ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপন কুমার সাহা

শারদীয় দুর্গোৎসব ধর্ম যার যার, উৎসব সবার

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ৯ অক্টোবর ২০১৬

শারদীয় দুর্গোৎসব ধর্ম যার যার, উৎসব সবার

দুর্গাপূজা ঐতিহাসিকভাবে বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। বিভিন্ন রাষ্ট্রের বাঙালী অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে শারদীয় দুর্গোৎসব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসবের আমেজে পাঁচ দিনব্যাপী সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে এক সুন্দর সম্প্রীতির পরিবেশের সৃষ্টি করে। সকলের কাছে আজ ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে শারদীয় দুর্গোৎসব। দুর্গাপূজার প্রধান আবেদন হলো ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’ অর্থাৎ সকল অশুভ শক্তির নির্মূল করার জন্যই পৃথিবীতে প্রতিবছর দুইবার দেবী দুর্গার আগমন ঘটে। প্রাচীনকাল থেকেই বছরের চৈত্র মাসে বসন্তকালে বাসন্তী নামে পৃথিবীতে মা দুর্গা আবির্ভূত হন যা হিন্দু সম্প্রদায়ে বাসন্তী পূজা হিসেবে পরিচিত। রাক্ষস রাজা রাবণ রামচন্দ্রকে যুদ্ধে পরাভূত করার জন্য কৌশল হিসেবে তার সহধর্মিণী সীতাকে অপহরণ করে লঙ্কায় নিয়ে যায়। রামচন্দ্র সীতাকে উদ্ধারের জন্য শরতকালে অকাল বোধনের মাধ্যমে মা দুর্গাকে আবাহন করেন। তখন থেকেই শরতকালে এই শারদীয় পূজার প্রচলন শুরু হয়। ভক্তরা মায়ের আরাধনা করেন সকলের প্রাণীর দুঃখ-দীনতা, অভাব-অনটন, সকল রোগ মুক্তি, অন্যায়-অবিচার, অত্যাচার দূর করে, মানুষের তথা দেশের সুখ, সমৃদ্ধি ও শান্তিময় জীবনের আশায়। শারদীয় উৎসবের উদ্দেশ্য একই, তবে বাসন্তী পূজার তুলনায় শারদীয় সার্বজনীনতা ও উৎসবের ব্যাপকতা অনেক বেশি। শরতের শিশিরভেজা শিউলি-শেফালী ফুলের গন্ধ, কাশফুলের শুভ্রতা, আকাশজুড়ে শরতের সাদা মেঘ সকলেই যেন মা দুর্গার আগমন বার্তা নিয়ে আসে ভক্তদের মধ্যে। তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় দেবীকে বরণ করে নেয়ার আয়োজন। ইতিহাসে কথিত আছে প্রায় দুই শ’ বছর আগে রাজশাহীর রাজা কংস নারায়ণ প্রথম শরতকালে দুর্গোৎসব শুরু করেছিলেন। অতীতে রাজা-জমিদাররাই এ পূজা করে থাকতেন। মাসব্যাপী এ উৎসবের আমেজ ওই অঞ্চলের সকল মানুষ উপভোগ করতেন। যেহেতু দুর্গাপূজা, উৎসবের আঙ্গিকে একটি ব্যয়বহুল পূজা, সেহেতু প্রথমে শুধু রাজা ও জমিদাররাই এই আয়োজন করে থাকতেন। দুর্গাপূজা পরবর্তী পর্যায়ে সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সার্বজনীন পূজা হিসেবে প্রচলিত হয়। আজ দুর্গাপূজার সার্বজনীনতা সকালের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত এবং জনপ্রিয়। তাই শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হওয়ার প্রায় দুই মাস আগে থেকে পূজার প্রস্তুতি চলে বিভিন্ন মন্দির, আশ্রম, সংগঠন, শহরে-বন্দরে, উপজেলা ও জেলা শহরে। বিশেষ করে বিভিন্ন সংগঠন মা দুর্গা তাঁর সন্তান লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক এবং স্বামী ভগবান মহেশ্বরকে সঙ্গে নিয়ে মর্ত্যে আগমন করেন। অসুর শক্তিকে নিধনের প্রতীকী মূর্তিতে আমরা মা দুর্গাকে মহিষাসুর বধ করার দৃশ্যে দেখতে পাই। কে কত সুন্দর ও আকর্ষণীয়ভাবে তা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এই নিয়ে বিভিন্ন পূজামণ্ডপের আয়োজকের মধ্যে শুরু হয় তুমুল প্রতিযোগিতা। প্রতিমার মৃৎশিল্পীদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা শুরু হয় কে, কত সুন্দর ও শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রতিমা নির্মাণ করে আয়োজকদের মধ্যে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারে। ধর্মীয়ভাবে প্রচলিত আছে যে, মা দুর্গা এ সময় তাঁর স্বামী সন্তানদের নিয়ে বাপের বাড়িতে আসেন, তাতে ব্যাপক আয়োজন হবে বৈকি! বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে পূজা বেড়েই চলছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে