ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ভেজাল ওষুধ বিক্রি প্রতিরোধ করাই মূল লক্ষ্য

আলোর মুখ দেখছে মডেল ফার্মেসি স্থাপনের ঘোষণা

প্রকাশিত: ০৪:৫০, ১০ অক্টোবর ২০১৬

আলোর মুখ দেখছে মডেল ফার্মেসি স্থাপনের ঘোষণা

নিখিল মানখিন ॥ অবশেষে আধুনিক বিশ্বের আদলে মডেল ফার্মেসি স্থাপনের গাইডলাইন প্রণয়নের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। বাস্তবায়ন করবে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। গত কয়েক মাস ধরে মডেল ফার্মেসি স্থাপনের ঘোষণা এবার বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। ভেজাল ওষুধ বিক্রি প্রতিরোধ করাই এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ। প্রাথমিক পর্যায়ে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে রাজধানীসহ সারাদেশে দুই শতাধিক মডেল ফার্মেসি নির্মিত হবে। ওষুধ প্রশাসন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দোকানগুলোর ঠিকানা, বৈধতা ও অবৈধতা যাচাই করাটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। যেখানে সেখানে গড়ে উঠছে ওষুধের দোকান। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের চা, পান, বিড়ি, মুদির দোকানেও দেদারসে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার ওষুধ। আর ফার্মেসিগুলোর ওষুধ বিক্রেতাদের অধিকাংশেরই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা নেই। রাজধানীতেও এ সংখ্যা একেবারে কম নয়। অবৈধ ওষুধের দোকান জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সূত্র জানায়, প্রতিটি মডেল ফার্মেসি গ্রাজুয়েট ও পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রিধারী ফার্মাসিস্টদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। সারাদেশে দুই শতাধিক মডেল ফার্মেসি হলেও রাজধানীতেই হবে অর্ধশতাধিক। জানা গেছে, ‘এ’ ও ‘বি’ দুই ক্যাটাগরির মডেল ফার্মেসির লাইসেন্স দেয়া হবে। ‘এ’ ক্যাটাগরির মডেল ফার্মেসির আয়তন ১৫ ফুট বাই ১০ ফুট এবং ‘বি’ ক্যাটাগরির ফার্মেসির আয়তন হবে ১০ ফুট বাই ৯ ফুট। মডেল ফার্মেসিগুলোতে ক্যাটাগরি (এ ও বি) অনুযায়ী ওষুধ রাখার অনুমতি প্রদান করা হবে। কোল্ড চেইন অনুসরণ করে ওষুধ সংরক্ষণ করতে হবে। সাধ্য মোতাবেক কেউ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের সুব্যবস্থা করতে পারে। এসব ফার্মেসিতে প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি করা যাবে না। শুধু তাই নয়, প্রতিটি বিক্রিত ওষুধের হিসাব রাখতে হবে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক রুহুল আমিন জানান, বর্তমানে দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফার্মেসির সংখ্যা এক লাখ ২১ হাজার। তবে লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসি রয়েছে ১৯ হাজার ৮০০। অধিদফতরের কর্মকর্তারা পর্যায়ক্রমে ফার্মেসি পরিদর্শন করে লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসিগুলোকে লাইসেন্সের আওতায় আনার লক্ষ্যে কাজ করছেন। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর জানায়, বর্তমানে সি ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট দ্বারা ফার্মেসিগুলো পরিচালিত হচ্ছে। তারা ফার্মেসি কাউন্সিলের অধীনে সপ্তাহে একদিন করে আট সপ্তাহের ক্লাস ও প্রশিক্ষণ নিয়ে সি ক্যাটাগরির লাইসেন্স পাচ্ছেন। তবে ফার্মেসি কাউন্সিলের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে এ কোর্সের মেয়াদ ছয় মাস করার চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। এদিকে অভিযোগ উঠেছে, সরকারী তালিকাভুক্ত ৯৫ হাজার ফামের্সির মধ্যে ৬০ হাজারের লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের নির্দেশে গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে লাইসেন্সবিহীন ওষুধের দোকান বন্ধে জোরালো অভিযান শুরু হয়েছে। লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ দোকানগুলো সামাল দিতেই হিমশিম খাচ্ছেন অভিযান টিমের সদস্যরা। ওইসব ফার্মেসির মালিকরা গত দুই থেকে ৫ বছর ধরে লাইসেন্স নবায়ন না করে অবৈধভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। অর্থাৎ বর্তমানে দেশে মাত্র ৩৫ হাজার ফার্মেসি বৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। আর অননুমোদিত ফার্মেসির সংখ্যা সোয়া লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে জানা গেছে। লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ দোকানগুলো সামাল দেয়ার পর অননুমোদিত, অবৈধ দোকানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, দেশে ওষুধ ও খাবারে ভেজাল বন্ধে বেশ কিছুদিন ধরে অভিযান চালাচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অপরাধীদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে। ভেজাল ওষুধের কারখানা বন্ধ করা হচ্ছে। সীমিত জনবল ও সম্পদ নিয়ে সরকারের একার পক্ষে কাজটি করা দুরূহ। এ লক্ষ্যে ওষুধ প্রশাসনকে আরও কার্যকর ও শক্তিশালী করা হবে। প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিয়ে জেলা পর্যায়ের অফিস আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়া হবে। তিনি বলেন, এমনও দেখা যায় শাস্তি পাওয়ার পরও পুরানো ভেজাল ব্যবসায়ীরা আবারও একই অপরাধ করছে। এতে করে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের জন্যও বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই প্রবণতা বন্ধ করতে সর্বস্তরের জনগণকে নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল মহলের প্রতি আহ্বান জানান মোহাম্মদ নাসিম। এ সময় মন্ত্রী বলেন, দেশের বড় বড় বিখ্যাত হাসপাতাল ও দোকানে যদি ভেজাল ও অননুমোদিত ওষুধ পাওয়া যায় তবে দেশবাসী কোথায় যাবে? দেশবাসীকে বাঁচাতে প্রকৃত ব্যবসায়ীদেরই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। নকল ও ভেজাল ওষুধ প্রতিরোধে দোকানে চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন ছাড়া জীবন রক্ষাকারী ওষুধ বিক্রয় বন্ধে জনমত দৃষ্টি করার উপরও গুরুত্বারোপ করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ফার্মেসি চালাতে অবশ্যই সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের লাইসেন্স নিতে হয়। কিন্তু এসব কোন নিয়মই মানা হচ্ছে না। স্বল্প শিক্ষিতরা লাইসেন্স ও অনুমোদন ছাড়াই ফার্মেসি খুলে দেদারছে ওষুধ বিক্রি করছেন। এ বিষয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের নেই কোন কার্যকর পদক্ষেপ। ফার্মেসির লাইসেন্স গ্রহণ ও পরিচালনার পূর্বশর্ত হলো- ফার্মেসি পরিচালনার জন্য বাধ্যতামূলক কমপক্ষে ‘সি’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট থাকতে হবে। কিন্তু রাজধানীসহ সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ফার্মেসিগুলো ন্যূনতম প্রশিক্ষণবিহীন কথিত ফার্মাসিস্টদের দিয়েই চলছে। শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রাম-গঞ্জে অবৈধ ফার্মেসির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এসব ফার্মেসি চালাচ্ছেন স্বল্প শিক্ষিতরা। যাদের অধিকাংশেরই প্রশিক্ষণ এবং ফার্মেসির কোন লাইসেন্স নেই। রাজধানীতেও এ সংখ্যা একেবারে কম নয়। বাংলাদেশ কেমিস্ট এ্যান্ড ড্রাগিস্ট এ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ জানান, দেশে প্রায় ৭০ শতাংশ ওষুধের দোকান চলছে অনুমোদনহীনভাবে। এগুলোতে অবাধে বিক্রি হচ্ছে এন্টিবায়োটিক, ঘুম ও নেশাজাতীয় ওষুধ। যত বেশি প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়া যাবে অবৈধ ফার্মেসির সংখ্যা তত বেশি পাওয়া যাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক জানান, একজন ওষুধ বিক্রেতার অবশ্যই ওষুধ সংরক্ষণ, মাত্রা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে বেশিরভাগ ওষুধ বিক্রেতারই এ সম্পর্কিত কোন জ্ঞান নেই। যোগ্য চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই বিক্রেতারা ওষুধ বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী ফার্মেসিগুলোতে ট্রেড লাইসেন্স এবং ড্রাগ লাইসেন্স এমন জায়গায় রাখতে হবে যাতে সবাই দেখতে পায়। কিন্তু খুব কম সংখ্যক ফার্মেসিতেই এই নিয়ম মানতে দেখা যাচ্ছে। এদিকে, নতুন ওষুধ আইন প্রণয়নে হাত দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে এ আইনের একটি খসড়াও তৈরি হয়ে গেছে। এ আইনে দেশের ওষুধ প্রশাসনকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা এবং বিভিন্ন ওষুধ শিল্প কারাখানগুলোর নিয়মকানুন যাচাই-বাছাই করে দেখার অধিকার দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবিত ওই আইনে দোকানে ওষুধ নিরাপত্তা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
×