ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাজু আহমেদ

তারুণ্যের উদ্যোগ ॥ এশিয়ার বৃহত্তম মণ্ডপ

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ১১ অক্টোবর ২০১৬

তারুণ্যের উদ্যোগ ॥ এশিয়ার বৃহত্তম মণ্ডপ

পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও সনাতন ধর্ম হিন্দু ধর্মাবল্মীদের অন্যতম বৃহত্তম উৎসব শারদীয় দূর্গাপূজার আজ বিজয়া দশমী। মহালয়ার মাধ্যমে এ আয়োজন শুরু হলেও ষষ্ঠিপূজার মাধ্যমে এর মূল উৎসব শুরু হয়। আর প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে আজ এ উৎসবের সমাপনী হচ্ছে। শিল্প সংস্কৃতি তথা চারুকলার অপূর্ব নিদর্শন হিসেবে এই উৎসবকে ঘিরে এবার সারা দেশে ২৯ হাজারেরও বেশি পূজা মন্ডপ তৈরি করা হয়েছে। তবে সেরা আয়োজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বাগেরহাট জেলার হাকিমপু গ্রামের শিকদার বাড়ি মন্দিরের পূজা মন্ডপ। যা এশিয়ার বৃহত্তম মন্ডপ বলে বিবেচিত হচ্ছে। সর্ববৃহৎ এ দুর্গামন্ডপে ভাস্কর, মৃৎ শিল্পীরা তাদের সর্বোচ্চ মেধা আর রং তুলির আঁচড়ে সুনিপুণ কারুকাজ ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রতিটি প্রতিমাকে আকর্ষণীয় করতে তাদের প্রচেষ্টা ছিল প্রশংসনীয়। পৃথিবীর যে কোন পূজা মন্ডপে প্রতিমার সংখ্যা ও সৌন্দর্য্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এই আয়োজন। আর এই কাজটি করেছেন শিল্পীরসিক তরুণ উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী লিটন শিকদার। তিনি জানিয়েছেন চারুকলা বিভাগের ১৫ জন শিল্পী দীর্ঘ সাত মাস ধরে দিনরাত্রি কসরত করে ৬০১ প্রতিমার এই মন্ডপ তৈরি করেছেন। লিটন শিকদার ও তাঁর সহধর্মিণী পূজা শিকদারের ব্যতিক্রমী শিল্পচিন্তার বাস্তবিক রূপদান করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের সাবেক ছাত্র দিব্যতনু দাস। যা বাস্তবায়ন করেছেন ভাস্কর আমিনুল ইসলাম আশিক ও তার দল। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসেবে ভক্ত দর্শনার্থীদের বিমোহিত মুগ্ধতায় ভরে তোলার যেন সব আয়োজনই করা হয়েছে এই মন্ডপে। ব্যক্তি উদ্যোগে এ আয়োজন অভূতপূর্ব। এখানে শারদীয়া দুর্গোৎসব যেন নতুন মহিমায় আবির্ভূত হয়েছে। এই মন্দিরে বিভিন্ন যুগের প্রতিমার নান্দনিক উপস্থাপনা ও অপূর্ব সংযোজন দর্শনার্থীদের সহজেই আকৃষ্ট করে। যেখানে এবার সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি যুগের ৬০১ প্রতিমার অনন্য স্থাপনায় সনাতন ধর্মীয় কৃষ্টি-কালচার, পৌরাণিক কাহিনী ও পার্বণের ভিন্ন ভিন্নœ দৃশ্যের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতার অনন্য আয়োজনও বটে। এতে নির্মিত ও স্থাপিত প্রতিমাগুলোর সৌকর্য বাড়ানোর পাশাপাশি এর মহত্ত তুলে ধরতে অপরূপ সাজসজ্জা আর আলোর খেলা হয়ে উঠছে মনোমুগ্ধকর ও দৃষ্টিনন্দন। ৬০১ প্রতিমার পাশাপাশি এবার শিকদার বাড়ির পূজার বিশেষ আকর্ষণ জলাধারে নির্মিত ত্রিমাত্রিক শিল্প উপস্থাপনা দুর্গামন্ডপে নতুন চর্চার শুরু। এই ইনস্টলেশন আর্টে উপস্থাপিত হয়েছে ৪০ ফুট দীর্ঘ কৈলাস পর্বতের চূড়ায় ধ্যানমগ্ন মহাদেব ও তার জটায় মা গঙ্গার ঝর্ণা রূপে নেমে আসা। তারই পাদদেশে রাম, সীতা, লক্ষণ ও