পূজার সংখ্যা ছিল চার থেকে পাঁচ হাজারের মতো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পূজার সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত বছর দেশব্যাপী প্রায় ঊনত্রিশ হাজার পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পূজার সংখ্যা বাড়ার প্রধান কারণ হলো স্বাধীনতায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মূল্যবোধগুলোর অন্যতম হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর স্বাধীনতার মূল্যবোধগুলোকে একে একে পবিত্র সংবিধান থেকে মুছে ফেলতে পরবর্তী সরকারগুলো নানাভাবে ষড়যন্ত্র করে অন্য চিন্তায় অর্থাৎ পাকিস্তানী ভাবধারায় দেশ পরিচালনা করা হয় দীর্ঘ একুশ বছর। ১৯৮৮ সালে তৎকালীন সরকারের আমলে সংবিধানে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম এবং অন্য ধর্মগুলোকে বিজাতীয়করণ করা হয়। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রাষ্ট্র পরিচালনার যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল সে সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণœ করা হয়। ১৯৯৩ সালে একশ্রেণীর দুষ্কৃতকারী ঐতিহাসিক জন্মাষ্টমীর বর্ণাঢ্য মিছিলে হামলা করে। এতে প্রায় ৩০ জনের মতো ভক্তবৃন্দ আহত হন, এদের মধ্যে ৪-৫ জন দৃষ্টিশক্তিও হারায়। এ হামলার প্রতিবাদে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের আহ্বানে দেশব্যাপী মায়ের প্রতিমা অবয়ব নির্মাণের বদলে ঘট পূজা করা হয়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, এ প্রতিবাদ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেমন আমেরিকা, লন্ডন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডায় ছড়িয়ে পড়ে এবং সেখানেও ঘট পূজার মাধ্যমে মায়ের আরাধনা করা হয়েছিল। বর্তমান সরকার ১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসার পর স্বাধীনতার অন্যতম মূল্যবোধ ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধারণ করে দেশ পরিচালনা করলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে পারল না। তারপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে বিজয়ী হওয়ার পর থেকে সাত বছর যাবত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার পরিচালনার মাধ্যমে স্বাধীনতার মূল্যবোধগুলোকে ধারণ করে দেশ পরিচালনায় এক যুগান্তকারী উন্নয়নের ভূমিকা রাখছে বলেই সকল ধর্মের মানুষ নির্বিঘেœ ও স্বাধীনভাবে যার যার ধর্ম পালন করে যাচ্ছে, আর তারই সঙ্গে বেড়ে চলছে পূজার সংখ্যা। আরেকটি বড় কারণ হলো ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র আমাদের সবার, এটাকে মূল ভিত্তি হিসেবে ধারণ করে আজ জনপ্রিয় সেøাগান হলোÑ ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’ এই সেøাগান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিশ্বাসের সঙ্গে বলেন বলেই আজ এ সেøাগান সর্বমহল এমনকি রাজনীতিবিদদের মধ্যেও জনপ্রিয়তা লাভ করছে। সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলেই শেখ হাসিনা ১৯৮২ সালে সর্ব প্রথম একটি বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে মহানগর সার্বজনীন পূজামণ্ডপ, পুরাতন ঢাকায় পূজামণ্ডপ ও ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনে পূজামণ্ডপ পরিদর্শন ও ভক্তবৃন্দের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে ধর্মে ধর্মে সম্প্রীতির এক নতুন দিকনির্দেশনা দেন। তখন থেকেই তিনি প্রধানমন্ত্রী অথবা বিরোধী দলের নেতা হিসেবে পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করে আসছেন। অতীতে এভাবে কোন প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বা রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে কেউ পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করেননি। উল্লেখ্য, এখন সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের সকল শ্রেণী পেশার