ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইলিশ উৎপাদন বাড়াতে বিশেষজ্ঞদের নতুন মিশন শুরু

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৯ অক্টোবর ২০১৬

ইলিশ উৎপাদন বাড়াতে বিশেষজ্ঞদের নতুন মিশন শুরু

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ ইলিশ নিয়ে সরকার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপে চলতি মৌসুমে সাড়া জাগানো সুফল আসায় আরও গবেষণার জরুরী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মূল্যবান এ মৎস্যের অবাধ প্রজনন, অভয়াশ্রম রক্ষা, প্রাচুর্যতা ও ম্যাচুয়িরিটিকে প্রাধান্য দেয়া, পানির ভৌত ও রাসায়নিক, জৈবিক, পরিবেশ পর্যবেক্ষণ, নিরাপদ বিচরণসহ সম্ভাব্য সব কিছুর ওপর রিপোর্ট পাওয়ার পর সরকার আগামীতে আরও জরুরী ও জোরাল পদক্ষেপ নেবে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এরই আলোকে আজ রবিবার মৎস্য অধিদফতরের চাঁদপুর স্টেশন থেকে ১৪ সদস্যবিশিষ্ট দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞের একটি দল সাগর ও সাগর সন্নিহিত নদ-নদীতে গবেষণা কাজ শুরু করছে। সূত্র জানায়, বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দুইজন মালয়েশিয়ান ও অন্যরা বাংলাদেশী। পাঁচ জেলার ১৫ থেকে ২০ স্থান ঘুরে গুরুত্বপূর্ণ দুটি পয়েন্টে গবেষণা কাজ চলবে। ইতোমধ্যে বিশেষজ্ঞদের ধারণা অনুযায়ী গেলবারের চেয়ে মৌসুমে ছয়গুণেরও বেশি নদ-নদীতে ইলিশের বিচরণ বেড়েছে। মেঘনা মোহনা ধরে প্রায় সাত হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে ইলিশের প্রজনন স্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। কিন্তু প্রজনন ক্ষেত্রে আহরণে যে অবাধ বিচরণ, জাটকা নিধন, নদী দূষণ ইত্যাদিসহ বিভিন্ন কারণে বিগত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ইলিশের আহরণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়ে যায়। শুধু তাই নয়, আকারে ছোট যা জাটকা নামে পরিচিত ব্যাপকভাবে নিধন হয়ে মূল্যবান ও সুস্বাদু এ মৎস্য পরিণত অবস্থায় পৌঁছতে বড় ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়ে আসছিল। এ অবস্থায় সরকার প্রথমে এগারো ও পরে পনেরো দিন প্রজনন মৌসুমে ইলিশ আহরণ, জাটকা নিধন, বিক্রয়, মজুদসহ সর্বক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সরকার গৃহীত এসব পদক্ষেপের পর এবারের মৌসুমে ব্যাপক সুফল এসেছে বলে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ধারণা প্রাপ্তির পর মন্ত্রণালয়ের পক্ষে ইলিশ নিয়ে আরও জরুরী গবেষণার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এরই আলোকে ‘এমভি রূপালী ইলিশ’ নামে গবেষণা জাহাজযোগে ১৪ সদস্যের বিশেষজ্ঞ দল আজ থেকে ২৬ দিনব্যাপী টানা গবেষণা চালাবে সম্ভাব্য পয়েন্টগুলোতে। এরপর চূড়ান্তভাবে বাছাই করা হবে দুটি পয়েন্ট। