ইন্টারনেটের ইতিহাসে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ঘটে গেছে। মাত্র ক’দিন আগে প্রথম মোবাইল সংযোগের ৪০তম বার্ষিকী এবং বিশ্বব্যাপী ওয়েবের ২৫তম বার্ষিকী পার হয়ে গেল। এগুলো ছাড়াও জীবন কেমন ছিল তা হয়ত অনেকের মনে নেই। তবে এগুলো যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ক্রিয়াকলাপে মুহূর্তের মধ্যে সুগভীর ও সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তার পরও একটা কথা না বলে পারা যায় না। সেটা হচ্ছে এত কিছুর পরও ইন্টারনেট আমাদের সবার কাছে পৌঁছেনি। ইন্টারনেট বিপ্লব সম্পন্ন হতে এখনও অনেক বাকি। উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেকে এমনকি কিছু কিছু আমেরিকানের জীবনেও এখনও পর্যন্ত ইন্টারনেট আসেনি।
ওয়েব বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কের ধারণাটির প্রথম উৎপত্তি ঘটেছিল কয়েক দশক আগে মার্কিন সামরিক বাহিনীতে। অতি চরম ও দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিবেশে সামরিক এ্যাসেটগুলোর সঙ্গে নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ বজায় রাখার উপায় সন্ধান করতে গিয়ে এর উৎপত্তি ঘটে। কিন্তু পরিহাসের ব্যাপার হলো ৪০ বছর আগে মার্কিন সামরিক বাহিনী যোগাযোগ স্থাপনের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল তা তারা এখনও অর্জন করতে পারেনি। অথচ ভোক্তা সাধারণ ও ব্যবসায়ী মহলে এর অপ্রত্যাশিত প্রসার ঘটে গেছে। ২০১০ সাল থকে শুরু করে হাইস্পিড ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্ক, ফ্যাশন সচেতন নতুন স্মার্টফোন ও ট্যাবলেট এবং মোবাইল ব্যবহারের ক্রমবধমান জগত সবকিছু মিলিত হয়ে কম্পিউটিংয়ের ক্ষেত্রে এযাবতকালের সবচেয়ে নাটকীয় বিল্পব শুরু হয়েছে। সারাবিশ্বে প্রায় ৮শ’ কোটি মোবাইল ডিভাইস আজ ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত।
ইন্টারনেট যুগের শুরুতে বিল গেটস ও ল্যারি এলিসনের মতো ব্যক্তিরা এক সম্মেলনে কম্পিউটিংয়ের ভবিষ্যত নিয়ে নাটকীয় সব পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। তখন কম্পিউটিংয়ের যে অবস্থা ছিল তারই রকমফের রূপের প্রস্তাব করেছিলেন তারা। যেমন হায়ারার্কিকাল নেটওয়ার্ক, ক্লোজড সিস্টেম এবং প্রোপ্রাইটারি সফট্ওয়্যার। তাদের সব ভবিষ্যদ্বাণী ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। সেই সম্মেলনে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ গ্রাজুয়েট ছাত্র ইন্টারনেট নেভিগেশনের প্রাথমিক পর্যায়ের এক সফট্ওয়্যার প্রদর্শন করেন। সেটা ছিল মার্কিন সামরিক বাহিনীর উদ্ভাবিত নিম্নস্তরের নেটওয়ার্কিং স্ট্যান্ডার্ডের উন্নততর সংস্করণ এর দ্বারা সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট কম্পিউটারগুলোর মধ্যে যে কোন ধরনের তথ্য যে কত চমৎকারভাবে ও কম খরচে আদান প্রদান করা সম্ভব তা দেখে সেই সম্মেলনে উপস্থিত সুধীম-লী চমৎকৃত হয়ে গিয়েছিলেন।
ছাত্রটির নাম ছিল মার্ক এন্ডিসেন আর যার সফট্ওয়্যারটি ছিল মোজাইক ওয়েব ব্রাউজার। কয়েক বছরের মধ্যে মোজাইক ও তার পরবর্তী সফট্্ওয়্যারগুলো দ্রুত প্রসারমান ইন্টারনেট জগতের তথ্যের আদান প্রদানে বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়। এন্ডিসেনের ডেমোনেস্ট্রেশন দেখে কম্পিউটিংয়ের ভসিষ্যত সহসা গতিপথ বদলে ফেলে। প্রথমদিকে যে ইন্টারনেটের প্রাইভেট স্ট্যান্ডার্ডগুলোর তুলনায় একেবারেই কোন প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা ছিল না এবং একে বাণিজ্যিক নেটওয়ার্কে পরিণত করারও কোন অভিপ্রায় এর উদ্ভাবকদের ছিল না সেই ইন্টারনেট এখন সবকিছু গ্রাস করতে উদ্যত হয় স্রেফ এই কারণে যে এটা ব্যবহার না করার কোন কারণ নেই। গত ২৫ বছরে ইন্টারনেট ধীরে ধীরে কল্পনাযোগ্য এবং কল্পনাতীত প্রতিটি নেটওয়ার্ক ও প্রতিটি প্রযুক্তিকে গ্রাস করে নিয়েছে। একদা যা ছিল আলাদা আলাদা সেই রেডিও, টিভি ভয়েস এবং ড্যাটা সবই একই ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভার্চুয়াল পোস্টাল সার্ভিস যা বছরে সেক্সটিলিয়ন বাইট প্রদান করছে।
আজ শুধু আমেরিকায় বেসরকারী বিনিয়োগকারীরা ডিজিটাল অবকাটামো নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণে ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার ঢেলেছে। আগামীতে আরও বেশি অর্থ বিনিয়োগ করবে।
এতে তারযুক্ত ও তারবিহীন যোগাযোগের গতি প্রতি সেকেন্ডে মেগাবাইট থেকে বেড়ে গিগাবাইটে দাঁড়াবে। কম্পিউটিং ও যোগাযোগের খরচ যেমন কমবে তেমনি কমে আসবে কানেকটিভিটির সাইজ ও শক্তির চাহিদা। আরও ট্রিলিয়ন ডিভাইস ইন্টারনেটের ভাষায় কথা বলতে শুরু করবে।
তথাপি ইন্টারনেট বিপ্লব সম্পন্ন হতে এখনও বহু পথ বাকি। আমেরিকানদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত নয়। বিশ্বের বাকি অংশের এমন মানুষের সংখ্যা তো আরও বেশি। অনেকের ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ ও সামর্থ্য নেই। অনেকের আবার তা থাকলেও নিতে চায় না।
এরা মূলত বয়স্ক, গ্রামীণ ও কম শিক্ষিত, এরা বলে যে এদের অনলাইনে না যাবার প্রধান কারন হলো সেখানে তাদের জন্য কিছু নেই যদিও আমরা মোবাইল থেকে আর কম্পিউটার হোক কয়েক মিটিনের জন্যও স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারি না। এন্ডিসেনের সেই প্রদর্শনীটা ছিল ভবিষ্যতকে এক পলক উঁকি মেরে দেখা। সেই ভবিষ্যতের আগমন অব্যাহত আছে কখনও ধীরে, কখনও দ্রুত লয়ে। আবার কারোর কারোর ক্ষেত্রে সেই ভবিষ্যত আদৌ আসেনি।
সূত্র : ওয়াশিংটন পোস্ট
অনুবাদ : এনামুল হক
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: