ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ ফারজানা ইসলাম

অতি চঞ্চল, অমনোযোগী ও অস্থির শিশুদের কথা

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১১ অক্টোবর ২০১৬

অতি চঞ্চল, অমনোযোগী  ও অস্থির শিশুদের কথা

শিশুরা দুষ্টমি করবে- এটাই স্বাভাবিক। দুরন্তপনা ও দুষ্টমির মধ্যদিয়ে শিশুর কৌতূহলী মন সব সময়ই নতুন কিছু শিখতে চায়। মাত্রাতিরিক্ত দুষ্টমি যখন ওদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটায়, দৈনন্দিন কাজকর্ম এমনকি খেলাধুলাতেও সে পর্যাপ্ত মনযোগ দিতে পারে না, তখন অবশ্যই অভিভাবকের বিষয়টা খতিয়ে দেখা দরকার। এই অস্থিরতা ও অতি চঞ্চলতা কি কোন বিকাশজনিত সমস্যার কারণে হচ্ছে? এ ধরনেরই একটি বিকাশজনিত সমস্যার নাম অউঐউ যেখানে, মূলত ৩ ধরনের সমস্যা দেখা যায়। অতি চঞ্চলতা (ঐুঢ়বৎধপঃরারঃু), অমনোযোগিতা (ওহধঃঃবহঃরড়হ) এবং হঠাৎ কিছু করে ফেলার প্রবণতা (ওসঢ়ঁষংরারঃু)। অতি চঞ্চলতা : এই শিশুরা কোথাও দুই-এক সেকেন্ডের বেশি স্থির হয়ে বসে থাকতে পারে না। সবসময় উসখুস করে, হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে। অমনোযোগী : ইচ্ছা থাকলেও এই শিশুরা কোন কাজে মনোযোগ দিতে পারে না। মনোযোগের অভাবে কোন কাজই এরা সুন্দরভাবে শেষ করতে পারে না। স্কুলের বই খাতা হারিয়ে ফেলে, সমবয়সী কারও সঙ্গেই ওদের বন্ধুত্ব হয় না। পড়ালেখায় দারুণভাবে পিছিয়ে পড়ে। হঠাৎ কিছু করে ফেলার প্রবণতা : নিজের আবেগের উপর এই শিশুদের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কাজের পরিণতি সম্পর্কে না ভেবেই হুট করে এরা কিছু একটা করে ফেলে। এতে অনেক সময় নানারকম বিপদ ঘটে যেতে পারে। অভিভাবকরা লক্ষ্য করুন দুষ্টুমির জন্যও কি প্রায়ই নিজে নানারকম চোট-আঘাত পাচ্ছে বা ঘরের জিনিসপত্রের যথেষ্ট ক্ষতি হচ্ছে? সমবয়সীদের তুলনায় কি ও অনেক বেশি ছটফটে? দু’তিন মিনিটের বেশি কি কোথাও স্থির থাকতে পারে না? কোন প্রশ্ন করলে পুরো মন দিয়ে শুনছে না, মাঝপথেই জবাব দেয়ার চেষ্ট করছে। বার বার ঞঠ ঈযধহহবষ বদল করছে। বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে। তার পালা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারছে না। স্কুল থেকে অভিযোগ আসছে এক জায়গায় বা সিটে বসে না, বেশি কথা বলে, বার বার অন্যদের বিরক্ত করে ইত্যাদি। অউঐউ থাকলে অনেক সময় অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছেলেমেয়েরাও সক্ষমতা দেখাতে পারে না। বাবা-মা ও স্কুলের শিক্ষকরা ভাবেন এই শিশু ইচ্ছে করেই বুঝি মনোযোগ দিচ্ছে না। শুধুই চরকির মতো ঘুরছে বা মোটর যানের মতো ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। যদি বা বসল, একবার পেন্সিল নিয়ে খেলছে, একবার কাগজেন নৌকা বানাচ্ছে এত বুদ্ধি তবুও পড়ার দিকে কোন মন নেই। আসলে শিশুটি কিন্তু ইচ্ছা করে এসব করছে না। সে অউঐউ বা মস্তিষ্কের এক ধরনের বিকাশ ঘটিত সমস্যার কারনে না ভেবেই হঠাৎ কোন কিছু করে ফেলার প্রবণতাকে (ওসঢ়ঁষংরারঃু) নিয়ন্ত্রণ বা দমন করতে পারছে না। এই লক্ষনগুলো দীর্ঘদিন উপস্থিত থাকে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বা পরিবেশেই চূড়ান্তমাত্রায় ঘটে থাকে। তারা পড়াশোনা, পারিবারিক, সামাজিক কর্মকা-ে দক্ষতা হারাতে থাকে। অউঐউ হচ্ছে শৈশবকালীন সমস্যাগুলোর মধ্যে খুব সাধারণ একটা সমস্যা যা কিশোর এবং বয়সপ্রাপ্ত অবস্থাতেও চলতে পারে। অউঐউ কেন হয় আমাদের সকলের মস্তিষ্কে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থ আছে যা আমাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। স্নায়ুতন্ত্রের এই রাসায়নিক পদার্থ যেমন ঘড়ৎ ধফৎবহধষরহ বা ঝবৎড়ঃড়হরহ এর অভাব ঘটলে এমনটি হতে পারে। অউঐউ আক্রান্ত শিশুদের ভেতর এই ঈযবসরপধষ সঠিক মাত্রায় নাই। গবেষণায় দেখা গেছে জন্মের পরবর্তীতে বিকাশ (গরষবংঃড়হব ড়ভ ফবাবষড়ঢ়সবহঃ) প্রারম্ভিক অবস্থায় মোটামুটি ঠিক থাকলেও সাধারণত স্কুলে লেখাপড়ার বয়স হতে না হতেই (৭ বছর বয়সের আগেই) এই সমস্যাগুলো ধরা পড়ে। নবজাতক শিশুর আঘাত বা ক্ষত অথবা প্রসবকালীন সময়ে নবজাতকের মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কমে গেলে এ ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। অউঐউ বংশগত হতে পারে অর্র্থাৎ পরিবারে অন্যদেরও এই সমস্যা হতে পারে। বর্তমান গবেষণায় দেখা গেছে যেসব মায়েরা গর্ভাবস্থায় সিগারেট খায় তাদের সন্তানদের অউঐউ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আরও কিছু গবেষণায় দেখা গেছে অতি অল্প বয়সে ঞঠ দেখাও ভবিষ্যতে অমনোযোগী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সাধারণত এদের মস্তিষ্কের বাহিরের গঠন বা ঝঃৎঁপঃঁৎব এ কোন অস্বাভাবিকতা থাকে না।, ফলে সাধারণ ঈঞ ঝপধহ বা গজও তে প্রায়ই কিছু পাওয়া যায় না। এদের ব্রেনের কার্যকারিতার ধরন ভিন্ন হওয়ায় এই ধরনের আচরণ বা সমস্যাগুলো দেখা দেয়। অউঐউ সমস্যার চিকিৎসা কি আনন্দের বিষয় হচ্ছে- সঠিক চিকিৎসায় এই ধরনের শিশুরা শিখতে পারে কিভাবে তাদের এই সমস্যাগুলো গধহধমব করতে হয় এবং কিভাবে ভালভাবে থাকা যায়। অনেক সময় কেবল মাত্র কিছু আচরণ পরিবর্তনের কৌশল (ইবযধারড়ৎ সড়ফরভরপধঃরড়হ চৎড়মৎধসসব) ও জীবনযাপনের রীতিনীতির পরিবর্তন ঘটিয়েই এই শিশুদের সক্ষমতা (চবৎভড়ৎসধহপব) ফিরিয়ে আনা যায়। আবার অনেক সময় কিছু ওষুধের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। গবফরপধঃরড়হ এর পাশাপাশি ইবযধারড়ৎ ঃযবৎধঢ়ু এবং ঈড়ঁহংবষরহম অউঐউ আক্রান্ত শিশু এবং তাদের পরিবারকে প্রতিদিনের সমস্যাগুলোর সঙ্গে ঈড়ঢ়ব করতে সাহায্য করে। ইবযধারড়ৎধষ ঞযবৎধঢ়ু এর উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ শিশুর আচরণ পরিবর্তন করতে সাহায্য করা। শিশু কিভাবে তার নিজের আচরণ নিজে গড়হরঃড়ৎ করবে তা শেখায়। ইবযধারড়ৎধষ ঞযবৎধঢ়ু এর আরেকটা উদ্দেশ্য হচ্ছে কোন কাজ করার আগে চিন্তা করা এবং রাগ নিয়ন্ত্রণ করা। ঞযবৎধঢ়রংঃ শিশুকে শেখায়Ñ কিভাবে অপেক্ষা করতে হয়, খেলনা ঝযধৎব করতে হয়, অন্যের গলার স্বর এবং ঋধপরধষ ঊীঢ়ৎবংংরড়হ পড়তে পারা, সঠিকভাবে জবংঢ়ড়হফ করা ইত্যাদি। যত ছোট বয়সে এই সমস্যা ধরা পড়বে ও চিকিৎসা শুরু হবে, সমস্যার তত বেশি সুষ্ঠু ও দ্রুত সমাধান সম্ভব। লেখক : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও বিভাগীয় প্রধান চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার এ্যাপোলো হসপিটাল, ঢাকা।
×