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের চাঁদপুর স্টেশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুহাম্মদ আনিছুর রহমান শনিবার জানিয়েছেন, ইউএসএইডের অর্থায়নে ওয়ার্ল্ড ফিস ইকোফিস প্রকল্পের আওতায় এ গবেষণা কাজ চলবে। ইলিশের বিচরণ, প্রজনন, মাইগ্রেশন তৎপরতা রয়েছে এমন পাঁচ জেলার মধ্যে চাঁদপুরের হাইমচর, বরিশালের কালিগঞ্জ, লক্ষ্মীপুরের আলেকজান্ডার, নোয়াখালীর চেয়ারম্যানঘাট, মৌলভীচর ও ভোলার মনপুরাসহ একাধিক পয়েন্টে প্রাথমিক গবেষণা চলবে। এসব পয়েন্ট থেকে বেছে নেয়া হবে দুটি পয়েন্টকে। এ দুটি পয়েন্টে ৪ নবেম্বর পর্যন্ত তাদের গবেষণা কাজ অব্যাহত থাকবে। তিনি জানান, এর মূল উদ্দেশ্য ইলিশ প্রজননের সম্ভাব্যতা পর্যবেক্ষণ, প্রাচুর্যতা ও ম্যাচুয়িরিটি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি ওই অঞ্চলে পানির ভৌত রাসায়নিক ও জৈবিক অবস্থান পর্যবেক্ষণের কাজটি সম্পন্ন করা। ড. আনিছুর রহমান জানান, ইলিশের বংশ বৃদ্ধিতে সম্ভাব্য সবকটি নেতিবাচক পরিস্থিতির অবসান ঘটানো যায়নি। পরিপূর্ণভাবে পরিবেশ পরিস্থিতি ইলিশের পক্ষে আনা গেলে আগামীতে দেশের আরও অনেক নদ-নদীতে ইলিশের বিচরণ ও আহরণের ঘটনা নিশ্চিতভাবে ঘটবে। তিনি জানান, বর্তমানে ইলিশের গড় উৎপাদন ৩ লাখ মেট্রিক টন। মূল উৎপাদন এর প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাৎ প্রায় ৮ লাখ টন। কিন্তু ফিশিং বোট, ট্রলার এবং অন্যান্য নৌযানে ইলিশ ধরা পড়ছে অর্ধেকের চেয়ে কম। ফলে বিগত সময়গুলোতে ইলিশের আকাল সৃষ্টি হয়। সরকার গৃহীত ব্যবস্থার আলোকে এবারের মৌসুমে বড় ধরনের সুফল প্রাপ্তির পর মৎস্য অধিদফতর ও মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসেছে। গবেষণার ওপর জোর দিয়েছে এবং তা এ মৌসুমের মধ্যেই এ রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। ফলে বিদেশী বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে ১৪ সদস্যেও দলটি আজ থেকে আগামী ৪ নবেম্বর পর্যন্ত সরেজমিনে যে গবেষণা চালাবে তাতে বাস্তব অবস্থা চলে আসবে বলে মৎস্য অধিদফতরের নিশ্চিত ধারণা। এবার দেশের প্রায় ১৩০টি নদ-নদীতে ইলিশের বিচরণ ও আহরণ লক্ষ্য করে সরকার এবং বিশেষজ্ঞরা বেশ আশাবাদী যে, আগামীতে এর পরিস্থিতি আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যাবে। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য আর কি কি বাধা রয়েছে বা তার অবসানে সুপারিশে থাকবে গবেষণা ও রিপোর্টের মূল প্রতিপাদ্য। যা থেকে সরকার আগামী মৌসুমে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। যেহেতু ইলিশ একটি সুস্বাদু মাছ। এবার এ সুস্বাদু মাছ সকলের জন্য অধিকাংশের ক্ষেত্রে সহজলভ্য হয়েছে। এর মূল কারণ, প্রজনন ও বংশ বিস্তারে যেসব বাধা গেঁড়ে বসেছিল অনেকাংশে এর অবসান। এর পাশাপাশি রয়েছে জনসচেতনতা। অর্থাৎ জাটকা নিধন বন্ধ, মজুদ, বেচাকেনা না করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের নজরদারি। এবারের মৌসুমে যেভাবে ইলিশ ধরা পড়েছে এ থেকে ধারণা নিয়ে বিশেষজ্ঞ সরকারের কাছে মত দিয়েছেন এই বলে যে, আগামীতে প্রজনন মৌসুমে আইনের আরও কড়াকড়ি বাস্তবায়ন, সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ইলিশ প্রজনন ব্যবস্থাকে অবাধ ও নিশ্চিত করার পাশাপাশি অন্যান্য আইনী ব্যবস্থাদি বাস্তবায়ন করা। কারেন্ট জাল নিষিদ্ধ করার পর গোটা মৎস্য সম্পদের ক্ষেত্রে যে সফলতা এসেছে তা এক কথায় নজিরবিহীন বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
×