ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সামুদ্রিক অর্থনীতিতে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ৯ অক্টোবর ২০১৬

সামুদ্রিক অর্থনীতিতে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব

বঙ্গোপসাগর ও উপকূলীয় এলাকা বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। টেকসই সামুদ্রিক অর্থনীতি উপকূলের নিকটবর্তী সুবিস্তৃত অর্থনৈতিক অঞ্চল আর উপকূল ও উপকূলের দূরবর্তী অঞ্চলের মধ্যকার বন্ধন ও পরিচর্যা, পরিচালন ও ব্যবহারের সম্পর্ক নির্মাণ করতে পারে। বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখোমুখি। অধিকাংশ সম্পদ দূষণের কারণে ধ্বংস ও ক্ষয়প্রাপ্ত। গবেষণা করলে দেখা যায়, বঙ্গোপসাগরের প্রাণী ও জীবজগতের ওপর ৫টি হুমকি রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে- অতিরিক্ত মাছ ধরা, শিকারী প্রাণীদের ধ্বংস করা, দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ ধ্বংস। অতিরিক্ত মাছ ধরা : অতিরিক্ত মাছ ধরার কারণে মৎস্য সম্পদের ভা-ার ক্রমশ উজাড় হয়ে যাচ্ছে যা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। শিকারী প্রাণীদের ধ্বংস করা : শিকারী প্রাণীদের অপসারণ প্রাণিসম্পদ সংরক্ষণের সম্ভাবনা নষ্ট করে। যা মেরিন ইকোসিস্টেম অস্থিতিশীল করে তোলে ও মানব সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দূষণ : দূষণ সামুদ্রিক প্রাণী জগতকে বিষাক্ত করে এবং গোটা সমুদ্রের পরিবেশকে ধ্বংস করে থাকে। কঠিন ও রাসয়নিক বর্জ্য যা মানব সমাজ প্রতিনিয়ত সমুদ্রবক্ষে নিক্ষেপ করছে। প্লাস্টিক পণ্য, স্যুয়ারেজ বর্জ্য, তেল এবং বিষাক্ত পদার্থ যা খাদ্য ভা-ারে প্রতিনিয়ত জমা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন : জলবায়ু পরিবর্তন বিশাল মৃত জোনকে প্রবাল হিসেবে গড়ে তোলে। সমুদ্রের জীবন প্রায় সকলক্ষেত্রে এভাবেই তৈরি হয়। ক্রমবর্ধমান প্রতিকূল পরিবেশে তাদের বাঁচার সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়। পরিবেশ ধ্বংস : উপকূলীয় উন্নয়ন, ট্রেনিং, ও কৃষিকাজ এগিয়ে নেয়ার নামে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সমুদ্রে বসবাসকারী প্রাণী ও জীবজগতের স্বাস্থ্যের জন্য এগুলো সহায়ক নয়। মৎস্য সম্পদ রক্ষা ও স্থানীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ করতে হবে। মৎস্য সম্পদের বিকাশ ও পরিবেশ রক্ষার জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী সলিড ও বর্জ্য পদার্থ নিক্ষেপ থেকে বঙ্গোপসাগরের জলরাশিকে বাঁচাতে হবে। দূষণমুক্ত রাখতে দৃঢ়তার সঙ্গে সমুদ্র সম্পদ আহরণ নীতি মেনে চলতে হবে। এতে সমুদ্রের পরিবেশও বাঁচবে। উপকূলে জিনগতভাবে উৎপন্ন মৎস্যসম্পদ চাষ বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। ক্ষতিকর সকল ধরনের তৎপরতা প্রতিরোধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষণামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। উপযুক্ত পরিবেশ নির্ভরতা, সংরক্ষণের মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে কমিউনিটি ভিত্তিক এ্যাকশন অরিয়েন্টেড এ্যাপ্রোচ এগিয়ে নিতে হবে। সমুদ্র গবেষক, সমুদ্র বিশেষজ্ঞ, মেরিন ফিশারিজ এক্সপার্ট ও শিক্ষার্থীদের সমুদ্র এলাকার গবেষণা কর্ম এগিয়ে নিতে উৎসাহ দিতে বৈজ্ঞানিক ইনস্টিটিউটের নেটওয়ার্ক ও একটিভিটিস্ট ফোরাম গড়ে তোলা উচিত। বর্তমানে একদল উৎসর্গীকৃত স্বেচ্ছাসেবী ডুবুরী, সমুদ্র সার্ভেয়ার, সুইপার ও মটিভেটর হিসেবে কাজ করছে। মেরিন পরিবেশ রক্ষা ও সমুদ্রকে জাতীয় পর্যায়ে উন্নীত করার কর্মসূচির অংশ হিসেবে এটা করা হচ্ছে। এছাড়া সংযোগ স্থাপন, সহযোগিতা, সলিড ও বর্জ্য পদার্থ থেকে জীববৈচিত্র্য ও স্থানীয় অর্থনীতিকে বাঁচানোর লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার, প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন গুরুপূর্ণ। এসওএস পর্যবেক্ষণে জানা যায়, প্রত্যেক মাছ ধরা নৌকা ও পরিবহন নৌকাকে সমুদ্র রক্ষাকারী পতাকা বহন করতে হবে। বর্তমান সমুদ্র উপকূলের পরিবেশ পর্যটনবান্ধব নয়। উপকূলীয় অঞ্চল