কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফর বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আগামী ১৩-১৭ অক্টোবর চীনা প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ, ভারত ও কম্বোডিয়া সফর করবেন। সোমবার চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ল্যু ক্যাং এ তথ্য জানিয়েছেন। এদিকে চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফর উপলক্ষে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকরা বলেছেন, এ সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের নতুন দুয়ার খুলবে।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ল্যু ক্যাং জানিয়েছেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের আমন্ত্রণে চীনা প্রেসিডেন্ট ঢাকা সফরে যাচ্ছেন। তিনি ঢাকা সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করবেন।
দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চীনা প্রেসিডেন্ট ১৩ অক্টোবর কম্বোডিয়া সফর করবেন। কম্বোডিয়ার রাজা নরোদম সিহামোনির আমন্ত্রণে দেশটি সফর করবেন শি জিনপিং। সেখান থেকে ঢাকায় আসবেন চীনা প্রেসিডেন্ট। ঢাকা থেকে ভারতের গোয়ায় ব্রিকস-বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দেবেন তিনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে তিনি সেদেশে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে ঢাকা-বেজিং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও গতি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষ করে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা আরও বাড়বে।
২০১৫ সালে ঢাকা-বেজিং কূটনৈতিক সম্পর্কের চল্লিশ বছর পূর্তি হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ৪০ বছর কূটনৈতিক সম্পর্ক পূর্তি উপলক্ষে গত বছরই ঢাকায় আসার কথা ছিল চীনা প্রেসিডেন্টের। তবে বিভিন্ন কারণে চীনা প্রেসিডেন্টের সফর পিছিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আগামী ১৪ অক্টোবর তিনি ঢাকায় আসছেন। শি জিনপিং এর আগে ২০১০ সালে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। তখন তিনি চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এদিকে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর করেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনা প্রেসিডেন্টকে ঢাকা সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
১৯৮৬ সালে চীনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লি জিয়ানিয়েন ঢাকা সফরে এসেছিলেন। এরপর প্রায় ত্রিশ বছর কোন চীনা প্রেসিডেন্ট ঢাকা সফরে আসেননি। তিন দশক পর চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঢাকা সফরে আসছেন।
এদিকে শি জিনপিংয়ের আসন্ন ঢাকা সফরে বাংলাদেশে বিনিয়োগের নতুন দুয়ার খুলবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে বিভিন্ন প্রকল্পে চীনা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। এছাড়া কূটনৈতিক দক্ষতায় বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের সুযোগ নিতে হবে। সোমবার রাজধানীর ডেইলি স্টার সেন্টারে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকরা এসব কথা বলেন।
ডেইলি স্টার পত্রিকা ‘বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক : দুই দেশের অর্থনৈতিক সংযোগ’ শীর্ষক এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। এতে সাবেক কূটনীতিক, সাংবাদিক, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক ও গবেষকরা আলোচনায় অংশ নেন।
গোলটেবিল বৈঠকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগামী ৫ বছরে চীন বাংলাদেশে প্রায় ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এছাড়া চীনা প্রেসিডেন্টের সফর সামনে রেখেও অনেক প্রকল্পের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সেগুলোর বিষয়ে আলোচনা সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা এ বিষয়ে কোন ভুল করলে অনেক খেসারত দিতে হবে। কারণ এসব প্রকল্পের অর্থ আমাদের ফেরত দিতে হবে।
শ্রীলঙ্কার উদাহরণ টেনে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশটির বড় দুটি প্রকল্পে চীনা অর্থায়নের কারণে তাদের বিদেশী ঋণের বোঝা অনেক বেড়ে গেছে। বিদেশী ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রশংসা করে তিনি বলেন, আমরা বছরে ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রফতানি ও রেমিটেন্স থেকে পাই। বিদেশী ঋণ পরিশোধ করি এক বিলিয়ন ডলারের মতো। ফলে আমরা অনেক বেশি বিদেশী ঋণ নেয়ার ক্ষমতা রাখি, কিন্তু এ ঋণের আলোচনা আমাদের সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে।
সেমিনারে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক সোবহান বলেন, প্রকল্প আলোচনার সময়ে এর শর্তাবলীর বিষয়ে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, প্রকল্প কে বাস্তবায়ন করবে, প্রকল্প নির্বিঘেœ সম্পন্ন করার জন্য যা যা করা দরকার সেটি করতে হবে; কারণ এ বিষয়ে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা ভাল নয়। তার মতে, চীনা প্রেসিডেন্টের সফর বাংলাদেশের প্রতি তাদের আগ্রহের বিষয়টি ইঙ্গিত করে।
‘বাংলাদেশ যে পরিমাণ গ্রহণ করতে পারবে, চীন ততটুকু সহায়তা বাংলাদেশকে দেবে’ বলে ফারুক সোবহান বলেন, চীনের নতুন দুটি উদ্যোগ ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ ও ‘এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক’ এর বাংলাদেশ অংশীদার। ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, তাদের মতের মিল-অমিল আছে। গত সাত বছর ধরে তারা সন্ত্রাসবাদবিরোধী মহড়া করছে এবং সন্ত্রাসবাদ তাদের দুই দেশের জন্যই সমস্যা। আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, বড় প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুষ্ঠু কূটনৈতিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখা। তিনি বলেন, চীন ও ভারত উভয়ই কানেক্টিভিটির জন্য আফগানিস্তানের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখার বিষয়ে আগ্রহী। সার্ক ছাড়া বিষয়টি সম্ভব নয়।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আইনুন নিশাত বলেন, প্রকল্প আলোচনার সময়ে নির্ধারিত শর্তাবলীর বাইরে গিয়ে বাংলাদেশে বেশিরভাগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এ কারণে প্রকল্প ব্যয় অস্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। তিনি বলেন, অস্বাভাবিক ব্যয় শুধু চীনের প্রকল্পের ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রেও ঘটে। যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এর খরচ মাত্র ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
আইনুন নিশাত বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অনীহা। এ কারণে বিদেশীরা আমাদের বিশ্বাস করতে চায় না। নিজের অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে একজন মন্ত্রীর সঙ্গে বেজিং সফরের সময়ে দেখেছি, চীনা কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন তুলেছে, কয়েক বছর আগে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, সেটি এখনও বাস্তবায়ন করা হয়নি, তার কারণ কী।
চীনে নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফায়েজ আহমেদ বলেন, ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ বৃহৎ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ধারণা। আমরা এই বৃহৎ যোগাযোগে যোগ দেব কিনা, তা আমাদের বিষয়। তিনি বলেন, ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডে যোগ দিলে অন্য কোন কানেক্টিভিটি উদ্যোগে যোগ দিতে বাংলাদেশের কোন বাধা নেই। চীনের অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর খরচ অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রকল্পের শর্তাবলী মেনে চললে খরচ অস্বাভাবিক বাড়ার সুযোগ নেই।
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা আরও বলেন, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে কূটনৈতিক দক্ষতার সঙ্গে এ অবস্থানের সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। এছাড়া চীন বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দরে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে সোনাদিয়া ও পায়রা বন্দরের ক্ষেত্রে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন- বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি এ্যান্ড স্টাডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মাহফুজ কবির, বিলিয়ার রিসার্চ এ্যাসোসিয়েট নুর মোহাম্মাদ সরকার, ঢাকায় নিযুক্ত শ্রীলঙ্কার হাইকমিশনার ইয়াসোজা গুনেসাকেরা, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী প্রমুখ। সেমিনারে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: