ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বামী অবিচলানন্দ

দুর্গাপূজা ও অকাল বোধন

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ৯ অক্টোবর ২০১৬

দুর্গাপূজা ও অকাল বোধন

বোধন অর্থাৎ জাগরণ। অকাল বোধন মানে অকালে জাগরণ। অকালে বোধিতা দেবী- দুর্গাপূজার মন্ত্রে আছে, ‘রাবণস্য বিনাশায় রামস্যানুগ্রহায় চ অকালে বোধিতা দেবী।’ অর্থাৎ, রাবণকে নাশ করার জন্য শ্রীরামচন্দ্রকে অনুগ্রহ করার জন্য অকালে দেবীকে জাগরিত করা হয়েছিল। দুর্গাপূজায়- ‘ব্রাহ্মমুহূর্তে, সম্পন্ন অধিবাসে বোধন হয় মা দুর্গার, শঙ্খে শঙ্খে সমাদরে। যেহেতু শরতে দেবতারা নিদ্রিত থাকেন, তাই তাদের জাগিয়ে পূজাপার্বণ করা শাস্ত্রীয় নিয়ম। শারদীয়া দুর্গাপূজায় অর্থাৎ আশ্বিনের দুর্গাপূজায় ‘বোধন’ পূজার একটি বিশেষ অনুষ্ঠান। কারণ শরতকাল দেবতাদের রাত্রিকাল। দেবীকে অসময়ে জাগিয়ে পূজা করতে হয়েছিল বলে এ বোধনকে অকাল বোধন বলা হয়। শ্রীশ্রী চণ্ডীগ্রন্থে আমরা দেখতে পাই মেধস ঋষির নির্দেশে রাজ্যভ্রষ্ট রাজা সুরথ ও স্বজন পরিত্যক্ত সমাধিবৈশ্য বসন্তকালে চৈত্র মাসে দেবীর পূজা করেছিলেন। এ সময়ের দুর্গাপূজায় ‘বোধন’ করতে হয় না। দক্ষিণায়ন দেবতাদের রাত্রি এবং উত্তরায়ণ দিন। শ্রাবণ থেকে পৌষ এ ছ’মাস দক্ষিণায়ন; এ সময় দেবতাগণ নিদ্রিত থাকেন। মাঘ থেকে আষাঢ় ছ’মাস উত্তরায়ণ; এ সময় দেবতারা জাগ্রত। শরত ঋতু দক্ষিণায়নে পড়ে, তখন ভগবতী নিদ্রিতা, এজন্য শারদীয়া দুর্গাপূজায় দেবীর জাগরণের জন্য বোধন করতে হয়। বসন্ত ঋতু উত্তরায়ণ, তখন দেবতাগণের দিন, এজন্য বাসন্তী পূজায় বোধন করতে হয় না। শরতকালের পূজা অকাল পূজা, বসন্তকালের পূজা কালবোধিত পূজা। শরতকালে দেবীর আবির্ভাব। কালিকাপুরাণে আছে, মহিষাসুর বধের জন্য দেবগণ স্তব করাতে ভগবতী শরতকালে হিমালয়ে কাত্যায়ন মুনির আশ্রমে দশভুজা দুর্গারূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। আবার দেবী ভাগবতের মতে শরতকালে দেবীপূজার উৎপত্তি। কথিত আছে- ভগবান শ্রীরামচন্দ্র ১০৮ পদ্ম দ্বারা দেবীপূজার সঙ্কল্প করেন। আবশ্যকীয়-সংখ্যক পদ্ম সংগৃহীত হলো। দেবী ভক্তের ভক্তি পরীক্ষা করার জন্য ছলনা করলেন। তিনি একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখলেন। পূজার সময় একটি পদ্মের অভাব হওয়ায় শ্রীরামচন্দ্র বিপদে পড়লেন। পূজা পূর্ণাঙ্গ না হলে দেবী অসন্তুষ্ট হবেন, সঙ্কল্পও সিদ্ধ হবে না। শ্রীরামচন্দ্র পদ্মলোচন নামে অভিহিত। সেজন্য তিনি নিজের একটি চক্ষুু উৎপাটিত করে তা মায়ের শ্রীচরণে অঞ্জলি দেবেন- এরূপ সঙ্কল্প করলেন। তিনি ধনুর্বাণ হস্তে চক্ষু উৎপাটন করবার উপক্রম করতেই দেবী আবির্ভূত হয়ে তাঁকে অভীষ্ট বর প্রদান করলেন। আদ্যাশক্তি যদিও স্বরূপত : নামরূপাতীতা, তথাপি তিনিই মায়ারূপ মহিমাদ্বারা সমস্ত বস্তুরূপে সম্ভূতা হন। শাস্ত্রে রয়েছে- ত্বমেব সূক্ষ্মা স্থূলা ত্বং ব্যক্তাব্যক্তস্বরূপিণী। নিরাকারাপি সাকারা কস্ত¡াং বেদিতুমর্হতি ॥ অর্থাৎ, তুমিই আদ্যাশক্তি ভগবতী সূক্ষ্মা ও স্থূলা, ব্যক্ত ও অব্যক্ত স্বরূপিণী, নিরাকারা হয়েও সাকারা, তোমাকে কে জানতে পারে? কল্পনাময়ীর সঙ্কল্পশক্তি অমোঘ। কেননা কল্পনাময়ী চিন্ময়ী। সঙ্কল্প মাত্রই ইনি অনন্তকোটি বিশ্ব প্রসব করে থাকেন। অবাধ সৃষ্টি করাই তাঁর স্বভাব। ব্রহ্মযোনী সর্বযোনীর যোনী সর্বজীবের জননী তিনি। দুর্গাপূজা প্রধানত বাঙালী হিন্দুর পূজা। দুর্গাপূজা মায়ের পূজা। দেবী তাঁর স্বরূপ সম্পর্কে বলেন : আমার রূপ নাই এবং জন্মও নাই। মাতৃভাবে অনন্তের উপাসনা দুর্গাপূজা। মূর্তিপূজা ও প্রতীকোপাসনায় ব্রহ্মই উপাস্য, প্রতীক কেবল তার প্রতিনিধিস্বরূপ। উপাসনার প্রথম স্তরে এটা সাধকের পক্ষে অনিবার্যরূপে প্রয়োজনীয়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন : ব্রহ্ম ও ব্রহ্মশক্তি এক। যেমন আগুন আর দহন করার শক্তি এক, সেরকম। শাস্ত্রে পাই- ‘সাধকানাং হিতার্থায় ব্রহ্মণো রূপকল্পনা’- সাধকদের হিতের জন্য ব্রহ্মের নানা প্রকার রূপ পরিকল্পিত হয়। ফলত রূপ পরিকল্পনা তথা বাহ্যপূজার একটি দার্শনিক তত্ত্ব রয়েছে। উক্ত তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা বাহ্যপূজার প্রয়োজন, উপযোগিতা এবং ফল সম্বন্ধে সম্যক ধারণা লাভ করব। শাস্ত্রে রয়েছে- ‘যা দেবী সংবর্ভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা’ যে দেবী সর্বপ্রাণীতে মাতৃরূপে অবস্থিতা তাঁকে নমস্কার। প্রকৃতপক্ষে মানবের জীবন রথের প্রতীক মাত্র। ভোগের পথ ছেড়ে মুক্তির পথে যে গমন করতে চায় তার জীবন সুনিয়ন্ত্রিত হতে হবে, শান্ত হবে, সমাহিত হতে হবে। রথের রথী মানে অন্তর্যামী তিনি নির্লিপ্ত। তাঁর যথার্থ স্বরূপ এ নির্লিপ্ততা। সে স্বরূপকে এ দেহরথের মধ্যে উপলব্ধি করতে হবে। অতি সূক্ষ্ম সে অন্তরাত্মা পুরুষ মানুষের হৃদয়ে সর্বদা অবস্থান করেন। তিনিই রথী। এ দর্শন অর্থাৎ সাক্ষাৎকার হলেই মুক্তি। শরত ঋতুতে বসুন্ধরা ফলে-ফুলে, শস্য-শ্যামলিমায় সুশোভিত হয়ে ওঠে। শিউলি প্রভৃতি নানা ফুলের ঘ্রাণে ঘ্রাণে প্রকৃতি আজ নতুন সাজে সজ্জিত। বাঙালীও আজ নতুন সাজে সজ্জিত। দুর্গাপূজা বাঙালীর জাতীয় উৎসবে পরিগনিত। সদ্য প্রস্ফুটিত শিউলি ফুল তার আগামবার্তা জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। বাঙালীর প্রতিটি ঘর উৎসবে মুখরিত। হিমালয়ের মেয়ে যেন শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি আসছেন। সঙ্গে তার দুহিতা কন্যা ধনের