ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আশা জাগিয়েও হার

প্রকাশিত: ০৬:১১, ৮ অক্টোবর ২০১৬

আশা জাগিয়েও হার

মিথুন আশরাফ ॥ ইমরুল কায়েস আশার বেলুন আকাশে ওড়ালেন। আবার তিনিই তা ফুটিয়ে দিলেন! তার সঙ্গে সাকিব আল হাসান স্বপ্নটা বড় করলেন। এ দুজনের ব্যাটিং দৃঢ়তায় ম্যাচের মাঝপথে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও গড়া গেল। কিন্তু ইংল্যান্ড রান এত বেশি করে ফেলেছে যে শেষপর্যন্ত হার থেকে মুক্তি মিলল না বাংলাদেশের। শুক্রবার প্রথম ওয়ানডেতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২১ রানে হারই হলো। তাতে করে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ০-১ ব্যবধানে পিছিয়েও পড়ল বাংলাদেশ। বেন স্টোকস তখন ৬৯ রানে। এমন সময়ে স্টোকসের সহজ ক্যাচটি যে ধরতে পারলেন না মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, সেখানেইতো ম্যাচটিও হাতছাড়া হয়ে গেল। শেষপর্যন্ত স্টোকস প্রথম ওয়ানডে শতকটিও পেয়ে গেলেন। তার ১০১ রানের সঙ্গে বেন ডাকেটের ৬০ রান ও জস বাটলারের ৬৩ রানে ইংল্যান্ড ৩০৯ রান করে ফেলল। এরপর ১১২ রান করা ইমরুল ও ৭৯ রান করা সাকিব মিলে ১১৮ রানের জুটি গড়ে বাংলাদেশকে জয়ের আশা দেখান। কিন্তু শেষপর্যন্ত এই জুটি ভেঙ্গে যেতেই হতাশায় ডুবে যেতে হয়। শেষপর্যন্ত ৪৭.৫ ওভারে ২৮৮ রানেই গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। কথাতেই আছে, ‘ক্যাচ মিস তো ম্যাচ মিস’। কথা ও কাজে মিল পাওয়া গেল। ৬৯ ও ৭১ রানে স্টোকস ‘নতুন জীবন’ পেলেন। মাহমুদুল্লাহ ও মোশাররফ হোসেন রুবেল ক্যাচ মিস করলেন। ৫৯ রানে থাকা ডাকেটের ক্যাচটিও হাতছাড়া করলেন মোশাররফ। শেষে গিয়ে তামিম ইকবাল-মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের ভুল বোঝাবোঝিতে ক্রিস ওকসও ক্যাচ আউট হওয়া থেকে বাঁচেন। ডাকেট ও ওকসের ক্যাচ মিস ততটা প্রভাব পড়েনি ম্যাচে। তবে স্টোকস যে সুযোগটি পেলেন, তা কাজে লাগিয়ে নিলেন। যদি ৬৯ রানেই আউট হয়ে যেতেন স্টোকস, তাহলে স্কোর হয়ত ৩০০ রানের বেশি হতো না। ইংল্যান্ড যে এত রান করল তা তো স্টোকসের ১০০ বলে ৮ চার ও ৪ ছক্কায় করা ১০১ রানের সুবাদেই সম্ভব হয়েছে। এরসঙ্গে চতুর্থ উইকেটে স্টোকস ও অভিষেক ওয়ানডেতেই দুর্দান্ত ব্যাটিং করা ডাকেটের ১৫৩ রানের জুটিও এতবড় স্কোর গড়ায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। মাশরাফি বিন মর্তুজা, শফিউল ইসলাম ও সাকিব আল হাসান ২টি করে উইকেট নিতে পেরেছেন। স্টোকসকে আউট করেন মাশরাফি। উইকেটটি নিতেই স্পিনার আব্দুর রাজ্জাককে (২০৭ উইকেট) পেছনে ফেলেন মাশরাফি। এরপর আরেকটি উইকেট নিয়ে বাংলাদেশ বোলারদের মধ্যে সাকিবের (২১৪ উইকেট) পর ওয়ানডেতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হন মাশরাফি (২০৯ উইকেট)। সাকিব ২ উইকেট নিয়ে অবশ্য নিজেকে আরেকটু উচ্চতায় নেন। জেসন রয়ের উইকেট শিকার করতেই দেশের মাটিতে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি স্পিনারদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি স্পিনার শেন ওয়ার্নকে (১৩৪ উইকেট) পেছনে ফেলেন। এরপর বাটলারকের আউট করে ১৩৬ উইকেট শিকার করেন। এখন এ রেকর্ডে সাকিবের সামনে আছেন শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি স্পিনার মুত্তিয়া মুরলিধরন (১৫৪ উইকেট)। ম্যাচটিতে শফিউলও দুর্দান্ত বোলিং করেন। কিন্তু ২৫ ওভারের আগে তাসকিন আহমেদ বলই করেননি। শুরুতে ১৪ ওভার মাঠেই ছিলেন না। ততক্ষণে স্পিনাররা টানা বল করতে থাকেন। বর্তমান বাংলাদেশ দলটি ইংল্যান্ডের চেয়ে অভিজ্ঞ দল। ইংল্যান্ডের কোন ক্রিকেটারেরই ১০০ ওয়ানডে খেলার অভিজ্ঞতা নেই। সেখানে মাশরাফি, মুশফিক, সাকিব, তামিম, মাহমুদুল্লাহ ১০০ ওয়ানডের বেশি খেলেন। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে অভিজ্ঞতার জোরে জেতা গেলেও এবার তা হয়নি। আফগানদের চেয়েও যে বেশি শক্তিশালী দল ইংল্যান্ড। তবে ক্যাচ মিস না হলে অন্যরকম ফলই হতে পারত। ৪৬ রানে তামিম (১৭), ৮২ রানে সাব্বির রহমান রুম্মন (১৮) ও ১৩২ রানে মাহমুদুল্লাহ (২৫) আউট হন। তখনও আশা থাকে। প্রস্তুতি ম্যাচে শতক পাওয়া ইমরুল যে দারুণ ব্যাটিং করছিলেন। ৫৫ বলে অর্ধশতকও করে ফেলেন। কিন্তু ১৫৩ রানে গিয়ে আবারও ব্যর্থ হওয়া মুশফিক (১২) যখন আউট হয়ে যান, তখন মনে হয় আসলে ম্যাচ থেকে ছিটকেই পড়ল বাংলাদেশ। ৩১০ রান করাটা দুরূহ ব্যাপারই। সেই দুরূহ কাজটিই সহজ করে দিচ্ছিলেন ইমরুল ও সাকিব। দুজন মিলে জয়ের আশাও দেখান। দুজন মিলে দলকে জয়ের বন্দরেই নিয়ে যান। পঞ্চম উইকেটে দুজন মিলে ১১৮ রানের জুটিও গড়েন। এরমধ্যে প্রস্তুতি ম্যাচের পর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতেও শতক করেন। ১০৫ বলে শতক করেন ইমরুল। সাকিবও অর্ধশতক করে ফেলেন। কিন্তু যেই স্কোরবোর্ডে ২৭১ রান জমা হয়, সাকিব হাতে ব্যথা পান। ৫২ বলে ৩৯ রান দরকার। মুহূর্তেই ৭৯ রান করে আউটও হয়ে যান সাকিব। জেক বল সাকিবকে আউট করে দেয়ার পর মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতকেও আউট করে দিয়ে হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা তৈরি করেন। তা না হলেও আর ৩ রান যোগ হতেই আদিল রশিদের ঘূর্ণিতে মাশরাফিও (১) সাজঘরে ফেরেন। তখন জিততে ৪২ বলে ৩৬ রানের প্রয়োজন থাকে। কিন্তু ৭ উইকেট পড়ে যাওয়ায় যেটুকু আশা জন্মেছিল, তা যেন নিভে যেতে থাকে। ২৭৯ রানের সময় মোশাররফ হোসেন রুবেলের এলবিডব্লিউ আউটের জন্য রিভিউ সিস্টেম নেয় ইংল্যান্ড। কিন্তু কোন কাজে আসে না। তবে যে ইমরুল আশা