ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ শেখ হাসিনা ডিজিটাল স্বর্ণকন্যা

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ৯ অক্টোবর ২০১৬

একুশ শতক ॥ শেখ হাসিনা ডিজিটাল স্বর্ণকন্যা

॥ তিন ॥ শেখ হাসিনা তার নির্বাচনী প্রচারণা টিমের সঙ্গে আমাদের কম্পিউটার টিমটিকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। আমাদের টিম সেখানে শেখ হাসিনার জনসভার ছবি স্ক্যান করে মডেমের মাধ্যমে ঢাকায় পাঠিয়ে দিত। আমরা আবাসের মাধ্যমে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের সব পত্রিকায় ডিজিটাল ও এনালগ পদ্ধতিতে ছবি পৌঁছে দিতাম। বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের ডিজিটাল রূপান্তরে এটি দ্বিতীয় বড় ঘটনা। প্রথম ঘটনাটি ছিল কম্পিউটার দিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করা। কিন্তু ’৯৬ সালের নির্বাচনে আমরা ডিজিটাল সংবাদ সংস্থার সক্ষমতা দেখাতে পারলাম। শেখ হাসিনা দারুণভাবে উৎসাহিত হলেন এবং নির্বাচনের পর দেশকে ডিজিটাল করার জন্য আর কি কি করা যায় সেটি নিয়ে ভাবতে বললেন। আমার জন্য এটি এক স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন মনে হয়েছিল। প্রথমত, শেখ হাসিনা নিজে বাংলা টাইপ করে দলের জন্য কাজ করবেন সেটি আমাকে মুগ্ধ করেছিল। দ্বিতীয়ত, তিনি তার রাজনৈতিক কর্মকা-কে ডিজিটাল করবেন সেটিও বিশাল অর্জন ছিল। সেই ’৮৭ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করতে করতে ’৯৬ সালের নির্বাচনে যখন জননেত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলেন তখন তার আত্মবিশ্বাসও অনেকটাই বেড়ে যায়। তিনি তার প্রথম সরকার গঠনের পরই সবার ওপরে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে গুরুত্ব প্রদান করেন। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করতে পারি যে, আমাদের ডিজিটাল প্রচারণায় শেখ হাসিনা কেবল সন্তোষ প্রকাশ করেননি, ’৯৭ সালে একদিন প্রধানমন্ত্রীর অফিসে আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে জানতে চাইলেন দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের জন্য তার সরকার কি পদক্ষেপ নিতে পারে। আমি তখন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি। ’৯৬ সালে বিসিএস কম্পিউটার শোতে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী জিল্লুর রহমান এসেছিলেন। আমরা তার কাছে কম্পিউটারকে শুল্কমুক্ত করাসহ মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং অন্যান্য করণীয় নিয়ে দাবি পেশ করি। জিল্লুর রহমান সাহেব আমাদের সকল দাবি মেনে নেবার কথা বলেছিলেন। তখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন শাহ এএমএস কিবরিয়া। সেদিন শেখ হাসিনার সঙ্গে যখন কথা বলি তখন কিবরিয়া সাহেবও ছিলেন। নেত্রী তাকে আগেই বসিয়ে রেখেছিলেন। আমি নেত্রীকে অনুরোধ করলাম কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট তুলে নেবার জন্য। তিনি আমার কথা শুনেই কিবরিয়া সাহেবের দিকে তাকালেন। কিবরিয়া সাহেব বললেন, আমাদের রাজস্ব আদায় অনেক কমে যাবে। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, দেখুন অর্থমন্ত্রী তার দিকটাই দেখছেন। আমি নেত্রীকে বললাম, নেত্রী আপনি রাজস্ব দেখবেন, না দেশের ভবিষ্যত দেখবেন? আজ যদি কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট তুলে নেন তবে দেশ সামনে যাবে, আমরা আমাদের ভবিষ্যত ভাল করব। তিনি কিবরিয়া সাহেবকে শুল্ক ও ভ্যাট তুলে নেবার নির্দেশনা দেন। শেখ হাসিনার পরিবার থেকেও ইতোমধ্যেই কম্পিউটারের ওপর হতে শুল্ক ও ভ্যাট তোলার প্রস্তাব আসে। সেই থেকেই বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি প্রবেশ করে এক নতুন যুগে। আজ যারা বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের কথা বলেন তাদের ন্যূনতম কর্তব্য হচ্ছে একটু পেছনে ফিরে তাকানো। একটু স্মরণ করিয়ে দিতে পারি যে, ’৯৭ সালের শেষ দিকে আমরা বিসিএসের পক্ষ থেকে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সেমিনার করি, যাতে মন্ত্রীবর্গ শুল্ক ও ভ্যাটহীন কম্পিউটারের অঙ্গীকার করেন। ৪ জানুয়ারি ’৯৮ দেশের সফটওয়্যারের ওপর থেকে শুল্ক তুলে নেয়া হয় ও ’৯৭-’৯৮ সালের বাজেটে কম্পিউটারের হার্ডওয়্যারের ওপর থেকেও শুল্ক ও ভ্যাট তুলে নেয়া হয়। ২০০১ সাল পর্যন্ত আমার নিজের জন্য একটি অসাধারণ সময় ছিল এজন্য যে, শেখ হাসিনা তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের সকল প্রস্তাবনাকে কেবল গুরুত্বই দিতেন না, বাস্তবায়নে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতেন। প্রথম দু’বছর আমি বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি ছিলাম বলে তার অসাধারণ সমর্থনও আমি সেই সময়ে পেয়েছি। এই ছোট নিবন্ধে তার পাঁচ বছরের বিস্তারিত বিষয়াদি তুলে ধরা সহজ নয়। আমি কেবল তার তিনটি বড় কাজের কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই। ১. প্রথমত তিনি সেই সময়ে কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করেন। এই একটি কাজের জন্য বাংলাদেশের মানুষের হাতে হাতে কম্পিউটার আসার সুযোগ তৈরি হয়। দেশের রাজস্ব আয়ের চাইতেও সাধারণ মানুষের হাতে কম্পিউটার পৌঁছানো যে অনেক বেশি প্রয়োজনীয় সেটি তিনি এককভাবে অনুভব করেন। সেই সময়েই তিনি বিদেশে সফটওয়্যার রফতানি করার উপায় উদ্ভাবন করার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করেন, যারা ৪৫টি সুপারিশ পেশ করে এবং তিনি ২০০১ সালের আগেই সেই সুপারিশসমূহের ২৮টি বাস্তবায়ন করেন। সেই সময়েই তিনি কম্পিউটার শিক্ষার দিগন্তটি উন্মোচন করেন ও সরকারী-বেসরকারী সকল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার শিক্ষার অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ সিট বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ২. দ্বিতীয়ত তিনি মোবাইলের মনোপলি ভাঙ্গেন এবং দেশের মোবাইল বিপ্লবের ভিত রচনা করেন। সেই সময়ে মুর্শেদ খানের সিটি সেল ফোনের দাম ছিল সোয়া লাখ টাকা আর আউটগোয়িং কল ১৪ ও ইনকামিং কল ১২ টাকা ছিল। ৩. তিনি সেই সময়েই অনলাইন ইন্টারনেটের বিষয়টিকেও স্থায়ী করেন। যারা মনে করেন যে, তিনি ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করেছেন তারা তার সেই সময়ের কাজের কোন খবরই রাখেন না। বস্তুত, আমি দেখি যে, নিজের হাতে কম্পিউটার দিয়ে কাজ করা থেকেই তিনি একটি ডিজিটাল দেশের স্বপ্ন দেখেন। তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার জন্য তার সন্তানের কথা বলেন। বস্তুত, তার চাইতে ডিজিটাল ধারণা সম্ভবত বাংলাদেশের ডিজিটাল শিক্ষকদেরও নেই। এখনও তিনি যে অসাধারণভাবে দেশের ডিজিটাল রূপান্তরকে সামনে নিয়ে যেতে সচেষ্ট আছেন তাতে তার তুলনা তিনি একাই। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ে আমাদের মতো স্বাধীনতার পক্ষের মানুষের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক সময় হয়ে দাঁড়ায়। সবারই জানা যে, ২০০১-এর নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগকে সরকারী দলের নির্যাতন থেকে বেঁচে থাকার লড়াইটাই আগে করতে হয়েছে। আমি নিশ্চিত দলটি আওয়ামী লীগ না হলে বা শেখ হাসিনা তার নেতৃত্ব না দিলে সেই সময় আওয়ামী লীগ টিকেই থাকতে পারত না। ২০০৫ সালের দিকে নেত্রী আমাকে আওয়ামী লীগের মিডিয়া টিম সমন্বয় করার দায়িত্ব দেন এবং লুৎফুজ্জামান বাবরের বিরুদ্ধে নির্বাচন করার জন্য বলেন। আমি মিডিয়া টিম সমন্বয় করতে রাজি হলেও নির্বাচন করতে রাজি হইনি। সেই সময়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার লেখার কাজ চলতে থাকে। মুহিত ভাই এই কাজের নেতৃত্ব দেন। তবে মূল কাজটা হতো নূহ-উল আলম লেনিনের হাতে। সমন্বয়টা তিনি করতেন এবং নেত্রীর কাছে ইশতেহার উপস্থাপন করতেন। আমার ওপর তথ্যপ্রযুক্তি