকে আশুরা উপলক্ষে বিভিন্ন সংবাদপত্রে বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়া সরকারী বেসরকারী রেডিও টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। আশুরা উপলক্ষে আজ বুধবার পত্রিকা অফিস বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে আশুরার দিনে যাতে গত বছরের মতো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আজ বুধবার আশুরার দিন তাজিয়া মিছিলে ছুরি, কাঁচি ও বল্লম নিয়ে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে হোসেনি দালান থেকে যে মিছিলটি বের হয়, শিকল দিয়ে নিজেদের বেঁধে দা, কাঁচি, ছুরি, বল্লম নিয়ে বের হতো। কিন্তু এবার নিরাপত্তার কারণেই এভাবে মিছিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে গত বছর তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় ভোররাতে হোসেনি দালানে জঙ্গী বোমা হামলায় হতাহতের ঘটনায় এবার আরও কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এদিকে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রেখেই শিয়া সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে তাজিয়া মিছিল বের করা হবে বলে সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। বুধবার ভোরে শিয়া সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে তাজিয়া মিছিল বের করা হবে। পুরান ঢাকার হোসনি দালান থেকে এই তাজিয়া মিছিল বের হবে। প্রতি বছর শিয়া সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে কারবালার রক্তাক্ত স্মৃতি স্মরণে ‘হায় হোসেন-হায় হোসেন’ মাতম তুলে নিজের দেহে আঘাত করে রক্ত ঝরাতে দেখা যায়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় দিবসটি বাংলাদেশেও গুরুত্বসহকারে পালিত হচ্ছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এ উপলক্ষে মঙ্গলবার রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে আশুরা তাৎপর্য ও শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করা হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম আফজালের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম মোঃ মিজানুর রহমান, ঢাকার তেজগাঁওয়ের মদিনাতুল উলুম কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক। মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে আশুরা অধিক তাৎপর্যপূর্ণ হলে বিভিন্ন মুসলিম ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে দিবসটির ভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও আলাদা অনুষ্ঠান পালনের রীতি রয়েছে। শিয়া সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আজ বুধবার পুরান ঢাকার হোসেনি দালান থেকে তাজিয়া মিছিল বের হবে। এছাড়াও রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, পুরানা পল্টনসহ বিভিন্ন স্থান থেকেও তাজিয়া মিছিল বের হবে। এছাড়াও দেয়ানবাগ দরবার শরীফের পক্ষ থেকেও আশেকে রাসূল (স) সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে কোরান তেলাওয়াত ছাড়াও মিলাদ মাহফিলেরও আয়োজন করা হয়েছে। দিনটি উপলক্ষে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মহরম মাসের ৯, ১০ ও ১১ তারিখে রোজাব্রত পালন করা হয়। এছাড়াও এদিন উত্তম খাবারেরও আয়োজন, শিরনি বিতরণ করা হয়ে থাকে। মুসলিম সম্প্রদায়ের বাইরে বিশেষ করে ইহুদী সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এ দিনে আশুরা উপলক্ষে রোজা রাখার প্রচলন রয়েছে। কারবালার প্রান্তরে বিয়োগান্তক ঘটনার স্মরণে আশুরা পালন করা হলেও ইসলামের ইতিহাসে এ দিনটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য ঐতিহাসিক। কারণ বহু ঐতিহাসিক ঘটনা এই তারিখে সংঘটিত হয়েছিল। তাই বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ যথাযথ মর্যাদায় দিনটিকে স্মরণ করে থাকে। ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে আশুরা হলো ইসলামের একটি ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবস। এটি প্রতি আরবি হিজরীর মহরম মাসের দশ তারিখে পালিত হয়। আরবিতে ‘আশারা’ মানে ১০। আর সে কারণে দিনটিকে আশুরা বলে অভিহিত করা হয়। মহরমের ৯ তারিখের দিবাগত রাত থেকে আশুরা উদযাপন শুরু হয়। শিয়া সম্প্রদায়ের কাছে এ দিনটি বিশেষ মর্যাদাময়। কেননা এই দিনে মুহাম্মদ (স)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা) ইসলামের তৎকালীন শাসনকর্তা এজিদের সৈন্য বাহিনীর হাতে কারবালার প্রান্তরে শহীদ হয়েছিলেন। তবে ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে কারবালার ঘটনা ছাড়াও ১০ মহরম আরও অধিক কারণে ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাদের মতে, ১০ মহরম তারিখে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই দিনে পৃথিবীর পৃথম মানুষ হযরত আদম (আ) কে সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই দিনে আল্লাহ নবীদের স্ব স্ব শত্রুর হাত থেকে আশ্রয় প্রদান করেছেন। এই দিন নবী মুসা (আ)-এর শত্রু ফেরাউনকে নীল নদে ডুবিয়ে দেয়া হয়। নূহ (আ)-এর কিস্তি ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছিল এবং তিনি জুডি পর্বতশৃঙ্গে নোঙ্গর ফেলেছিলেন। এই দিনে দাউদ (আ)-এর তাওবা কবুল হয়েছিল। নমরুদের অগ্নিকু- থেকে ইব্রাহীম (আ) উদ্ধার পেয়েছিলেন। আইয়ুব (আ) দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ করেছিলেন। এদিনে আল্লাহ তা’আলা ঈসা (আ)-কে উর্ধাকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন। হাদিসে বর্ণিত আছে যে এই দিনেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে মুসলিম উম্মাহর কাছে মহরম মাসের গুরুত্ব শতগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে হিজরী ৬১ সনের বর্তমান ইরাকের কুফার নিকটবর্তী কারবালা প্রান্তরে নবীজির প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন ও তার সঙ্গীসাথীর নির্মম শাহাদতবরণের পর। নবীজির মৃত্যুবরণের পর ও খোলাফায়ে রাশেদার যুগ শেষ হওয়ার পর মুসলিম সমাজ বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হয়ে পড়ে। ইসলামের সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে এজিদের বংশীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এজিদ বিন মুয়াবিয়া ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেয়। গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে ন্যায়-ইনসাফপূর্ণ শান্তি ও সমৃদ্ধির ইসলামী সমাজকে পুনরায় জাহিলিয়াতের লুটপাট, বর্বরতা, সন্ত্রাস-যুদ্ধ ও দুর্নীতি-অনাচারের দিকে নিয়ে যায়। শাসক হিসেবে সে ছিল স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী। ইমাম হোসাইন (রা) এজিদের আনুগত্য করতে অস্বীকৃত হন। ইসলামের সংস্কারের লক্ষ্যে মদীনা ছেড়ে মক্কা চলে আসেন। সত্য ও ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। অবশেষে ৬১ হিজরী সনের দশই মহরম তথা আশুরার দিনে কারবালা প্রান্তরে নিজের পরিবার-পরিজন, সন্তান এবং সঙ্গীসাথীদের নিয়ে এক অসম যুদ্ধে এজিদের সৈন্যের হাতে শাহাদতবরণ করেন। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য হজরত ইমাম হোসাইন (রা) এবং তাঁর পরিবার ও অনুসারীরা যুদ্ধ করতে গিয়ে ফোরাত নদীর তীরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে আত্মত্যাগ শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলামের সুমহান আদর্শ সমুন্নত রাখতে মানবতার ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। কারবালার এই শোকাবহ ঘটনা ও পবিত্র আশুরার শাশ্বত বাণী অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে আজও অনুপ্রেরণা জোগায়। প্রেরণা জোগায় সত্য ও সুন্দরের পথে চলার। তাই আজ আশুরার এ পবিত্র দিনে কারবালার শহীদদের স্মরণ করতেই আয়োজন করা হয় নানা কর্মসূচীর।
×