ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মণ্ডপ ঘিরে উচ্ছলতা

পূজা, পূজা- দেখা অসাম্প্রদায়িক চেতনার উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৯ অক্টোবর ২০১৬

পূজা, পূজা- দেখা অসাম্প্রদায়িক চেতনার উৎসব

মোরসালিন মিজান ॥ ঢাকার বিকেল খুব চেনা। সন্ধ্যাটাও অচেনা নয় কারও। কিন্তু এখন যে পূজার সময়! শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে বদলে গেছে দৃশ্যপট। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শুরুটাই করছেন বিকেল কিংবা সন্ধ্যায়। এ সময় সকলেই নতুন পোশাকে সেজে বের হচ্ছেন। তারপর মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমা দেখা। বরাবরের মতো এবারও রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে মণ্ডপ নির্মাণ করা হয়েছে। ম-পের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল বিশাল তোরণ দৃশ্যমান হচ্ছে মূল সড়ক থেকে। যথারীতি করা হয়েছে আলোকসজ্জা। সন্ধ্যা হতে না হতেই একসঙ্গে জ্বলে উঠছে অসংখ্য মরিচবাতি। ঢাকের শব্দ কানে আসছে। মাঙ্গলিক ধ্বনি তুলছে শঙ্খ। সব মিলিয়ে দারুণ উৎসবের আমেজ। গভীর রাত পর্যন্ত চলা উৎসবে অন্য ধর্মের মানুষও যোগ দিচ্ছেন। সকলের অংশগ্রহণ অসাম্প্রদায়িক বাঙালী চেতনার জয় ঘোষণা করছে। এবার ঢাকা মহানগরে ২৩০টি ম-পে শারদীয় দুর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। সন্ধ্যা হতেই এসব মন্দিরের দিকে স্রোতের মতো ছুটছে মানুষ। বিভিন্ন বয়সী মানুষের পদচারণায় জেগে উঠছে রাত। শুক্রবার ছিল ষষ্ঠী। এদিন থেকে আনুষ্ঠানিক শুরু হয় দুর্গোৎসবের। শনিবার সপ্তমীর দিনে ম-পগুলোতে ভিড় বেড়ে কয়েকগুণ হয়ে যায়। প্রতিটি ম-পের ভেতরে পূজা। বাইরে উৎসব। রাজধানীর অনেক পুরনো ঐতিহ্য ঢাকেশ্বরী মন্দির। এখানে প্রতি বছরের মতোই উপচেপড়া ভিড়। মানুষ আর মানুষ। উৎসব ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের এলাকায়ও। ফুটপাথে বেশ কয়েকটি স্থায়ী দোকান। ওসব দোকানে মাঙ্গলিক সামগ্রীর পসরা। ঐতিহ্যবাহী কাঁসা-পিতল শিল্পের নিদর্শন। নাড়িকেলের নাড়ু, মোয়া, বাতাসার মতো বাঙালী ঐতিহ্যের খাবার সাজিয়ে রেখেছেন অস্থায়ী দোকানিরা। পিন্টু ও সুপর্ণা দম্পতি নাড়ু কিনে ফিরছিলেন। তারা বললেন, এসব খাবারের কোনটির সঙ্গেই পূজার সরাসরি কোন সম্পর্ক নেই। বাঙালীর যে কোন উৎসবেই এসব খাবার থাকে। পহেলা বৈশাখের দিন দেখামাত্রই কিনি। আজ শারদীয় উৎসবের দিনেও কিনলাম। ম-পকেন্দ্রিক উৎসবের বর্ণাঢ্য চেহারাটি বিশেষভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে বনানীতে। অভিজাত এলাকার মাঠে এবারও নান্দনিক সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দিয়ে ম-প নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণশৈলী দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। আয়োজকরা মডেল হিসেবে এবার বেছে নিয়েছেন কান্তজীর মন্দিরকে। দিনাজপুরে অবস্থিত মন্দিরটি একই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন। তৎকালীন দিনাজপুরের মহারাজা জমিদার প্রাণনাথ রায় তার শেষ বয়সে মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী পোষ্যপুত্র মহারাজা রামনাথ রায় ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে শেষ করেন নির্মাণকাজ। ১৮ শতকে নির্মিত মন্দিরের আদলেই নির্মাণ করা হয়েছে বনানীর পূজাম-প। মূল