ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

বিজ্ঞাপন টেলিভিশন আর নিরন্তর ছুটে চলা জীবন

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ১২ অক্টোবর ২০১৬

বিজ্ঞাপন টেলিভিশন আর নিরন্তর ছুটে চলা জীবন

নাগরিক জীবনের চালচিত্রে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে বহু আগে। তা এখন ছুটছে দুরন্ত গতিতে। দুর্দমনীয় প্রতিযোগিতায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে সব মানবিকবোধ। জীবনকে উপলব্ধি করার সময় নেই। শুধু প্রতিযোগিতা আর নিরন্তর ছুটে চলা। পুঁজিবাদী বিশ্ব টিকে থাকে বিজ্ঞাপনের মায়াবী জগতে ভর করে। বিজ্ঞাপনের চাতুরি সত্যিকারের প্রয়োজন আড়াল রেখে তাকেই অপরিহার্য করে, যার বাজার মূল্য আছে। সব কিছু পণ্য এখানে। এমনকি মানুষও। বিজ্ঞাপন আকাক্সক্ষা জাগাচ্ছেÑ মানুষ ছুটছে। বিজ্ঞাপনের বজ্র আঁটুনী বেঁধে ফেলেছে গোটা জীবন। দিনের শুরুতে ছোটা শুরু। যাদের গাড়ি আছে তারা জ্যামের ঠেলা সামলালেও যানবাহনের বিষয়ে নিশ্চিত। যাদের ভরসা বাস তাদের দুরবস্থা বর্ণনাতীত। সকালবেলা নাকেমুখে গুঁজে বাসের কিউতে দাঁড়ানো। কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে সে কথা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না। কাক্সিক্ষত বাসটি যদি কোথাও জ্যামে আটকে যায় তাহলেই হয়েছে। সময়ের অপচয় আর সময় বাঁচানোর উর্ধশ্বাস দৌড়ের এ বৈপরীত্যের আশ্চর্য সমন্বয়ের নাম শহুরে জীবন। বৈপরীত্য আছে অন্যখানেও। সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের আয় বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা বা কর্পোরেট হাউসের আয়ের বৈপরীত্য। একদিকে পে-স্কেলের চালাকি অন্যদিকে বিভিন্ন ঘরানার প্রজেক্টের নামে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক সাহায্য। যার যেটুকু দক্ষতা আছে কিংবা জনসংযোগ তা-ই ভাঙিয়ে অনায়াসে গাড়ি-বাড়ির মালিক হওয়ার সোনালি হাতছানি উপেক্ষা করা সহজ নয়। তার ওপর মিডিয়া ছায়া হয়ে সারাক্ষণ পাশে রয়েছে। সফল প্রজেক্টের সফল কর্ণধারকে হাইলাইট করতে টকশো রিয়ালিটি শোর ক্যামেরা ভীষণই উদার। টেলিভিশনের পর্দায় মুখ দেখানোর দুর্দান্ত বাসনা কাঠখোট্টা চেহারার মানুষটির মনেও থাকে। আজকাল অবশ্য ‘কাঠখোট্টা’ ‘কুৎসিত’ চেহারা বলে কিছু নেই। সব ধরনের চেহারাকে ধারালো বা আকর্ষণীয় করার মানসম্পন্ন বহু সৌন্দর্য প্রতিষ্ঠান এখন ঢাকা শহরে রয়েছে। ‘সাফল্যের’ মুখ যে একবার দেখেছে বার বার সফল হওয়ার নেশা তাকে চেপে ধরে। সুতরাং ছুটতে তাকে হচ্ছেই। পাশের বাড়ির সাধারণ মেয়েটি যখন আন্তর্জাতিক প্রসাধন কোম্পানির সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় সেরা সুন্দরীর মুকুট পরে বাড়ি ফেরে তখন প্রতিবেশী মেয়েটির বুকেও আকাক্সক্ষা জন্মে। শুরু হয় তার দৌড়। জিম, হেলথ ক্লাব, মেকওভার, গ্রুমিংয়ের পর্যায়ক্রমিক পাঠ। মফস্বলের সাদামাটা একজন মানুষ, যে নিভৃতে বই পড়তে ভালবাসে। হঠাৎই পড়ে গেল কোন বিজ্ঞাপনী সংস্থার চোখে। ধরে এনে দাঁড় করিয়ে দিল ক্যামেরার সামনেÑ ‘সাদা মনের মানুষ জাতির উদ্দেশে কিছু বলুন’। শুরু হয় বই পড়া নিয়ে তার অভিজ্ঞতার কেচ্ছা। এ দিকে বই থেকে মুখ ঘুরছে গোটা তরুণ প্রজন্মের। সেই মৌলিক সমস্যা থেকে