ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মীজানুর রহমান

রাজনৈতিক প্রচারে সমন্বিত যোগাযোগ

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ১২ অক্টোবর ২০১৬

রাজনৈতিক প্রচারে সমন্বিত যোগাযোগ

নেতা রাজনীতি করে ক্ষমতা অর্জনের জন্য। রাজনীতি হচ্ছে ক্ষমতা অর্জন ও ব্যবহারের পন্থা, আর ক্ষমতা হচ্ছে অন্যকে এবং ঘটনাকে প্রভাবিত করার যোগ্যতা। রাজনৈতিক ক্ষমতার অর্থই হচ্ছে জনগণ ও সামাজিক পদ্ধতির আস্থা ও সমর্থন অর্জন করা। তবে রাজনৈতিক ক্ষমতা আর কর্তৃত্ব এক কথা নয়। কর্তৃত্ব আসে প্রশাসনিক ক্ষমতার উচ্চ মহল থেকে ডেলিগেট হয়ে। রাজনৈতিক ক্ষমতা নেতা তার ব্যক্তিত্ব ও কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে এবং পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেই অর্জন করে। নেতার ব্যক্তিত্বের গুণেই তার অনুসারী সৃষ্টি হয়। নেতার ব্যক্তিত্ব ও ক্যারিশমা এতই আকর্ষণীয় হয় যে, অনুসারীরা নিজ থেকেই তাকে অনুসরণের তাগিদ অনুভব করে। নেতা পরিস্থিতি ও অনুসারীদের ‘প্রয়োজন’ বুঝতে পারে, সে অনুযায়ী লক্ষ্য নির্ধারণ করে এবং অনুসারীদের লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করে। সফল নেতৃত্বের ঐতিহাসিক উদাহরণ হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মহাত্মা গান্ধী, জোয়ান অব আর্ক, ইউনস্টন চার্চিল, জন এফ কেনেডি, মার্টিন লুথার কিং এবং নেলসন ম্যান্ডেলা। রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের সবচেয়ে সফল অস্ত্র হচ্ছে নেটওয়ার্ক সৃষ্টি এবং কার্যকর যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা। রাজনীতিবিদদের অবশ্যই জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে এবং সেটা কোন দৈব বা বাতাসের ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না। এর জন্য প্রয়োজন একটি সমনি¦ত রাজনৈতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। উন্নত বিশ্বের রাজনৈতিক দলগুলো ভালভাবে যোগাযোগ কর্মটি সম্পন্ন করার জন্য বিজ্ঞাপনী সংস্থা, যোগাযোগ ও মিডিয়া বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেয়। রাজনৈতিক দলের কর্পোরেট সংস্কৃতির ভাবমূর্তি উন্নয়নের জন্য গণসংযোগ ফার্মকে ভাড়ায় নিয়োগ দেয়। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নেতাকর্মীদের বহুজাতিক কোম্পানির বিক্রয়কর্মীদের মতো বন্ধুসুলভ, সাহায্যকারী ও প্ররোচনাকারী হিসেবে প্রশিক্ষিত করে তোলে। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলেই সমন্বিত যোগাযোগ কর্মসূচী নেয়া হবে কিনা এটা কোন প্রশ্ন নয়, বরং এ কাজে কত অর্থ, মেধা ও সময় ব্যয় করা হবে এবং কিভাবে করা হবে, সেটিই আজকের প্রসঙ্গ। একটি আধুনিক রাজনৈতিক দলকে অপেক্ষাকৃত জটিল যোগাযোগ পদ্ধতি ব্যবস্থাপনা করতে হয়। রাজনৈতিক দলকে জনগণ, দলীয় নেতাকর্মী, অর্থ সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক, বৈদেশিক মিশন ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, উন্নয়ন অংশীদার, সহযোগী রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, সুশীল সমাজ, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন ধরনের পাবলিকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয় এবং পুরো বিষয়টাকে একটা সর্বক্ষণিক, ধারাবাহিক ও সুনিয়ন্ত্রিত কর্মকা- হিসেবে পরিচালিত করতে হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর যোগাযোগের ক্ষেত্রে সফলতা যেমন আছে, তেমনি অনেকগুলো ব্যর্থতাও (কিছু চরম ব্যর্থতা) আছে। বিদ্যমান যোগাযোগ পদ্ধতির সফলতা ও দুর্বলতা পর্যালোচনাও এ অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় নয়। এ অধ্যায় অতি সংক্ষেপে মাঠ পর্যায়ে প্রচার-প্রপাগান্ডা তথা রাজনৈতিক যোগাযোগের সঙ্গে স্থানীয় নেতৃত্বের ভূমিকা ও করণীয় বিষয়ে একটি দিকনির্দেশনা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য একটি গণযোগাযোগ মিশ্রণ ব্যবহার করতে পারে, যার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেÑ গণযোগাযোগ : অনুকূল প্রচার অর্জনের মাধ্যমে দলের বিভিন্ন ধরনের পাবলিকের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন, ভাল কর্পোরেট ভাবমূর্তি অর্জন, প্রতিকূল গুজব, গল্প, রটনা বা ঘটনাকে যথাযথভাবে হ্যান্ডেল বা দূরীভূত করা। ব্যক্তিগত যোগাযোগ : এক বা একাধিক ব্যক্তির কাছে দলীয় বক্তব্য কথোপকথনের মাধ্যমে মৌখিক উপস্থাপন করা। বিজ্ঞাপন : অর্থের বিনিময়ে দলীয় বক্তব্য ও কর্মসূচীর নৈর্ব্যক্তিক উপস্থাপনা। যেমনÑ পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রদান, বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার, ক্রোড়পত্র, বুুলেটিন, পোস্টার, লিফলেট, স্টিকার, ব্যানার, দেয়াল লিখন, চিকা, সাইন ইত্যাদি জনগণের জন্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা। বিতরণ : দান-অনুদান, উপহার, ত্রাণ, কার্ড ইত্যাদি বিতরণ। সনাতন রাজনৈতিক কর্মসূচীÑ যেসব রাজনৈতিক কর্মসূচী দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ জনসভা, কর্মীসভা, বর্ধিতসভা, পথসভা, লংমার্চ, রোডমার্চ, মানববন্ধন, অনশন, বিবৃতি, স্মারকলিপি প্রদান, ধর্মঘট, অবস্থান ধর্মঘট, অবরোধ, হরতাল, সেমিনার, কর্মশালা, কনভেনশন, পুনর্মিলনী, মতবিনিময়, মৌন ও বিক্ষোভ মিছিল, লাঠি বা মশাল মিছিল, কালো পতাকা উত্তোলন বা প্রদর্শন, জুতা, ঝাড়ু ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে মিছিল, গায়েবানা জানাজা, সংবাদ সম্মেলন, প্রেস ব্রিফিং, মিলাদ মাহফিল ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন, ফুল ও মিষ্টি বিতরণ, কাঙালি ভোজ, পুষ্পস্তবক অর্পণ, শ্রদ্ধাঞ্জলি, পুরস্কার-ক্রেস্ট ও সংবর্ধনা প্রদান, ত্রাণসামগ্রী বিতরণ, রক্তদান, রিলিফ ক্যাম্প স্থাপন, বার্ষিকী ও বিভিন্ন দিবস উদযাপন, পোস্টার ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী, ভিডিও প্রদর্শনী, কুশপুতুল দাহ, কালোব্যাজ ধারণ, প্রতীকী অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি। মাঠ পর্যায়ে কার্যকর রাজনৈতিক যোগাযোগ উন্নয়নের ধারাবাহিক পদক্ষেপসমূহ হচ্ছে অভীষ্ট অডিয়্যান্স (শ্রোতাম-লী) শনাক্তকরণ, প্রত্যাশিত সাড়া নির্দিষ্টকরণ, বার্তা পছন্দকরণ, বার্তা প্রেরণের জন্য মাধ্যম নির্বাচন, বার্তার সূত্র নির্বাচন, ফিডব্যাক সংগ্রহ এবং ফলোআপ। অভীষ্ট অডিয়্যান্স শনাক্তকরণ : একজন রাজনৈতিক যোগাযোগকারীকে যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে তাদের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা নিয়ে কাজ আরম্ভ করতে হবে। অডিয়্যান্সের শিক্ষাগত যোগ্যতা, সামাজিক অবস্থান, রাজনৈতিক সচেতনতার স্তর, দলীয় পরিচিতি, যোগাযোগকারীর দলের প্রতি তার মনোভাব, আনুগত্য ইত্যাদি ভালভাবে জেনেই কাজ শুরু করতে হবে। প্রত্যাশিত সাড়া নির্দিষ্টকরণ : অভীষ্ট অডিয়্যান্স শনাক্তকরণের পর রাজনৈতিক যোগাযোগকারীকে প্রত্যাশিত সাড়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক যোগাযোগের চূড়ান্ত সাড়া হচ্ছে সমর্থন বা ভোট আদায়। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মসূচীর প্রতি সমর্থন বা ভোট প্রদান হচ্ছে জনগণের সুদীর্ঘ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত ফল। লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×