রাম ভক্ত হনুমান। পর্বতের চূড়ায় মেঘের ভেলা এবং সামনে ভাসমান পদ্ম ও হংস এই উপস্থাপনায় নান্দনিক পূর্ণতা এনেছে। এই নান্দনিক উপস্থাপনা সহজেই মুগ্ধ করে ভক্তদের। আলোকসজ্জার ডিজিটাল সংযোজনা ভক্ত দর্শনার্থীদের কাছে অন্য রকম আবহ তৈরি করেছে। এই বিশাল মন্দিরে দুর্গাপূজার আয়োজক তরুণ সমাজ সেবক লিটন শিকদার। যিনি নিজ মেধা ও গুণে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সমাজের একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি হিসেবে। তারই উদ্যোগে নির্মিত প্রতিমাগুলোর সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী। দেব দেবীর প্রতিরূপ ও সনাতন ধর্মের নানা কাহিনীর অপূর্ব অবতারণার পাশাপাশি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজের অন্যায়, অবিচার ও কুসংস্কার দূর করার নানা প্রতিকৃতি তুলে ধরা হয়েছে। আর নান্দনিক এ আয়োজন দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিদিন তিন লক্ষাধিক ভক্ত এখানে আসেন বলে আয়োজকরা জানান। পুজোর পাঁচ দিন এই নির্জন হাকিমপুর শিশু-যুবা-বৃদ্ধার পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে। মিলেছে বাহারি আয়োজনে গ্রামীণমেলা। নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয় এই আয়োজন। এ আয়োজন এ প্রসঙ্গে তরুণ উদ্যোক্তা লিটন শিকদার জনকন্ঠকে বলেন, আমরা প্রতিবছরই সর্বাধিক দেব-দেবীর প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা অর্চনার আয়োজন করি। আমাদের কিছু কালেকশনের প্রদর্শনী এবং হিন্দু ধর্মের মানুষ যাতে আরও বেশি দেব-দেবীর বিষয়ে অবগত হতে পারে সে জন্যই এ আয়োজন। এটা সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ। এবার আমরা চার যুগের ৬০১টি দেব-দেবীর প্রতিমা নির্মাণ করেছি। কয়েক বছর ধরে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও দর্শনার্থীদের মন জয় করতে প্রতিমার সংখ্যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের এ আয়োজন সরাসরি মনিটর করছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এছাড়া স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন, র‌্যাব, বাগেরহাট পুলিশ সুপার, ব্যাপকসংখ্যক আনসার নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে দুই শতাধিক ভলান্টিয়ার এ আয়োজনের নিরপত্তায় সর্বদা সজাগ রয়েছেন। শতাধিক সিসি ক্যামেরায় সার্বিক আয়োজন মনিটর করা হচ্ছে। সব মিলে এলাকাজুড়ে নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলবত রাখা হয়েছে। এতবড় আয়োজনে প্রেরণা পেয়েছেন তার বাবা-মা, তারপর সহধর্মিণী পূজা শিকদার, ভাই অসীম শিকদার, শিশির শিকদারের কাছে। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে এ আয়োজন সুসম্পন্ন হয়েছে। এই আয়োজনকে ঘিরে মণ্ডপসহ আশপাশের প্রয়ায় এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সাজানো হয়েছে অপরূপ সাজে। আয়োজকরা বলছেন, শুধু বাগেরহাটই নয়, প্রতিমার সংখ্যা ও আড়ম্বতার দিক থেকে এ বছর এটাই বিশে^র সব থেকে বড় দুর্গাপূজার মণ্ডপ। জেলার বিভিন্ন স্থান, অন্য জেলা এমনকি পশ্চিম বাংলা থেকেও দর্শনার্থী ও পূজারীরা এখানে এসেছেন।
×