ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইমামবাড়া দানবাক্সের টাকা লুটের গুজবে মোহাম্মদপুরে সংঘর্ষ

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১১ অক্টোবর ২০১৬

ইমামবাড়া দানবাক্সের টাকা লুটের গুজবে মোহাম্মদপুরে সংঘর্ষ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পবিত্র আশুরা উপলক্ষে তিন দিনের তাজিয়া মিছিলের প্রথম দিনেই রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আটকেপড়া পাকিস্তানীদের বসবাসকারী ক্যাম্প মার্কেটে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অভিযানের সূত্র ধরে ঘটনাটি ঘটে। অভিযানকালে তাজিয়া মিছিলের জন্য ইমামবাড়ার দান বাক্সের টাকা লুটের খবর ছড়িয়ে পড়লে ক্যাম্পবাসী অভিযানকারীদের ওপর চড়াও হয়। এ সময় বিক্ষোভকারীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একজন এবং এক পুলিশ আহত হন। আশুরার প্রথম দিনেই অভিযান ঘিরে ক্যাম্পবাসীর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তবে ক্যাম্পের দায়িত্বশীলরা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, তাজিয়া মিছিল ঘিরে কোন ধরনের অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির ন্যূনতম কোন আশঙ্কা নেই। কোন গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে তাজিয়া মিছিল ঘিরে নাশকতার চেষ্টা করলে ক্যাম্পবাসীই শক্ত হাতে তা প্রতিহত করার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। সোমবার সকাল সাড়ে দশটার দিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সাদা পোশাকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানাধীন আটকেপড়া পাকিস্তানীদের বসবাসকারী ক্যাম্প মার্কেটে অভিযান শুরু করে। ক্যাম্পের এ ব্লকের হোসেনী ইমামবাড়ার ওসমান খলিফা বলছিলেন, সাদা পোশাকে ১০/১২ জন সোজা ইমামবাড়ার কাছে আসেন। তাদের হাতে ওয়্যারলেস ও পিস্তল ছিল। তারা নিজেদের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের লোক বলে পরিচয় দেন। এরপর ইমামবাড়ায় থাকা সবার দেহ তল্লাশি করেন। ক্যাম্পের অনেকেরই অভিযোগ, মাদকদ্রব্য থাকার সন্দেহে অন্যান্য বাক্সের সঙ্গে তাড়াহুড়া করে ইমামবাড়ার দানবাক্সটিও ভেঙ্গে ফেলেন অভিযান পরিচালনা-কারীরা। তবে তারা দানবাক্স থেকে টাকা নিয়েছেন কিনা তা নিশ্চিত নয়। তাদের তল্লাশি করতে দেখা গেলেও, টাকা নিতে দেখা যায়নি। সারাবছর ইমামবাড়ায় দানবাক্সটি রাখা থাকে। বাক্সটিতে জমা পড়া টাকা দিয়ে তাজিয়া মিছিলকারীদের খিচুড়ি খাওয়ানো হয়ে থাকে। প্রতিবছর এ দানবাক্সে অন্তত ৫০ হাজার টাকা জমে। এরপর তারা বেশ কয়েকটি বাড়িতে অভিযান চালায়। এর মধ্যে বি-ব্লকের নাজমা (৪০) নামে একজনের বাড়িতে অভিযান চালায়। বাড়ির নিচতলা ও দোতলার সমস্ত কাপড়চোপড় তছনছ করে। নাজমার অভিযোগ, বাসা থেকে বেশ কিছু টাকা খোয়া গেছে। তবে তার সঠিক পরিমাণ তিনি বলতে পারেননি। অভিযান পরিচালনাকারীরা তাকে মারধরও করেছেন। অযথাই বাসার জিনিসপত্র তছনছ করেছে। শুধু শুধু হয়রানি করেছে মাত্র। এ ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা মহানগরের উপ-পরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা জনকণ্ঠকে বলেন, তারা সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে ক্যাম্পটিতে অভিযান চালান। অভিযানকালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ২০ জন ছিল। তারা বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালান। অভিযানে মাদক বিক্রির সাড়ে ৩২ হাজার টাকা ও ১৬শ’ পিস ইয়াবাসহ শফি আলম (৪০) নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়। তার তথ্য মোতাবেক ক্যাম্পের বেশ কয়েকটি বাড়িতে এবং বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালানো হয়েছে। বেশ কয়েকটি ট্রাঙ্ক জাতীয় বাক্সে তল্লাশি চালানো হয়েছে। তল্লাশি চালানোর বাক্সগুলোর মধ্যে ইমামবাডার দানবাক্স ছিল কিনা তা তিনি নিশ্চিত নন। তল্লাশিকালে ক্যাম্পের