ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চৌধুরী শহীদ কাদের

বাগেরহাট ॥ দেশের সর্ববৃহৎ পূজামণ্ডপ

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ৯ অক্টোবর ২০১৬

বাগেরহাট ॥ দেশের সর্ববৃহৎ পূজামণ্ডপ

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয় দুর্গোৎসবকে সামনে রেখে দেশের সর্ববৃহৎ দুর্গাপূজা ম-প এবার তৈরি হয়েছে বাগেরহাটে। বাগেরহাট সদর উপজেলার হাকিমপুর শিকদার বাড়িতে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সর্ববৃহৎ এই পূজাম-পে থাকছে ৬০১টি দেব-দেবীর প্রতিমা। এর আয়োজক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী লিটন শিকদার। এটিকে দেশের সর্ববৃহৎ তো বটেই এমনকি বিশ্বের সর্ববৃহৎ শারদীয় পূজাম-প হিসেবে দাবি করা হচ্ছে। মূলত বাগেরহাটের এই শিকদার বাড়ির পূজাম-প গত বেশ কয়েক বছর ধরেই শারদীয় উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। গত বছরও ৪৫১টি প্রতিমা দিয়ে সাজানো হয়েছিল শারদ উৎসব। দেশ-বিদেশ থেকে এসেছিল কয়েক লাখ দর্শনার্থী। এরই ধারাবাহিকতায় এবারের আয়োজন আরও বৃহৎ। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, পার্শ্ববর্তী ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসছেন উৎসুক দর্শনার্থীরা। এবার বাগেরহাটের সিকদার বাড়ির সর্ববৃহত্তম পূজাম-পের সব থেকে বড় আকর্ষণ হলো কৈলাশ পর্বতের কাহিনীর অংশবিশেষ নিয়ে পুকুরের মধ্যে নির্মিত প্রতিমাগুলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ভাস্কর দিব্যতনু দাসের নেতৃত্বে ১০ জন ভাস্কর পুকুরের মাঝখানে ৪০ ফুট উঁচু কৈলাশ পর্বতের মাঝখানে প্রতিমাগুলো স্থাপন করেছেন। যেখানে সবার ওপরে রয়েছে ধ্যানরত মহাদেব। এরপর রাম, লক্ষণ, সীতা ও হনুমান। মহাদেব ও রামের হাত আশীর্বাদ করা অবস্থায় রয়েছে। যা দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন পূজার্থী ও দর্শনার্থীরা। দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে বৈশাখ মাসের শুরু থেকেই শুরু হয়েছিল কর্মযজ্ঞ। প্রায় পাঁচ মাস ধরে খুলনার কয়রা উপজেলার প্রতিমা শিল্পী বিজয় কৃষ্ণ বাছাড়ের নেতৃত্বে ১৬ জন প্রতিমা শিল্পী দিন-রাত এখানে কাজ করেছেন। বাঁশ ও খড়কুটোর ওপর মাটির প্রলেপ দিয়ে ভাস্কর ও মৃৎশিল্পীরা এখানে তুলে ধরেছেন রামায়ণ মহাভারতের বিভিন্ন আখ্যান। নিপুণ হাতের ছোঁয়া আর রং-তুলিতে অপরূপ সাজে প্রতিমা সাজিয়েছেন। এসব প্রতিমা কখনও যুদ্ধংদেহি, আবার কখনও শান্তির প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দুর্গার সৃষ্টি, সমুদ্র মন্থন, রামচন্দ্রের অকালবোধন, কুরুক্ষেত্রের মাঠে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে ভীষ্মদেবের যুদ্ধ, রাম-রাবণের যুদ্ধ, মহামায়ার দৈব বাণী, ক্ষীরোদ সাগরে নারায়ণ অনন্ত শয্যায় শায়িত, জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা, কৃষ্ণের রাসলীলা, পাগলা হাতি বধ, নৌকা বিলাস প্রভৃতি বিষয় প্রতিমার মাধ্যমে অনবদ্যভাবে তুলে ধরা হয়েছে। পূজাম-পে স্থান পেয়েছে আলবার্ট আইনস্টাইন, সুকান্ত কিংবা জসীম উদদীনের মতো ব্যক্তিত্বের মূর্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের কিছু ছাত্র করেছে অসাধারণ সাজ-সজ্জার কাজ। পাশাপাশি রয়েছে আলোকসজ্জা। শারদীয় উৎসবকে ঘিরে আশপাশে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসেছে গ্রামীণ মেলা, সাজানো হয়েছে আশপাশের এলাকা। খুলনা শহর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে মংলা-ঢাকা মহাসড়কের পাশে বাগেরহাট সদর উপজেলার এই শিকদার বাড়ির শারদীয় আয়োজন উৎসবের রঙে রঙিন করেছে দক্ষিণাঞ্চলের জীবন। হয়েছে এটা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অপূর্ব মিলন ক্ষেত্রও। পূজাম-পে যারা স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছে তাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অবাক হলাম। অধিকাংশই মুসলিম। আরও অবাক হলাম যখন জানলাম ৬৫ সদস্যের স্বেচ্ছাসেবক দলের মধ্যে ৬০ জন মুসলিম, দলের সভাপতি শেখ আকতারুজ্জামান টুকু। ধর্ম যার যার উৎসব সবার এই সেøøাগানকে অন্তরে ধারণ করে প্রায় ৬০ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত হাকিমপুরে সত্যিকার এক অসাম্প্রদায়িক প্রাণের শারদ উৎসব। পূজাম-পে কথা হচ্ছিল সাতক্ষীরা থেকে আগত সন্তোষের সঙ্গে, ‘গত বছর নবমীর দিন এসেছিলাম ভিড়ের কারণে ভালভাবে দেখতে পারিনি। তাই এবার আগেভাগেই চলে আসলাম।’ ভারতের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী রাজ্য থেকে আগত বিপুলসংখ্যক পূজারীর উপস্থিতি আলাদা আমেজ এনেছে শারদীয় উৎসবে। এ ছাড়া আশপাশের জেলাগুলো ছাড়াও চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী থেকেও বিপুল দর্শনার্থী এখানে আসেন বলে জানান শিকদার বাড়ি দুর্গাপূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি ডাঃ দুলাল শিকদার। তিনি বলেন, এই পূজার ফলে সাধারণের মনে ধর্ম সম্পর্কে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। রামায়ণ মহাভারতের পৌরাণিক কাহিনী তাদের উদ্দীপ্ত করে। পূজাম-প দেখতে গিয়ে সাক্ষাত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, পত্রিকায় পড়ে সস্ত্রীক দেশের সর্ববৃহৎ এই শারদ উৎসব তিনি দেখতে এসেছেন। বলছিলেন, প্রমাণ সাইজের নানা প্রতিমার সাহায্যে মহাভারত রামায়ণের যে আখ্যানগুলো তুলে ধরা হয়েছে তা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। তিনি এই উৎসবকে ঘিরে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে যে সম্প্রীতির মেলবন্ধন রচিত হয়েছে সেটাকে খুব ইতিবাচক উল্লেখ করলেন। বললেন, এটাই সত্যিকারের শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চিত্র। [email protected]
×