কাঠামোটি কান্তজীর মন্দিরের মতোই বর্গাকার। ঐতিহ্যবাহী মন্দিরের বাইরের অংশ টেরাকোটায় করা। অজস্র পোড়ামাটির ফলক বসানো। প্রতিটি ফলকে স্বতন্ত্র নক্সা। কত কত রকমের কাজ! বনানীর ম-পের দেয়াল নির্মাণের বেলায় অভিন্ন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। কান্তজীর মন্দির থেকে ফর্ম খুঁজে নিয়ে কাজ করেছেন শিল্পীরা। অপরূপ সৌন্দর্যের মন্দির দেখতে ভিড় করেছেন রাজধানীবাসী। মন্দিরের নক্সা করা দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার ছবি তোলা হচ্ছে। এখানেও আছে আলাদা মঞ্চ। মঞ্চ থেকে খ্যাতিমান শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করছেন। গানের সঙ্গে দুলছে বিভিন্ন বয়সী মানুষ। দেখে মনেই হয় না, কোন একটি ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের উৎসব। শনিবার রাতে কান্তজীর মন্দিরের আদলে গড়া ম-প দেখতে এসেছিলেন আরিফুর রহমান। পরিবারের তিন সদস্য নিয়ে এসেছিলেন। তিনি বললেন, এত সুন্দর একটি স্থাপনা। আমি মূলত এ স্থাপনাটা ছেলেমেয়েদের দেখাতে নিয়ে এসেছি। এখন ওরা গান শুনেও মুগ্ধ। একইরকম উৎসবের আমেজ কলাবাগান মাঠে। এখানে বিশাল মাঠের মাঝখানে ম-প তৈরি করা হয়েছে। বিরাট অবকাঠামো। পুরোটাই আলোকসজ্জা। এ আলোকসজ্জা মিরপুর রোড পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। ফলে অনেক দূর থেকে উৎসবের রং চোখে পড়ে। একই সময় কানে আসতে থাকে জনপ্রিয় সঙ্গীত। এরপর আর বসে থাকা যায়? অনেকেই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছেন। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে প্রবেশ করছেন প্যান্ডেলে। খোলা জায়গা নেহাত কম নয়। এরপরও গায়ে গা লেগে যায়। এত মানুষ! যে যার মতো করে দেখছেন। ঘুরছেন। চলছে আড্ডা। মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ছবি তোলা থেমে নেই। পাশেই আবার লোক ঐতিহ্যের মেলা বসেছে। অল্প স্টল। তবু জমজমাট কেনাকাটা। বিশেষ করে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পছন্দের সুতোটি পেলেও, কৌতুহল নিয়ে দেখছে। কিনছে। চন্দ্রা নামের এক কিশোরী বেলুন হাতে ছুটছিল। তার এক হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিল বাবা প্রদীপ কান্তি। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, উৎসবটা আসলে ম-পকেন্দ্রিক। এখানে আমরা বড়রা মা দুর্গার আশীর্বাদ চাই। ছোটরা হৈ হুল্লোড় করে কাটায়। তাছাড়া এখানে আয়োজনের তো শেষ নেই। বাচ্চারা খুব মজা করে। আসিফ মুরাদ নিশান তিন বন্ধু। কারও পূজা নেই। তবু ভিড় ঠেলে এসেছেন। কেন? জানতে চাইলে আসিফ বলেন, উৎসব তো সবার আসলে। সব সময় আসি। আর ম-পের পাশে জনপ্রিয় শিল্পীরা গান করছেন। শুনতে চলে আসলাম। ফার্মগেটের কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট চত্বরেও অস্থায়ী ম-প নির্মাণ করা হয়েছে। খামারবাড়ি গোলচত্বর থেকে শুরু হয়েছে আলোকসজ্জা। বিভিন্ন রঙের আলো অনুসরণ করে এগিয়ে গেলেই মূল ফটক। ভেতরের অংশ পোড়ামাটির ফলক দিয়ে সাজানো। দেবী দুর্গার প্রতিমার পেছনে আবার রাজবাড়ীর মডেল। এখানেও হস্ত ও কুটির শিল্পের নানান নিদর্শন নিয়ে বসেছেন হকাররা। চলছে কেনাকাটা। এভাবে গোটা শহরেই চলছে উৎসব। বর্ণাঢ্য উৎসবে মুখর রাজধানী ঢাকা। ধর্মীয় আচার পালনের পাশাপাশি বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্ফুরণ দেখে সত্যি আশাবাদী হতে হয়।
×