দেবী লক্ষ্মী, বিদ্যার দেবী সরস্বতী, দুই পুত্র সিদ্ধিদাতা গণেশ আর দেবসেনাপতি কার্তিক। তাদের বাহনসহ দেবী আসছেন। মহাদেব তাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসছেন। বাঙালী চিরাচরিত প্রথায় মেয়েকে সাদর আমন্ত্রণে ঘরে তুলে নেয়, এরূপ ভাবনা। চণ্ডীগ্রন্থে আরও আছে, দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেই মায়ের নাম দুর্গা। এ অসুরের কাজ হলো জীবকে দুর্গতি দেয়া। সংসার পথে এ অসুরের নাম স্বার্থান্ধতা। আধ্যাত্মিক পথে এ অসুরের নাম অবিদ্যা। দুর্গম স্বার্থান্ধতায় পতিত হয়ে জীব অশেষ দুর্গতি ভোগ করে। লোককল্যাণ বুদ্ধি জাগ্রত করে মা দুর্গা রক্ষা করেন। দুর্গা শব্দের আর একটি অর্থ দুর্জ্ঞেয়া। মায়ের তত্ত্ব দুরধিগম্য। আমাদের জ্ঞানবুদ্ধির সামর্থ্য নেই তাঁকে জানা। তিনি কৃপা করে জানালে তবে জানতে পারি। সকল বস্তুতে যিনি মাতৃরূপে বিরাজিতা তিনিই বিশ্বজননী মা দুর্গা। মা এত বড় শক্তিশালিনী হয়েও স্নেহময়ী। বাঙালী ক্ষেত-খামারে যা ফলায়, বাঙালী যা পায় ও যা খায়, তা-ই সে নিবেদন করে তার উপাস্যকে। যে যুগে আমরা বাস করছি, দুর্ভাগ্যবশত তা স্বার্থপরতা, হিংসা, মিথ্যাচরণ ও সংঘর্ষে ক্রমাগত আন্দোলিত। সুস্থ চিন্তাশীল, হৃদয়বান মানুষ আজ সন্ত্রস্ত, সংক্ষুুব্ধ। এমতাবস্থায় ঘন মেঘের আঁধার ভেদ করে শারদ-সূর্যের প্রকাশের মতো আমাদের সংশয়দীর্ণ হৃদয়ে দিব্যোজ্জ্বল আত্মপ্রকাশ করছেন জগন্মাতা মহাশক্তি দেবী দুর্গা। তাঁর সে আগমনী বার্তা নিনাদিত হচ্ছে অনল অনিলে চির নভোনীলে। আমরা রোমাঞ্চিত হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পুষ্পাঞ্জলি লয়ে তাঁর শ্রীচরণ দর্শনের প্রত্যাশায় অপেক্ষমাণ। তাঁকে কেন্দ্র করে আমাদের অন্তরে আজ অপরিমেয় আনন্দ-অনুভূতির উদ্ভাস। আমরা দেবী দুর্গার শ্রীচরণে প্রার্থনা জানাচ্ছি, তিনি আমাদের অন্তরের আসুরিক শক্তিকে বিনাশ করে শুভ শক্তির উদ্বোধন করুন! আমরা যেন সাম্য, মৈত্রী, অহিংসা ও পরার্থপরতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে তাঁর সুসন্তানরূপে নিজেদের পরিচয় দিতে পারি। নিছক উৎসব-আড়ম্বরে মত্ত না হয়ে আমরা যেন আমাদের অন্তরে এ মহাশক্তির উদ্বোধনে নিয়ত ব্যাপৃত থাকতে পারি। সে সঙ্গে মায়ের কাছে আকুল আর্তি, সাম্প্রতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত মানুষ যেন পুনরায় সুস্থ-সুন্দর জীবনে ফিরে আসতে পারে, তাদের দুঃখে আমরাও যেন মর্মে মর্মে সমবেদনা অনুভব করি। শারদীয়ার এ পুণ্যলগ্নে সকল ভক্ত ও অনুরাগীকে আমাদের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি। লেখক : সন্ন্যাসী মহারাজ, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন, ঢাকা
×