সংরক্ষণ ও মেরিন প্রোটেক্টেড এরিয়া (এমপিএ) স্থাপনের মধ্য দিয়ে পর্যটনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। ফলে মানুষ উপকূলীয় এলাকার কর্মকা- দেখার প্রচ- আকর্ষণ, বন্যপ্রাণী, সার্ফিং, পানিতে ডুব দেয়ার দৃশ্য দেখার জন্য পর্যটন স্থলসমূহে ছুটে আসবে। দর্শক, পর্যটকদের এই পদচারণায় উপকূলীয় জনজীবন অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবে। অতিরিক্ত মাছ শিকার ও পুনরুজ্জীবিত মাছ টেকসই পর্যায়ে নিতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। এসওএস সরকার, জেলে ও অন্যান্য অংশীদারিদের নিয়ে এ ব্যাপারে কাজ করার পরিকল্পনা করছে। ভবিষ্যত মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার অধীনে এসওএস বৈজ্ঞানিক উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত সংস্থাসমূহের সমর্থনে কর্মকৌশল ও নীতি গ্রহণের পদক্ষেপ নেবে। এই প্রক্রিয়াটি জেলেদের মাছ শিকারের বর্তমান ব্যবস্থাপনায় জ্ঞান ও বিজ্ঞান সংযুক্ত করে টেকসই ব্যবস্থায় পরিণত করার নিশ্চয়তা প্রদান করবে বলে আশা করা যায়। উপকূল ও সমুদ্র নিকটবর্তী অঞ্চলে মাছ চাষ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও বিধিনিষেধ ছাড়া মৎস্য চাষ ব্যাপক মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার প্রতি মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এসওএস অবশ্যই জিনগতভাবে উৎপন্ন মাছ চাষ প্রতিরোধে উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এ পর্যন্ত আমাদের নীতি নির্ধারকরা আমাদের সমুদ্র ও কমিউনিটিসমূহের ব্যাপারে পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল নন। জিনগত মাছ চাষ মৎস্যচাষের বিদ্যমান পদ্ধতি এড়িয়ে ব্যাপক মৎস্যসম্পদ ধ্বংস করতে পারে। মৎস্য ফিড, বর্জ্য ও রাসায়নিক পদার্থ ফার্ম থেকে সমুদ্র বক্ষে নিক্ষিপ্ত করার মাধ্যমে সমুদ্রের গোটা জলরাশিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চারপাশের পরিবেশও। সেই সঙ্গে জেলেদের জীবিকার্জনের পথকেও সঙ্কুচিত করছে। সমুদ্রে জ্বালানি তেল উত্তোলন পরিবেশের ওপর অনেক মারাত্মক প্রভাব ফেলে। সেই প্রভাবগুলো হচ্ছে- ১. সিসমিক অপারেশনে সৃষ্ট বিস্ফোরণ, শব্দ ব্যাপক জলজীব ও প্রাণীকে ক্ষতির সম্মুখীন করার প্রধান কারণ। ২. ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে যে পরিবহন কাজ পরিচালিত হয় তাতে অধিকাংশক্ষেত্রে জ্বালানি নিঃসরণ ও ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটে যা জলরাশির জন্য ক্ষতিকর। ৩. সমুদ্রের তলদেশ থেকে কাদামাটি অপসারণ ও খননকালে নির্গত টক্সিন ও তেজক্রিয় পদার্থ সমুদ্রের জলরাশিকে বিষাক্ত করে। ৪. সমুদ্রের খনিজ পদার্থ উত্তোলন কাজে মাঝে মাঝে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিপর্যয়কর পরিস্থিতি এড়াতে ব্যবহারকারীরা এই গ্যাস ব্যবহার করে থাকেন। ৫. জ্বালানি তেলক্ষেত্রের উৎপাদন শুরুর পর পেছনে পড়ে থাকা ইস্পাত ও সিমেন্ট অবকাঠামো যা ধ্বংস করা ব্যয়বহুল ও পরিবেশগতভাবে স্পর্শকাতর প্রক্রিয়া। অতএব এসওএসকে দৃঢ়ভাবে যে কোন মেরিন দূষণ ও বিপর্যয় ঠেকাতে স্পষ্ট ও বিস্তৃত নিরাপত্তা ও পরিচালন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সমুদ্রের জ্বালানি উত্তোলনের প্রতি অগ্রাধিকার দেয়ার পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি যেমন সমুদ্রে ‘উইন্ডমিল’ চালুর ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিত। সরকারকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সম্প্রসারণে বায়ুচালিত জ্বালানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি একইসঙ্গে কম খরচের ও টেকসই যা অর্থনীতিতে ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী কল্যাণ এনে দেবে। অনেক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন সমুদ্রের আবাসস্থল এবং সামুদ্রিক বন্যপ্রাণী রক্ষা করার জন্য লড়াই করছে। সামুদ্রিক জীবন সম্পর্কে সবাইকে সচেতন হতে হবে। কেননা অর্থনীতির এক বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে সামুদ্রিক অর্থনীতি।
×