ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রুশো তাহের

রামপাল থেকে রূপপুর

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ১০ অক্টোবর ২০১৬

রামপাল থেকে রূপপুর

একটি দৈনিকে সম্প্রতি প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম দিয়ে লেখাটি শুরু করতে হচ্ছে। ‘মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প পেছাচ্ছে’, এই শিরোনামের সংবাদটি শুরু এভাবে : মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক সমন্বিত বিদ্যুৎ প্রকল্পের যথাসময়ে বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ ধরনের একটি সংবাদ পাঠককে পরিবেশনের জন্য দৈনিকটি যেন অধীর অপেক্ষায় ছিল। কেন? এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নদর্শী নেতৃত্বাধীন সরকারের জ্বালানি নীতির খানিকটা উল্লেখ করতে চাই। দেশের বিদ্যুত চাহিদা পূরণে সরকার দীর্ঘমেয়াদী জ্বালানি নীতি প্রণয়ন করে। যেখানে দেশের মোট বিদ্যুতের শতকরা ৫০ ভাগ কয়লা, ২৫ ভাগ গ্যাস এবং অবশিষ্ট ২৫ ভাগ পারমাণবিক ও নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করা হবে বলে ধরা হয়। উল্লেখ্য, জীবাশ্ম জ্বালানি উৎস, বিশেষত কয়লা থেকে বিদ্যুত উৎপাদনে বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পৃথিবীর মোট বিদ্যুত চাহিদার শতকরা ৪১ ভাগ আসে কয়লা থেকে। বৃহৎ অর্থনীতি ও জনসংখ্যার দেশ চীনের মোট বিদ্যুত চাহিদার শতকরা ৭৩ ভাগ যোগান দেয় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র। আসলে বিদ্যুতের জন্য পৃথিবীর মানুষ এখনও কয়লার ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। এই বিশ্ব বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে প্রণীত বাংলাদেশের জ্বালানি নীতি বাস্তবায়নে ২০৩০ সালের মধ্যে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত কয়লা থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যে ২৩টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনে কাজ করছে সরকার। এর একটি হচ্ছে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুতকেন্দ্র্র্র। এই প্রকল্পটি আরও গুরুত্বের এ জন্য যে, কয়লা আমদানির জন্য একটি জেটি নির্মাণ এবং সেই জেটিতে কয়লা পরিবাহী জাহাজ ভেড়ানোর জন্য বঙ্গোপসাগরকে সংযুক্ত করে একটি খাল খনন ও কয়লার মজুদদার তৈরি করা হবে এখানে। সুতরাং মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক সমন্বিত বিদ্যুত প্রকল্পের বাস্তবায়নে সামান্যতম অনিশ্চয়তা উন্নয়নকামী জনগোষ্ঠীর জন্য মারাত্মক এক দুঃসংবাদ বৈকি। কিন্তু যারা সুন্দরবনের কথা বলে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতাকে জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে ইউনেস্কো পর্যন্ত নিয়ে গেছে, আর যেসব মিডিয়া উন্নয়নবিরোধী ওই আন্দোলনের সংবাদ ফলাও করে কাভারেজ দিয়েছে, তারা তো মাতারবাড়ী বিদ্যুত প্রকল্পের অনিশ্চয়তার সংবাদ প্রকাশের অপেক্ষায় থাকতেই পারে। রামপালবিরোধী আন্দোলনকে উন্নয়নবিরোধী বলছি এই কারণে যে, এই বিরোধিতার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। পুরো সুন্দরবন কি রামপালকে ঘিরে ঘনীভূত? বাংলাদেশে কি সারা বছর উত্তর দিক থেকে বায়ু প্রবাহিত হয়? সুন্দরবনের অভ্যন্তরভাগ দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো কি উত্তর-দক্ষিণের পরিবর্তে পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবহমান যে, রামপালের বিষাক্ত সব বর্জ্য সুন্দরবনের সাতক্ষীরা অংশে গিয়ে পড়বে? এসব সাধারণ প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে আমাদের বিশেষজ্ঞরা রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মিত হলে কী কী আনুবীক্ষণিক ক্ষতি, তাও আবার হাজার হাজার বছর পরে সংঘটিত হবে, তা নিয়ে নানা ধরনের ব্যবস্থাপত্র দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। ওই দৈনিকে দুদিন পর প্রথম পৃষ্ঠার একটি সংবাদ শিরোনাম ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ফেরত নেবে না রাশিয়া’। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নিয়ে আরেকটি সংবাদ শিরোনাম ‘আয়ুষ্কালজুড়ে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে’। তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ফেরত নেবে না রাশিয়া- এটি স্রেফ মিথ্যাচার। পরন্তু সংবাদ শিরোনামের সঙ্গে সংবাদের বিষয়বস্তুর কোন মিল নেই। আর আয়ুষ্কালজুড়ে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবেÑ এতে সমস্যা কোথায় বোঝা গেল না! এটা প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপানোযোগ্য সংবাদ শিরোনামইবা হলো কিসের ভিত্তিতে তা স্পষ্ট নয়। পারমাণবিক প্রযুক্তি অতি সংবেদী ও উচ্চতর বলে আয়ুষ্কালজুড়ে রাশিয়ান বিশেষজ্ঞদের ওপর নির্ভরশীলতাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট অপারেশনাল কর্মে দক্ষ জনবল থাকলেও রফতানিকারী দেশের বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতি অনিবার্যÑ এটা সর্বজনবিদিত। আর নিউক্লিয়ার প্রযুক্তিতে বাংলাদেশে দক্ষ জনবল নেই, এ তথ্য সঠিক নয়। বরং রিসার্চ রি-এ্যাক্টর পরিচালনার অভিজ্ঞতাও বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের রয়েছে। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউক্লিয়ার বিভাগও চালু করা হয়েছে। আসলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রকে ঘিরে বাংলাদেশে নিউক্লিয়ার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ জনবল তৈরির এক মহাযজ্ঞ শুরুর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এই সম্ভাবনার যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার রি-এ্যাক্টর পরিচালনার দক্ষ জনবল বিদেশে প্রেরণও করতে পারে। কিন্তু যারা বলছে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ফেরত নেবে না রাশিয়া কিংবা আয়ুষ্কালজুড়ে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে, তারা চায় না রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার বিদ্যুত উৎপাদনের যুগে প্রবেশ করুক। যেমনটি চায় না রামপালসহ ২৩টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করুক। আসলে দৃশ্যমান হচ্ছে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন। কিন্তু অন্তরালে থেকে যাচ্ছে রাশিয়া ও ভারতবিরোধিতা। মুক্তিযুদ্ধকালীন আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও প্রতিবেশী ভারতের সার্বিক সহযোগিতায় যথাক্রমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র ও রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মিত হোক- মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়ন হোক- তা দেশী-বিদেশী অনেকেরই ভাল লাগছে না। তাই তো রামপাল নিয়ে নানা মাত্রার আজগুবি সব বিরোধিতা ও ষড়যন্ত্র। এবার রামপাল স্টাইলের ওই বিরোধিতা ও ষড়যন্ত্রের থাবায় আক্রান্ত হতে যাচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র। লেখক : বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক ও গবেষক
×