নিখিল মানখিন ॥ মানসিক রোগীদের সেবা দেয়ার মতো দক্ষ জনবল খুবই সীমিত। দেশে মানসিক রোগের ডাক্তার রয়েছেন ১৯৫ জন, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট রয়েছেন ৫০ জনের মতো। অকুপেশনাল থেরাপিস্ট রয়েছেন ১শ’ জনের বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসা সুবিধা সঙ্কটে ভুগছে দেশের মানসিক রোগীরা। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এ রোগের চিকিৎসার অবকাঠামো নেই। বিভাগীয় পর্যায়ে চিকিৎসা সুবিধা থাকলেও তা রোগীর তুলনায় খুবই অপ্রতুল। দেশে সাইকিয়াট্রিক নার্সিং বা সাইকিয়াট্রিক সোস্যাল ওয়ার্কের ওপর কোন প্রশিক্ষণ কোর্স নেই। ইদানীং অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লিনিক্যাল সোস্যাল ওয়ার্ক নামে একটি কোর্স চালু হয়েছে। অথচ দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের শতকরা ১৬
ভাগ মানসিক রোগী। মানসিকভাবে অসুস্থদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। মোট আক্রান্তের শতকরা ১৯ ভাগ নারী এবং ১২ দশমিক ৯ ভাগ পুরুষ মানসিক রোগী। ১৮ বছরের নিচে শতকরা ১৮ দশমিক ৪ ভাগ শিশু-কিশোর মানসিক রোগে ভুগছে। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ সোমবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার শতকরা ১৬.১ ভাগ যে কোন ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত। এ বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য প্রতি ১ লাখ জনসংখ্যার জন্য ০.০৭ জন মানসিক রোগবিশেষজ্ঞ রয়েছেন যা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। উন্নত দেশে এ অনুপাত প্রতি ১ লাখ জনসংখ্যার জন্য ১০ জন, মধ্য আয়ের দেশে ২.৭ জন, অনুন্নত দেশে ০.০৫। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, বর্তমান হারে জনবল বৃদ্ধি পেতে থাকলে আগামী ১শ’ বছরেও এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এজন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচীতে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা অন্তর্র্ভুক্তকরণ এখন সময়ের দাবি। এ লক্ষ্য অর্জনে সাধারণ চিকিৎসকদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান, মেডিক্যাল শিক্ষাব্যবস্থায় মানসিক রোগ চিকিৎসার কারিকুলাম সম্প্রসারণ ও স্কুল পর্যাযের পাঠ্যসূচীতে বিষয়টির অন্তর্ভুক্তকরণ জরুরী। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে উপজেলা, জেলা পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বস্তরে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচীতে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।
এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দাবি করে আসছে যে, শিশু ও নারীরাই এর শিকার বেশি হয়। এ লক্ষ্যে বর্তমান সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এবং পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ প্রণয়ন করেছে। এগুলো থেকে বেশ সুফলও আসছে। এ অর্জনকে স্থায়ী করতে সমাজকে তৎপর হতে হবে। এছাড়া মানসিক রোগ নিয়ে সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার ও অপচিকিৎসার বিরুদ্ধে সক্রিয় হওয়া দরকার।