বাসিন্দারা তাজিয়া মিছিলের জন্য সাজগোছ করছিলেন। এ সময় আচমকা বেশ কিছু লোক তাদের ওপর চড়াও হয়। তারা অস্ত্র নিয়ে তাদের ওপর চড়াও হন। এ সময় ক্যাম্পের বাসিন্দারা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একজন এবং পুলিশের এক সদস্য আহত হন। পরবর্তীতে তারা পরিস্থিতি খারাপ অনুভব করতে পেরে তড়িঘড়ি করে অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করে নিরাপদ জায়গায় চলে যান। অভিযানের দিন পবিত্র আশুরা উপলক্ষে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের তাজিয়া মিছিল বের করার প্রস্তুতি সম্পর্কে তার পুরোপুরি ধারণা ছিল না। ধারণা থাকলে হয়তো অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হতো। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অভিযানকালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের লোকজন ইমামবাড়ার দানবাক্স ভেঙ্গে টাকা লুটে নিয়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এমন গুজবে আবালবৃদ্ধবণিতা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অভিযান পরিচালনাকারীদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। টানা প্রায় দেড়ঘণ্টা ধরে অভিযান পরিচালনাকারী আর ক্যাম্পবাসীর মধ্যে টান টান উত্তেজনা বিরাজ করে। দুপুর বারোটার দিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের লোকজন চলে গেলে এবং ক্যাম্পের শীর্ষস্থানীয়রা বিষয়টি বোঝালে ক্যাম্পবাসী শান্ত হন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। ক্যাম্পের চেয়ারম্যান এসকে গোলাম জিলানী জনকণ্ঠকে বলেন, ক্যাম্পে যেকোন ধরনের অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার ন্যূনতম কোন আশঙ্কা নেই। যদি কোন গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করে, তাহলে ক্যাম্পবাসীকে সঙ্গে নিয়ে তারাই তা মোকাবেলা করবে। এজন্য ক্যাম্পবাসীরা পুরোপুরি প্রস্তুত। শান্তিপূর্ণভাবে পবিত্র আশুরার যাবতীয় কর্মকা- চালানোর জন্য ক্যাম্পবাসীদের সব ধরনের সহযোগিতা ও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। মোহাম্মদপুরের তাজিয়া মিছিল ঘিরে যেকোন ধরনের অরাজক পরিস্থিতির বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে জানিয়ে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার জনকণ্ঠকে বলেন, মোহাম্মদপুরসহ আশপাশের এলাকায় তাজিয়া মিছিল ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। তাজিয়া মিছিলকারীদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এ বিষয়ে সর্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। যেকোন ধরনের অরাজক পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুলিশকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, হিজরী পঞ্জিকার ১০ মহরম মুসলিম বিশ্বে আশুরা পালিত হয়। এক হাজার ৩৩২ বছর আগে এই দিনে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসেন (রা.) ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে শহীদ হন। আশুরা উপলক্ষে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন তাজিয়া মিছিল বের করে। কারবালার রক্তাক্ত স্মৃতি স্মরণে এ সময় অনেকেই ‘হায় হোসেন-হায় হোসেন’ মাতম তুলে নিজের দেহে আঘাত করে রক্ত ঝরায়। গত বছরের ২৩ অক্টোবর হোসেনী দালানে হ্যান্ডগ্রেনেড দিয়ে হামলা করে জঙ্গীরা। এতে দুই জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান জানান, বিষয়টি মাথায় রেখে এ বছর ঢাকায় দিনের বেলায় তাজিয়া মিছিল বের করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর মিছিলে বহনকারী নিশানের উচ্চতা ১২ ফুটের বেশি হতে পারবে না বলে বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। মিছিলে দা, কাঁচি, ছুরি, বল্লম বহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাজিয়া মিছিল ঘিরে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় থাকছে।
×