যায় আড়ালে। এ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য নেই। কেননা এতে চমক নেই। নেই বাজারি মুনাফা। ওই ‘সাদা’ মনের মানুষের মধ্যে বিজ্ঞাপনী চমক আছে। এ ধরনের ইনোভেটিভ আইডিয়ার বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণের জন্য বর্ষসেরার পুরস্কারটি নির্মাতার ঝুলিতে যাওয়ার অপেক্ষা করে। এ সাফল্যে প্রাণিত হয়ে এগিয়ে আসে আরেক ট্রুপ। এবার তাদের উর্ধশ্বাস ছোটার পালা। ছিমছাম, একতলা ভাড়া বাড়িতে ভালই কাটছিল। হঠাৎ একদিন সদর দরজায় টোকা পড়ে। বিনম্র হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডেভেলপার কোম্পানির স্মার্ট তরুণ প্রতিনিধি। যেমন তার সাজপোশাক তেমনি মুখের কথা। গদ গদ গলায় স্যার-ম্যাডাম বলে গৃহবাসীর মনে চৌদ্দ শ’ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটের মানচিত্র এঁকে গেল। শুরু হলো দৌড়। ডাউন পেমেন্ট, লোন, কিস্তি ইত্যাদি ইত্যাদি। আট-নয় বছরের সন্তানের মা দু’বেলা বাইরে যেতেনÑ সকালে মেয়ের পড়ালেখার স্কুলে, বিকেলে নাচের ক্লাসে। তেমন কিছু উচ্চাভিলাষ নয়, একটু আধটু নাচগান তো অনেক মা-বাবাই শখ করে শেখাতে চান। একদিন টেলিভিশনের ঘোষণা দেখে মায়ের চোখ চড়কগাছ। ‘সাত থেকে দশ বছর বয়সের শিশুদের নৃত্য প্রতিযোগিতা। যোগাযোগ করুনÑঠিকানা...।’ ব্যস, মা-বাবার ঘুম হারাম। যে করেই হোক সন্তানকে ওই প্রতিযোগিতায় দাঁড় করাতেই হবে। সন্তান নাচবে; টিভি পর্দায় সারাদেশের মানুষ তা দেখবে। এর চেয়ে শিহরিত হওয়ার ঘটনা তাদের জীবনে ঘটেনি। শুরু হলো ছুট। আরও বহু ছোটাছুটি আছে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, শিক্ষকের বাড়ি অথবা কোচিং সেন্টার। একেবারে ক্ষুদে শিক্ষার্থীÑ তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছে, ভাল ফল করতে চাইলে অনিবার্যভাবে ছুটতে হবে তাদেরও। আর ওই যে লিভিং রুম, ড্রয়িং রুম বা বেড রুমের চারকোনা ফ্রেমÑ কি বলা যায় একে? স্বপ্নের ফেরিওয়ালা? ভোক্তা এবং বিক্রেতার মধ্যে সংযোগকারী মিডলম্যান বা ব্রোকার? হ্যাঁ, সম্ভবত এটাই বর্তমান বিশ্বে টেলিভিশনের মূল ভূমিকা। মোটেই ‘ইডিয়ট বক্স নয়।’ টেলিভিশন এখন ‘ইমেজ ফেরির বক্স।’ বিক্রির জন্য এখন পণ্যের গুণগতমানের চেয়ে বেশি প্রয়োজন ইমেজ, একটা ব্র্যান্ডনেম। ইমেজই বিক্রি হয়। টেলিভিশনের কাজ হচ্ছে এই ইমেজ ভোক্তার বেডরুম পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া। একবার নয়, বার বারÑ প্রতি ‘ছোট্ট বিরতিতে।’ টেলিভিশনের দায়িত্ব হলো ভোক্তাকে ওই ইমেজের ফাঁদে ফেলা। এবং সে তা নিষ্ঠার সঙ্গে করে যাচ্ছে। অর্থনীতির সূত্রে আমরা জেনেছি, চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ। কিন্তু এ তত্ত্ব উল্টে গেছে সেই সত্তর দশকে। এখন সরবরাহ তৈরি করে চাহিদা। পার্কিনসন থিয়োরির প্রবক্তা নর্থকোট পার্কিনসন অর্থশাস্ত্রের এতদিনের চেনা সূত্রকে উল্টে দিয়েছেন। বলেছেন, চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নয়, বিশ্ব চলবে সরবরাহ অনুযায়ী চাহিদাতত্ত্বে। কারণ ভোক্তা জানে না সে কি চায়। তার চাহিদা চেনানোর দায়িত্ব বিক্রেতার। ক্রেতার মনে অভাববোধ থাকলে তবেই সে পণ্য কিনবে। অভাববোধ তৈরি করতে পারে বিজ্ঞাপন। সুতরাং বিজ্ঞাপন হতে হবে শৈল্পিক ও সূক্ষ্ম। সহজেই ভোক্তা যাতে আকৃষ্ট হয়। বিজ্ঞাপন চাহিদাকে উস্কে দিয়ে অভাববোধের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। কোন বিশেষ ব্র্যান্ডের সামগ্রী যদি বিশেষ তারকার ইমেজে বার বার প্রচার করা হয় তাহলে ভোক্তার মনে ওই সামগ্রীর জন্য অভাববোধ তৈরি হবে। আর যদি স্বপ্ন দেখানো হয় ‘নিজেকে বদলে দেয়ার? তাহলে তো কথাই নেই। শুধু ‘নিজেকে বদলে দেয়া’র সেøাগানে গত ক’বছরে টেলিভিশন অনুষ্ঠানের গ্লামার বহুগুণ বেড়েছে। একঝাঁক কিশোরীকে একসঙ্গে জড়ো করে মাসকয়েক নানাভাবে গ্রুমিং করানো হয়। এবং প্রতিটি ধাপ অর্থাৎ এপিসোড খুবই আকর্ষকভাবে টেলিভিশনে দেখানো হয়। এর দর্শক যাকে বলে উপচেপড়া। অনুষ্ঠানকে আরও প্রাণবন্ত করতে দর্শককেও এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। মাধ্যম এসএমএস। ব্যাস, লাভের ভাগী ফোন কোম্পানিও। আর দর্শক কিংবা ভোক্তা বেডরুম কি ড্রয়িংরুমে দারুণ উত্তেজিত হয়ে উপভোগ করে প্রতিযোগিতার প্রতিটি এপিসোড। উত্তেজনা বহুগুণ বেড়ে যায় যদি তার পাঠানো এসএমএসধারী প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানে থাকে। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়রা আবার এতদিনে তাদের গড়ে ওঠা ইমেজ বিক্রি করে ওই পণ্যেরই কাটতি বাড়াতে থাকে। ঘুরেফিরে সেই একই গল্প। তবে ইমেজ এখন আর স্টার, সুপারস্টার বা সুপার মডেলের মধ্যে সীমিত নেই। এখন জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর ইমেজও বিক্রি হচ্ছে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদির ইমেজও দারুণ কাটছে আজকাল। এসব ঘটনার সত্যিকারের নায়করাও হাজির হন টিভির পর্দায়। তখন ধন্ধ লাগে তাঁরা কি নিজেদের ইমেজ বিক্রি করছেন, নাকি পণ্যের ইমেজের কাছে নিজেরা বিক্রি হচ্ছেন? এদেশের দর্শকের হাতে টেলিভিশনের রিমোট কন্ট্রোল আসে নব্বইয়ের দশকে। এই ছোট দৈর্ঘ্যরে যন্ত্রটি হাতে আসার সঙ্গে সঙ্গে যেন বদলে গেল অনেক কিছু। টেলিভিশনের চরিত্র বদলালো, সেই সঙ্গে মানুষেরও। সবাই আটকে গেল গৃহকোণে। সামাজিক সম্পর্কগুলো যেন একটু একটু করে আলগা হতে লাগল। কোন মানুষের সাহচর্যে না এসেও শুধু টিভির রিমোট টিপে স্বাচ্ছন্দ্যে চব্বিশ ঘণ্টা পার করে দেয়া যায়। বরং বিশেষ পছন্দের অনুষ্ঠানের সময় বাড়িতে অতিথি এলে বিরক্তি বাড়ে। সময়-অসময়ে অতিথি আসার হারও কমেছে। কেউই নিজের প্রিয় অনুষ্ঠান ছেড়ে আত্মীয়-বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে যেতে আগ্রহী নয়। এভাবেই বাড়ছে বিচ্ছিন্নতা। শহুরে জীবনের দৌড়ের কাছে অনেক সময় হার মানে মানবিকতা। আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভার্চুয়াল জগত আরও এক কাঠি বাড়া। বাস্তব জীবনে বিচ্ছিন্নতা বাড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গাঢ় হয় ‘বন্ধুত্ব’। এর সুফল বা সুবিধা অনেক। অসুবিধা একটাই। আর তার ক্ষতির পরিমাণ অপরিসীম। তা হলো বিচ্ছিন্নতা বাড়ায়। ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব সত্যিকারের বন্ধুত্ব ধ্বংস করে দেয়। প্রতিটি মানুষ একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের অধিবাসী হয়ে সংগঠন বা সম্মিলিত জীবনবোধ হারিয়ে ফেলে। থাকে শুধু ছুটে চলা। প্রতিযোগিতা আর আত্মকেন্দ্রিকতা।
×