অংশটা লেখার ভার পড়ে। আমরা ২০০৬ সালের নির্বাচনের জন্য ইশতেহার লিখি। ২০০৭ সালে আমি ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা নিয়ে লেখালেখি করতে শুরু করি। ২০০৮ সালে যখন নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় হয় তখন ৬ ডিসেম্বর ২০০৮ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার শেষবারের মতো সম্পাদনা করা হয়, যেদিন রূপকল্প ২০২১-এর আওতায় আমি ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা লিখি। সবাই জানেন নেত্রী ১২ ডিসেম্বর ২০০৮ সেই ইশতেহার ঘোষণা করেন এবং সাড়ে ৭ বছর ধরে দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার অসামান্য নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। তার এই নেতৃত্ব কেবল আমাদের দেশের জন্য নয়, দুনিয়ার উন্নত দেশগুলোর জন্যও অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। এজন্যই বারাক ওবামা কেনিয়াকে এবং নরেন্দ্র মোদি ভারতকে বাংলাদেশ থেকে ডিজিটাল রূপান্তর শেখার আহ্বান জানিয়েছেন। একই কারণে মালদ্বীপ আমাদের সঙ্গে চুক্তি করেছে এবং আমরা এখন নেপাল ও ভুটানের ডিজিটাল রূপান্তরের কাজ করে দিচ্ছি। আমি মনে করি শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করে জাতির পিতার নেতৃত্বে গড়ে তোলা দেশটাকে শত বছর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আমরা যদি গত সাড়ে সাত বছরে তার সফলতার সকল দিকে না-ও তাকাই তবুও কেবল তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ তথা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য তিনি বাংলার স্বর্ণকন্যা। আমরা তাকে ডিজিটাল কন্যাও বলতে পারি। স্বর্ণকন্যা বাংলাদেশে এখন নারীদের অবস্থান কতটা বদলেছে সেটি আমরা সবাই জানি। দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার ও বিরোধীদলীয় নেত্রীই কেবল নারী নন, প্রধান একটি দলের নেত্রীও নারী। নারীরা এখন মোট শিক্ষার্থীদের শতকরা ৫৩ ভাগ। এই তথ্যগুলো বাংলাদেশের নারীদের পরিবর্তনের কথাই তুলে ধরে। অন্যদিকে মুসলিমপ্রধান পাকিস্তানসহ দুনিয়ার অন্য দেশগুলোতে নারীদের শিক্ষা গ্রহণ করাই অপরাধ। বাংলাদেশের এই নারীদের মাঝে বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, নূরজাহান বেগম বা জাহানারা ইমামদের নাম আমরা স্মরণ করি। কিন্তু এই দেশে একজন মাত্র নারী জন্মেছেন যাকে আমি স্বর্ণকন্যা বলছি। আমি এটা বুঝি যে, কোন একটি কারণেই একজন মানুষকে এমন একটি অভিধা দেয়া যায় না। আমি শেখ হাসিনার সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা করেই বলছি যে, তিনি আমাদের স্বর্ণকন্যা। নারী বলে তাকে কন্যা বলছি। তিনি বস্তুত স্বর্ণমানব। আমি তার সব বিষয়কে এই নিবন্ধে তুলে ধরতে পারব না। বস্তুত, তথ্যপ্রযুক্তি আমার বিষয় বলে শুধু এই বিষয়েই তার অসাধারণ ও অতুলনীয় ভূমিকাটি তুলে ধরতে চাই। এর আগে আমি উল্লেখ করেছি, শেখ হাসিনা হচ্ছেন দেশের প্রথম রাজনৈতিক দলীয় প্রধান যিনি তার দলকে তথ্যপ্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ করেন। তিনি সেই কাজটি করেন আশির দশকে। এরপর তিনি ইতিহাস গড়েন নির্বাচন পদ্ধতিতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তিনি প্রথম তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেন। সেই সময়ে তিনি তার নির্বাচনী প্রচারণা দলে একটি কম্পিউটার, একটি স্ক্যানার ও একটি মডেম সঙ্গে নিতেন এবং সেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জনসভার ছবি ও খবর সারা বিশ্বকে ছড়িয়ে দিলেন। এরপর তিনি ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করেন এবং মাত্র ৫ বছরে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির ইতিহাসটিকে আমূল পাল্টে দেন। ঢাকা, ২৪ সেপ্টেম্বর , ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ [email protected] w.bijoyekushe.net, ww w.bijoydigital.com
×