অধ্যাপক ডাঃ প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, মানসিক রোগীদের প্রতি থাকতে হবে মানবিক আচরণ। একজন মানুষ নানা কারণে মানসিকভাবে অসুস্থ হতে পারে। সমন্বিত সেবা দেয়ার মধ্য দিয়ে এ রোগে আক্রান্তদের পাশে আমরা দাঁড়াতে পারি। পরিপূর্ণ সুস্থ থাকার জন্য মানসিকভাবে সুস্থ থাকা প্রয়োজন। মানসিক রোগের কারণে সৃৃষ্ট অক্ষমতা অন্যান্য শারীরিক রোগের কারণে সৃষ্ট অক্ষমতার চাইতে কম নয়। মানসিক রোগীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ ঝুনু শামসুন্নাহার বলেন, শারীরিক রোগের মতো মানসিক রোগও একটি রোগ। কিন্তু মানসিক রোগগুলোকে মানুষ সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। তাই মানসিক রোগকে অবহেলা করার প্রবণতাও আমাদের মধ্যে প্রবলভাবে রয়েছে। মানুষ প্রাথমিকভাবে কোন মানসিক সমস্যায় ভুগলে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে না গিয়ে কবিরাজ, ফকির বা মাজারে যায় চিকিৎসার জন্য। এতে মানসিক রোগের তীব্রতা আরও বেড়ে যায় এবং রোগীর অবস্থাও ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে। তিনি বলেন, যারা মানসিক রোগে আক্রান্ত তাদের শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখতে হবে, অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা যাবে না। পরিবার ও সমাজের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ মুনতাসির ফারুফ বলেন, বর্তমানে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচী বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় বাধা মানসিক রোগ ও চিকিৎসার প্রতি জনগণের ভ্রান্ত বিশ্বাস, কুসংস্কার ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। সচেতনতা এবং তথ্যের অভাবে মানসিক রোগীরা দেশে বিদ্যমান স্বাস্থ্য সেবাটুকু নিতে পারছেন না।
রাজধানীর মানসিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, জনসাধারণের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা ও মানসিক রোগের চিকিৎসার বিষয়ে জনসচেতনতা কর্মসূচী আরও বেগবান করা। দেশে বর্তমানে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, পাবনা মানসিক হাসপাতালসহ সব সরকারী হাসপাতালে মানসিক রোগ বিভাগ রয়েছে। এছাড়া কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এ সেবা দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতালে রোগীর শয্যা সংখ্যা ২শ’টি। এর এক-তৃতীয়াংশ শয্যায় দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হয়। হাসপাতালে খুব কম খরচে ইনডোর ও আউটডোরে চিকিৎসা দেয়া হয়। প্রতি বছর এই হাসপাতালে বহির্বিভাগে প্রায় ২২ হাজার মানসিক রোগী চিকিৎসা সেবা নেয়। মন খারাপ বা হতাশা, টেনশন, ভীতি, সামাজিক পরিস্থিতির ভীতি, মৃত্যুভীতি, পরীক্ষাভীতি, একা কোথাও যাওয়ার অক্ষমতা, ভয়ানক দুর্ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে মানসিকভাবে অসুস্থ হওয়া, এক কাজ বারবার করা, শারীরিক কারণ ছাড়াই শরীরে ব্যথা ইত্যাদি রোগীদের গ্রুপ বা ব্যক্তিগত পর্যায়ের সাইকোথেরাপি দেয়া হয় বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা জানান, বর্তমানে ব্রিটিশ আমলে প্রণীত অতি প্রাচীন ‘লুনাসি এ্যাক্ট’কে প্রতিস্থাপনের জন্য- ‘মানসিক স্বাস্থ্য আইন’-এর খসড়া সরকারের বিবেচনায় আছে। এছাড়া ‘মানসিক স্বাস্থ্য পলিসি’ প্রণয়নের কাজ চলছে। এগুলো প্রণীত হলে মানসিক রোগীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এগুলো সহায়ক হবে। মানসিক রোগ প্রতিরোধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়াও খুব জরুরী। রোগ হয়ে যাওয়ার থেকে হওয়ার আগে প্রতিরোধ করাই উত্তম। এর জন্য পরিবারে, স্কুলে ও সমাজে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। সঠিকভাবে শিশু প্রতিপালন করতে হবে, শিশুকে মাঠে সমবয়সীদের সঙ্গে খেলতে দিতে হবে, ভাল স্কুলে পড়াতে হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলিং সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এভাবেই আমরা পারি মানসিক রোগীদের মর্যাদা নিশ্চিত করতে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: