ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আইন সংশোধন না হওয়ায় বিচার হচ্ছে না জামায়াতের

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৯ অক্টোবর ২০১৬

আইন সংশোধন না হওয়ায় বিচার হচ্ছে না জামায়াতের

আরাফাত মুন্না ॥ আইন সংশোধন না হওয়ায় আটকে আছে মুক্তিযুদ্ধকালে অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার। আইনে অপরাধী সংগঠনের সাজার বিধান যুক্ত করতে আইন মন্ত্রণালয় থেকে ট্রাইব্যুনালস আইনে চতুর্থ সংশোধনী আনার উদ্যোগ নেয়া হয় দুই বছরেরও বেশি সময় আগে। তবে এখনও পর্যন্ত ওই সংশোধনী প্রস্তাব ওঠেনি মন্ত্রিসভার বৈঠকে। ফলে আইন সংশোধন না হওয়ায় বিচার শুরুরও উদ্যোগ নিতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। ওই সময় বলা হয়েছিলো, মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সংগঠনকে নিষিদ্ধ এবং ভবিষ্যত কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিধান যুক্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ আরেক দফা সংশোধন করা হবে। বিদ্যমান আইনে মুক্তিযুদ্ধকালে অপরাধী সংগঠনের বিচারের সুযোগ থাকলেও শাস্তির কোন বিধান নেই। এ কারণে ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না। তাই আইনে সংশোধনী আনা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (সংশোধন) আইন, ২০১৩-এ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনেরও বিচার করার বিধান যুক্ত করা হয়। কিন্তু আইনে সংগঠনের শাস্তি কি, তা উল্লেখ না থাকায় আরও সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আইনটি আবারও সংশোধন করে সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার এখনও শুরু না হওয়ায় সংশয় বাড়ছে বিচার প্রার্থীদের মধ্যে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম সূত্রে জানা গেছে, জামায়াতের বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে প্রসিকিউশন প্রধানের কাছে তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা। প্রসিকিউটররা তদন্ত রিপোর্ট এবং দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে প্রস্তুত রয়েছেন। আইনের সংশোধনী পাস হলেই তারা ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন। কিন্তু কবে আইনের সংশোধনী করা হবে, তা সরকারের মন্ত্রিপরিষদই ভাল জানেন বলে জানান প্রসিকিউশন সূত্র। এ বিষয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, আইনটি সংশোধনের জন্য কেন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, সেটা একমাত্র আইনমন্ত্রীই ভাল বলতে পারবেন। কিন্তু এ কারণে মানুষের হতাশা বাড়ছে এবং সবাই ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ছেন। যারা এতদিন ধরে বিচারের জন্য অপেক্ষা করছেন, তারা আর কতদিন অপেক্ষা করবেন সেটা আমাদের বোধগম্যের বাইরে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সংশ্লিষ্ট আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সংগঠনের বিচার করার কথা থাকলেও শাস্তির ব্যবস্থা নেই। এটাকে মন্ত্রী বড় ত্রুটি হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের বিচার হচ্ছে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে। এই আইনে সংগঠনের বিচারের কথা থাকলেও শাস্তির ব্যবস্থা নেই। ত্রুটিগুলো শুদ্ধ করার পর বিচার কাজ শুরু করতে হবে। তা না হলে দেখা যাবে, বিচার হচ্ছে, কিন্তু সাজা হবে না। তখন সেটা হাস্যকর হবে। তিনি আরও বলেন, সরকার জামায়াতের বিচারের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেনি। জামায়াতের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হবে। কিন্তু আইনে যেন কোন ত্রুটি না থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যাতে এই বিচার একটা প্রহসনের বিচার না হয়। শীঘ্রই আইনের সংশোধনী প্রস্তাব মন্ত্রিসভার বৈঠকে উঠবে বলে জানান আইনমন্ত্রী। হঠাৎ থেমে যায় জামায়াতের বিচার প্রক্রিয়া ॥ প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজসহ সাতজন আইনজীবীর একটি প্যানেল ২০১৪ সালে আড়াই মাস ধরে প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অভিযোগ তৈরির কাজ করছিলেন। কিন্তু তা প্রস্তুত করে আদালতে উপস্থাপন, অভিযোগ আমলে নেয়া এবং আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) গঠন প্রক্রিয়া থেমে যায়। কারণ হিসেবে জানা যায়, সংগঠনের বিচারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে কিছু ত্রুটি রয়েছে। তারা এই ত্রুটি সংশোধন করতে চান। আইন সংশোধনের খসড়ায় যা থাকছে ॥ আইনটির খসড়া অনুমোদন হলে ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০ (২) ধারায় সংগঠনের শাস্তির বিধান যুক্ত হবে। তাতে ট্রাইব্যুনাল দোষী সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে এবং এই নামে বা অন্য কোন নামে সংগঠনটির ভবিষ্যত কার্যক্রমের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবেন। পাশাপাশি সংগঠনটির সদস্যদেরও ট্রাইব্যুনাল সাজা দিতে পারবেন। বর্তমানে এ ধারায় শুধু ব্যক্তির সাজার বিধান রয়েছে। এছাড়া আইনের ৪ নং ধারা সংশোধনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোন সংগঠনের কার্যনির্বাহী কমিটি অথবা কেন্দ্রীয়, আঞ্চলিক বা স্থানীয় কমিটির সদস্য যদি অপরাধ করেন, তাহলে ওই অপরাধের জন্য সদস্যের পাশাপাশি সংগঠনও দায়ী হবে। সংশোধনের খসড়া অনুযায়ী, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ওই নামে বা অন্য নামে কার্যক্রম চালাতে পারবে না। আইন সংশোধনের প্রেক্ষাপট ॥ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল বা নূরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের সনদের নবম অনুচ্ছেদে বলা হয়, কোন গোষ্ঠী বা সংগঠনের একজন সদস্যের বিচারের সময় ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট সংগঠন বা গোষ্ঠীকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে। ১৯৪৫ সালে ওই ট্রাইব্যুনালে বিচার কাজ শুরু হওয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষ ২২ ব্যক্তি এবং সাতটি সংগঠন ও গোষ্ঠীর বিচার করে। এদিকে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কয়েকটি রায়ের পর্যবেক্ষণে সংগঠন হিসেবে জামায়াতের অপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত করে খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। জামায়াতকে রাজনৈতিক দল নয়, ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় দলের কৃত অপরাধের বিচার করা হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নাৎসি বাহিনীর যেভাবে সাজা দেয়া হয়েছিল সে প্রক্রিয়াটি খুঁজে দেখছে আইন মন্ত্রণালয়। সেটিকে মডেল ধরেই আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
×