দেখান। তিনিই কিনা রশিদের বলে এগিয়ে গিয়ে স্টাম্পিং হয়ে গেলেন। সেই আশা হতাশায় পরিণত করে দেন। জিততে তখন ৩৬ বলে ৩১ রান দরকার। এমন সময়ে ১১৯ বলে ১১ চার ও ২ ছক্কায় ১১২ রান করে সাজঘরে ফেরেন ইমরুল। বাংলাদেশের জয়ের যেটুকু সম্ভাবনা দেখা গিয়েছে, সেটিও শেষ হয়ে যায়। এরপর শফিউল রান আউট হন। ২৮৮ রানে তাসকিন (১) আউট হলে বাংলাদেশের ইনিংসও শেষ হয়ে যায়। হেরে যায় বাংলাদেশ। শেষে ১৭ রানে ৬ উইকেটের পতন ঘটে! অভিষেক ওয়ানডেতেই জ্যাক বল দারুণ বোলিং করেন। ৫ উইকেট নেন। আর লেগ স্পিনার আদিল রশিদ যে আতঙ্ক হয়ে উঠতে পারেন, তা তো আগেই বোঝা গেছে। হলেনও। ৪ উইকেট শিকার করেন। এরআগে যেন প্রস্তুতি ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই করল ইংল্যান্ড। ম্যাচটিতে বিসিবি একাদশ আগে ব্যাট করে ৩০৯ রান করেছিল। কিন্তু ম্যাচটি জিততে পারেনি বিসিবি একাদশ। এবার ইংল্যান্ড একইরকম রান করল। কিন্তু হারল বাংলাদেশ। উইকেট যে ব্যাটিং নির্ভর, তা দুই দলই বুঝতে পারে। আর তাই যে দলই টস জিতবে, ব্যাটিংই নেবে; তা বোঝা যায়। শুরুতেই বাজিমাত করে ইংল্যান্ড। টস জিতে আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্তও নিয়ে নেয়। তাতে করে শুরুতে ধাক্কা খেলেও, শেষে গিয়ে মজবুত ভিতই গড়ে ইংল্যান্ড। তবে এ ভিত গড়ায় যত না ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের কৃতিত্ব, তারচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দিতে হবে বাংলাদেশ ফিল্ডারদের। একের পর এক ক্যাচ মিস যে হয়েছে। ৬৩ রানেই ৩ উইকেট ফেলা গেছে। এরপর ইংল্যান্ডকে আরও চেপে ধরার কথা। কিন্তু হলো উল্টো। বেন স্টোকস ও বেন ডাকেট মিলেই ইংল্যান্ডকে ম্যাচে ফেরালেন। দুজন মিলে চতুর্থ উইকেটে ১৫৩ রানের জুটি করলেন। এ জুটিতেই ইংল্যান্ডের স্কোরবোর্ডে ২০০ রানের বেশি হয়ে গেল। তা হতো না, যদি স্টোকস ৬৯ রানে থাকার সময়ই আউট হয়ে যেতেন। কিংবা ২ রান যোগ হতেই আরেকটি ‘নতুন জীবন’ না পেতেন। দুবার আউট হওয়া থেকে বেচে ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে শতকই করে ফেললেন স্টোকস। এ ব্যাটসম্যান শতক করার আগেই অবশ্য দলীয় ২১৬ রানে আউট হয়ে যান ডাকেট। অভিষেক ওয়ানডেতেই ৬০ রান করেন। ৫৯ রানে ডাকেটও একবার ‘নতুন জীবন’ পান। এতবার ক্যাচ মিস হলে কী আর ম্যাচের ভাগ্যও নিজেদের দিকে নেয়া যায়? পুরো ১০০ বলে ৮ চার ও ৪ ছক্কায় ১০১ রান করে সাজঘরে ফেরেন স্টোকস। এরপর অধিনায়ক জস বাটলার ধুন্ধুমার ব্যাটিং করে ৩৮ বলে ৩ চার ও ৪ ছক্কায় ৬৩ রান করে দলকে ৩০০ রানের স্কোরবোর্ডে নিয়ে যান। শেষপর্যন্ত ৩০৯ রান করে ইংলিশরা। বাংলাদেশের মাটিতে যেটি ইংল্যান্ডের করা সর্বোচ্চ স্কোর। এ স্কোরেই জয় পেয়ে গেল ইংল্যান্ড। জয়ের আশা দেখিয়েও হারল বাংলাদেশ।
×