ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মেজর (অব.) মোহাম্মদ আলী

অভিমত ॥ ডিজিটাল বাংলাদেশ ও প্রাথমিক শিক্ষা

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ১২ অক্টোবর ২০১৬

অভিমত ॥ ডিজিটাল বাংলাদেশ ও প্রাথমিক শিক্ষা

যে কোন দেশের প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে শিক্ষার প্রথম ধাপ। এই ধাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি হচ্ছে ভিত। এই ভিত মজবুত না হলে ভবিষ্যতে যে কোন শিক্ষা প্রকৃত অর্থে কার্যকরী হয় না। বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন বলেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তৎকালীন সরকার স্বাধীনতা পরবর্তী সমস্যা সঙ্কুল দেশে নানা বাধা সত্ত্বেও ১৯৭৩ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে জাতীয়করণসহ নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালো মেঘে সেগুলো ঢেকে থাকে বহুকাল। তাই জাতীয়করণের এতগুলো বছর পার হলেও প্রাথমিক শিক্ষা নিজের রুগ্ণদশা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যদিও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতাদর্শের তারই সুযোগ্য তনয়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বাধীনতার পক্ষের সরকার প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে যুগান্তকারী কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে প্রাথমিক শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী নিয়ামক হয়ে উঠেছে। প্রাথমিক স্তরে আমাদের দেশে ১১ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে- ১) সরকারী প্রাইমারী স্কুল, ২) রেজিস্টার্ড বেসরকারী প্রাইমারী স্কুল, ৩) নন রেজিস্টার্ড বেসরকারী প্রাইমারী স্কুল, ৪) এক্সপেরিমেন্টাল প্রাইমারী স্কুল, ৫) প্রাইমারী ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের সঙ্গে সংযুক্ত প্রাইমারী স্কুল, ৬) কমিউনিটি স্কুল, ৭) এনজিও পরিচালিত স্কুল, ৮) কিন্ডারগার্টেন, ৯) এবতেদায়ী মাদ্রাসা, ১০) সেটেলাইট স্কুল ও ১১) হাই স্কুলের সঙ্গে সংযুক্ত প্রাইমারী স্কুল। বিশ্বের অনেক দেশ দেখার সুযোগ হয়েছে, কোন দেশে প্রাইমারী স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাইনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে হাই স্কুল গ্র্যাজুয়েশন অর্জন স্তর পর্যন্ত কোন নাগরিকের সন্তানদের জন্য ইচ্ছেমতো স্কুল বাছাইয়ের কোন স্বাধীনতা থাকে না, প্রিসিঙ্কট (চৎবপরহপঃ) মোতাবেক স্কুল সুনির্দিষ্ট থাকে। আমাদের প্রাথমিক স্তরের এই ১১ ধরনের স্কুল গড়ে ওঠার বিষয়টি সর্বপ্রথম আমাকে দেখিয়েছে সকল প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষার পরিবেশ, উপকরণ, ধরন ও সুবিধা এক নয়। বিশেষত, নন-রেজিস্টার্ড বেসরকারী স্কুল এবং এবতেদায়ী মাদ্রাসায় যে ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা প্রচলিত সেটাকে মানসম্পন্ন বলা যায় না। গ্রামের প্রাথমিক স্কুল, রেজিস্টার্ড বেসরকারী স্কুল এবং নিম্নবিত্ত জনবসতির প্রাথমিক স্কুলের লেখাপড়াও মানসম্পন্ন নয়। আমি লক্ষ্য করেছি, আমার উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অক্লান্ত পরিশ্রম সত্ত্বে¡ও, কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়বিমুখ হয়ে ঝরে পড়ছে, যা আমাকে ভাবনায় ফেলে। তখন থেকেই প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে কিছু করার তাগিদ অনুভব করি। পাশাপাশি আমি লক্ষ্য করেছি, আমার কন্যা সন্তানটি তার বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য খুবই আগ্রহী এবং পাঠে মনোযোগী। তাছাড়া সে ছবি আঁকা, আবৃত্তি, গল্প বলা ইত্যাদি সহ-শিক্ষামূলক কার্যক্রমেও বেশ আগ্রহী। কারণ হিসেবে আমার কাছে ওই বিদ্যালয়ের আকর্ষণীয় বর্ণিল পরিবেশ, খেলাধুলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা-বিনোদন এবং আইসিটি সামগ্রী ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠকে শিশুতোষ করে উপস্থাপনই মুখ্য বলে প্রতীয়মান হয়। শহরের শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তেমন খোলামেলা জায়গা না থাকলেও শ্রেণীকক্ষ নানা রঙে সাজানো, আঙ্গিনা সাজানো-গোছানো, পরিপাটি। এসব বাস্তবতা আমাকে আমার উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে ক্রীড়া সামগ্রী, ফাস্ট এইড বক্স, ল্যাপটপ, এলইডি টিভি, দরিদ্র পরিবারের শিশুদের খাতা-কলম প্রদান, বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় ছোট আকারে বিনোদন পার্ক তৈরি করে দেয়ার পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণে সহায়তা করে। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাধে উপজেলার বিভিন্ন প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ ঘুরে আমার মনে হয়েছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে’ সরকারের পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষাকে কেন্দ্র করে আমারও কিছু করা প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে এবং জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জনে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে উপজেলার শিক্ষা বিস্তারে সহায়তার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মতবিনিময় করি। তারই ধারাবাহিকতায় ১৪৮টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে ক্রীড়া সামগ্রী প্রদান করি। এক্ষেত্রে ফুটবল, ক্যারাম বোর্ড, স্কিপিং রোপ, দাবা, নেট, টেবিল টেনিস সরঞ্জাম, র‌্যাকেট ইত্যাদি সরবরাহ করি। এসব ক্রীড়া সামগ্রী শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার পাশাপাশি সহ-শিক্ষা কার্যক্রমেও সমানভাবে আগ্রহী করে তুলছে। ১১৬টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ, এলইডি টিভি, এ্যান্টেনা, ইউপিএস সরবরাহ করি। এসব আইসিটি সামগ্রী শিক্ষকরা ব্যবহার করে বিদ্যালয়ে পাঠকে শিক্ষার্থীদের নিকট আকর্ষণীয় ও সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপন করছেন। ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিভিন্ন শিশুতোষ ছড়া, ছবি, দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, আবিষ্কার ইত্যাদি খুব সহজেই শিক্ষার্থীদের নিকট উপস্থাপন সম্ভব হয়েছে এবং তা কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে শিশুরা আগের তুলনায় অনেক বেশি বিদ্যালয়মুখী হয়েছে। বাকি ৩২টি প্রতিষ্ঠানেও এসব আইসিটি সামগ্রী দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। পরিকল্পনা আছে শিক্ষকদের জন্য স্থানীয়ভাবে আইসিটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার। পরীক্ষামূলকভাবে একটি বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় ছোট আকারে বিনোদন পার্ক তৈরি করা হয়েছে। এতে শিশুদের পক্ষ থেকে দারুণ সাড়া পাওয়া গেছে। তাই পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে এসএমসির সহায়তা নিয়ে বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় ছোট আকারে বিনোদন পার্ক তৈরি করে দেয়ার পরিকল্পনা আছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন বিদ্যালয়ের চাহিদার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বেঞ্চ প্রদান, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, বাগান তৈরির জন্য সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও এ কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা আছে। বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশন করার অংশ হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে বিভিন্ন প্রকার আইসিটি সামগ্রী প্রদান শুরু করেছেন। কিন্তু সব প্রাথমিক বিদ্যালয়কে আইসিটির আওতায় নিয়ে আসা সময়ের ব্যাপার। ভবিষ্যত পরিকল্পনায় আছে, প্রত্যেক বিদ্যালয়কে উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সিমসহ একটি মোবাইল সেট, ডিজিটাল উপস্থিতি কাউন্টিং মেশিন, জোনভিত্তিক খেলার মাঠ ও সুইমিং পুল তৈরি, পাঠ্য সরঞ্জাম প্রদান, দাবা ও সাঁতার প্রতিযোগিতার উপজেলাভিত্তিক আয়োজন এবং শিক্ষা ভ্রমণের আয়োজন করা। প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়ন ও শিশু শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে আমরা সারা দেশে যেন শতভাগ সাফল্য অর্জন করতে পারি। লেখক : রাজনীতিক
×