লোকজন বাঙালী হিন্দু ঐতিহ্যের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজায় নানাভাবে সম্পৃক্ত হন এবং এর মধ্য দিয়ে ধর্মে ধর্মে, বর্ণে বর্ণে, গোত্রে গোত্রে ভাববিনিময়ের মাধ্যমে এক মহামিলন মেলার সৃষ্টি হয়। এতে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন আরও সুদৃঢ় হয়। বিভিন্ন রাষ্ট্রের বাঙালী অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে শারদীয় দুর্গোৎসবের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসবের আমেজে পাঁচ দিনব্যাপী সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে এক সুন্দর সম্প্রীতির পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আজ এ উৎসব সকল মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ভারতের পশ্চিম বঙ্গসহ অসম, ত্রিপুরা ও অন্যান্য বাঙালী হিন্দু অঞ্চলে দুর্গাপূজার আনন্দ-উদ্দীপনা, আকর্ষণ ও ব্যাপকতা দেশে-বিদেশে বিশেষভাবে আলোচিত এবং প্রশংসিত। তাছাড়া আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, নেপালসহ বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও এই শারদীয় দুর্গোৎসব বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবেই পালিত হচ্ছে। এবারের দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে দুর্গাপূজার উৎসবের আয়োজন সতর্কতার সঙ্গে নেয়া হয়েছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে নিয়োজিত পুলিশ, র‌্যাব ও অন্যান্য সংস্থার সকল সদস্য সতর্ক নজরদারিতে থাকবেন সকল পূজামণ্ডপগুলোতে, যাতে কেউ কোন ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে। আজ দেশের মধ্যে সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গীবাদ, সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে অরাজকতার পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গীবাদ প্রতিহত করে যাচ্ছে দক্ষতার সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গীবাদ- সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশের মাটি থেকে চিরতরে নির্মূল করার জন্য দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। তাই এবার উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে দুর্গাপূজার উৎসব নির্বিঘেœ পালনের উদ্দেশ্যে দেশের সকল পূজামণ্ডপে সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। মা দুর্গা দুর্গতিনাশিনী হিসেবে প্রতিবছর ভক্তবৃন্দের সামনে আবির্ভূত হন। তিনি দশভুজা হিসেবেও পরিচিত। তিনি দশ হাতে সকল অপশক্তি থেকে মানুষকে মুক্তি দেবেন এবং মানবকল্যাণে আমাদের সকল ধরনের অগ্রযাত্রা প্রতিষ্ঠা হবেÑ এই কামনা ও বাসনা নিয়েই এই বছর মাকে বরণ করে নেবে দেশের সকল ভক্ত। পঞ্জিকা মতে, এ বছর মা দুর্গা ঘোটকে চড়ে পৃথিবীতে আসবেন এবং ঘোটকে চড়েই স্বর্গলোকে ফিরে যাবেন। পন্ডিতগণের মতে, মা দুর্গার পৃথিবীতে ঘোটকে চড়ে আসা শুভ নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা। তাই মার কাছে সকল ভক্তের বিশেষ প্রার্থনাÑ সকল প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বিশ্ববাসীকে যেন রক্ষা করেন। মা দুর্গার চরণে আরও প্রার্থনা সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গীবাদ-সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করে বাংলাদেশ যেন ক্ষুধা, দ্রারিদ্যমুক্ত, সুখী, সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে পরিচিতি লাভ করে। ২০২১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যবিত্তের বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে স্থান করে নিয়ে ২০৪১ সালে যেন বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারেÑ তাহলেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়ন হবে। যত বাধা-বিপত্তি আসুক, মা দুর্গা অবশ্যই ভক্তদের প্রার্থনা শুনবেন। লেখক : সাংবাদিক ও ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক প্রেস মিনিস্টার
×